অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার স্মৃতিতে আছেন, আমার সত্তায় আছেন, আমার ভবিষ্যতেও থাকবেন

কী করে বাংলা বাক্য আরও ছোটো করে আনা যায়, কী করে তা আরও স্পেসিফিক করা যায়-- ছাত্রজীবন থেকেই অঞ্জনদার সেই ভাবনার পরিচয় পাওয়ার সুযোগ আমার ঘটেছিল।

Edited By: সৌমিত্র সেন | Updated By: May 23, 2021, 05:23 PM IST
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার স্মৃতিতে আছেন, আমার সত্তায় আছেন, আমার ভবিষ্যতেও থাকবেন

ব্রাত্য বসু

এমন একজনকে নিয়ে আজ লিখতে হচ্ছে, তাঁকে নিয়ে যে কোনও দিন এভাবে কথা বলতে হবে, স্মৃতিচারণ করতে হবে এটা-- এটাই আমার কাছে কল্পনার অতীত ছিল। তবু যখন লিখতে হবে, তখন বলি, সংবাদমাধ্যমে আপনারা (বা যাঁরা ২৪ ঘণ্টা চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত) কেউ হয়তো তাঁকে 'এডিটর', কেউ 'বড়ো দাদা' বা 'সহকর্মী' হিসাবে দেখেছেন, আমার সঙ্গে কিন্তু তাঁর আলাপ আপনাদেরও অনেক-অনেক আগে। আমার সঙ্গে যখন তাঁর আলাপ, আমি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে, আর তিনি আমারই বিভাগে আমার সিনিয়র এবং অত্যন্ত কৃতী ছাত্র। 

আমরা কম বয়েস থেকেই স্কুলে-কলেজে সিনিয়রদের একটু বাড়তি সমীহ বা সম্ভ্রমের চোখে দেখতাম, ছোটোদের স্নেহ করতাম। ফলে, আমি অঞ্জনদার মতো একজন সিনিয়রকে সেই তখন থেকেই চিনি। যদিও আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছি, অঞ্জনদা তখন এমএ ক্লাস শেষ করার মুখে। তাঁর স্ত্রী, তখন তাঁর বান্ধবী, তাঁদের সম্পর্ক আমাদের চোখের সামনে হতে দেখেছি। 
একটা ঘটনা বলি। আমার এক বন্ধু তিনিও এখন প্রয়াত। সেই সিনিয়র একটা খাতা আমাদের দেখিয়েছিলেন। অঞ্জনদার লেখা কলেজের পরীক্ষার কোনো খাতা। তিনি বলেছিলেন, অঞ্জনদা সাহিত্যের উত্তর লিখতেন দেড় পাতা থেকে দু'পাতার মধ্যে। সাহিত্যের মতো বিষয়ে, ভেবে দেখুন, এতটা নিশ্ছিদ্র, এতটা স্পেসিফিক এবং এতটাই অভ্রান্ত তিনি। ওঁরা দুজনেই হিন্দু হস্টেলের প্রাক্তনী। তখন  হিন্দু হোস্টেলে এক সঙ্গে থাকতেন বলে আমার ওই সিনিয়র বন্ধুটি অঞ্জনদার পরীক্ষার খাতাটি হাতে পেয়েছিলেন। বন্ধুটি বলেছিলেন, 'কখনও কখনও' না লিখে অঞ্জন লিখবেন 'ক্বচিত্‍'। মানে, কী করে বাক্য আরও ছোটো করে আনা যায়, কী করে আরও সংকুচিত করা যায়, কী করে আরও স্পেসিফিক করা যায়। সেই সময় থেকেই অঞ্জনদার সেই (ভাষা) ভাবনা আমার এখনও মনে পড়ে। 

আরও পড়ুন: মুকুন্দপুরে কোভিড রিলিফ সেন্টার, এডিটর অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্‍সর্গ কান্তির

দীর্ঘদিন ওই কলেজের ক্যান্টিনে বসে আড্ডা, জ্ঞানগর্ভ আড্ডা, পোর্টিকোয় বসে আড্ডা দিয়েছি। দেখতাম অঞ্জনদা এবং অদিতিদি গল্প করছেন। ওঁরা কফি হাউসের দিকে ঢুকে যাচ্ছেন বা কলেজে বা ওই পোর্টিকোতে বসে আছেন। এরপর কিছুদিন বাদে তো তিনি 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় চলে গেলেন। যাঁর ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর কথা ছিল, তিনি গেলেন সাংবাদিকতার চাকরি করতে। পরে কর্মসূত্রেই চলে গেলেন হায়দরাবাদে। আমি সেই সময়-পর্বে হায়দরাবাদে থিয়েটার করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে ওঁকে খবর দিলাম। তিনি আসতে পারলেন না। ওঁর স্ত্রী এলেন। কিন্তু ওঁর সঙ্গে আমার  যোগাযোগ একটা থেকেই গিয়েছিল। 

আমার এখনও মনে আছে, ওই নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর পর্বে, আমাদের অনেকেই, যাঁরা (ওই) আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা আপনাদের চ্যানেলে তখন যেতে চাইতেন না। কেন যেতে চাইতেন না, সেই প্রসঙ্গে আজ আর আমি যেতে চাই না। যাই হোক, বিষয়টা হল, অনেকে যেতে না চাইলেও আমি যেতাম, তার কারণ আমার কলেজের এক সিনিয়র তো ওখানে 'অ্যাঙ্কর'! যিনি আমাকে 'গার্ড' করবেন। তো, আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে দেখি, আমি তো চক্রব্যূহে ঢুকে পড়েছি, কিন্তু তখনও আমি জানি, ওই দিকে একজন দাঁড়িয়ে আছেন, যিনি আমাকে রক্ষা করবেন। এই কিছুদিন আগে আপনাদের চ্যানেলে একটা বড়ো সাক্ষাত্‍কার হল। সেই সাক্ষাত্‍কার নিয়েও পরের দিন তাঁর উচ্ছ্বাস তিনি আমায় জানালেন। 

অঞ্জনদার সঙ্গে খুবই ইনফর্মাল সম্পর্ক আমাদের। ওঁর সঙ্গে কত যে গল্প হয়েছে, কত যে আড্ডা হয়েছে! এবং সেটা হয়তো এরকম-- 'তুই এই ইস্যুটা নিয়ে কথা বলবি না কেন?' 
'আমি কথা বলব না, আমার ইচ্ছে।'

কখনও কোনো পার্টিতে দেখা হওয়া, বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা হওয়া এসব তো ছিলই। চ্যানেলে গেলে দুজনে একসঙ্গে বাইরে বেরিয়ে গল্প করা, অনুষ্ঠান হয়ে গেলে চ্যানেলের নীচে দাঁড়িয়ে কথা বলা, ব্যালকনিতে গিয়ে কথা বলা--এসব তো ছিলই। প্রায় তিরিশ বছর অতিক্রান্ত তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ। আমার ধারণা, আপনাদের চ্যানেলের অনেকের আগেই আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ। আমাদের  ডিপার্টমেন্টের, আমাদের কলেজের যে দু'একজন কৃতী সন্তান আছেন, যাঁদের বাঙালি চেনে, অঞ্জনদা ছিলেন তাঁদের অন্যতম। আমরা তো 'ব্ল্যাকশিপ'। কিন্তু উনি ছিলেন সত্যিকারের গুণী মানুষ। কলেজজীবন থেকেই তাঁকে আমরা দেখেছি, ঝকঝকে, মেধাবী, কাট-কাটা কথা, এবং যাকে বলে 'তড়বড়' করে কথা বলা। কলেজজীবনে খুব তড়বড় করে কথা বলতেন। 

তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ আর কী করব! আমার এখন শুধু অদিতিদির মুখ খুব মনে পড়ছে। তাঁদের মেয়েকে আমি কখনও দেখিনি বা একবার দেখে থাকলেও দেখে থাকতে পারি। তাঁর গোটা পরিবারের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ছিল। তাঁর বাবার সঙ্গেও আমার কথা হত। মোট কথা, সব মিলিয়ে যাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে হচ্ছে, সেই অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার স্মৃতিতে আছেন, আমার সত্তায় আছেন, তিনি আমার ভবিষ্যতেও থাকবেন। করোনা এসে অনেককে কেড়ে নিল। আমার পরিচিত অনেকজনকে। আমি যে এখনও কথা বলতে পারছি, তা ঈশ্বরের অসীম কৃপা। অঞ্জনদাকে নিয়ে কথা বলতে হবে ভাবলে আমার এখনও কীরকম একটা লাগছে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কলেজের মুখটাই যেন বেশি মনে পড়ছে। একটা সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে অঞ্জনদা বললেন-- নে, নে, খা! আমার সামনেই খা! সেইটা খুব মনে পড়ছে।

তাঁকে সেই অর্থে সাংবাদিক হিসাবে কোনো দিনও দেখিনি। মানে, ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতটাই প্রায় দাদা-ভাইয়ের মতো ছিল যে, এর মধ্যে ওই সাংবাদিক-সাংবাদিক ব্যাপারটাই আসত না। মানে, উনি আমায় ফোন করে 'এই অমুক জিনিস তমুক জিনিস' সব বলতেন। কিন্তু ওঁর একটা ব্যাপার ছিল-- ভেতরের খবর আমার থেকে ডাইরেক্ট কখনও জানার চেষ্টা করতেন না। অনেক সাংবাদিকেরই যেটা স্বাভাবিক প্রবণতা হয়। সেই প্রবণতাবশে তিনি কখনওই আমার থেকে এরকম কিছু জানার চেষ্টা করেননি। বড় জোর বলতেন-- আজকে এই টক শো আছে, তোকে আজ এখানে এই অনুষ্ঠানে লাগবে। আমি বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব নয়; তখন উনি আবার 'কেন সম্ভব নয়?'--ইত্যাদি ইত্যাদি বলতেন। 

ওঁকে আমি প্রথমে প্রিন্টে দেখি। পরে অডিও-ভিসুয়ালে দেখেছি। তারও পরে ডিজিটালে দেখেছি। অর্থাত্‍, সাংবাদিকতার তিন রকম সত্তায় দেখেছি। তিনটেতেই তিনি খুব স্বছন্দ। 

যখন প্রিন্টে ছিলেন তখন বয়স কম। আমার ধারণা, সাংবাদিক হিসাবে, এডিটর হিসাবে আপনাদের চ্যানেলেই ওঁর পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। যেখানে উনি রাজ্য রাজনীতির প্রায় তুখোড় সমস্ত বড়ো বড়ো নেতার সাক্ষাত্‍কার নিচ্ছেন, চ্যানেলের লুক পাল্টে দিচ্ছেন। বিশ্বায়নোত্তর মিডিয়া চ্যানেলের যে হিংস্র অভিমুখ তৈরি করা, এই যে ন্যারেটিভ তৈরি হওয়ার একটা নতুন ধরন চলে এল, সেই আগের ঢিলে-ঢালা কোনো ধরন নয়, একটা প্রায় সর্বগ্রাসী হাঙরের মতো মিডিয়ার ঝাঁপিয়ে পড়া, এই ন্যারেটিভটা তৈরি করা, আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে বাংলায় যে দু'তিনজন খুব অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন, তার মধ্যে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একজন। চব্বিশ ঘণ্টা ফুটছে একটা তাওয়া, যে তাওয়ার মধ্যে নানা রকম খবর ফুটছে, সেই ফোটার কোনো এক বুদবুদের নাম 'রাজনীতি', কোনোটির নাম 'এন্টারটেনমেন্ট', কোনোটির নাম 'কেন্দ্র', কোনোটির নাম 'রাজ্য'। এই যে একটা তাওয়ার মধ্যে বিভিন্ন বুদবুদ হিসাবে খবরগুলিকে ফোটানো, চব্বিশ ঘণ্টা সেটাতে আঁচ দিয়ে রাখা, জ্বাল দিয়ে রাখা, সমাজে এই যে নতুন ন্যারেটিভ তৈরি হল, সেখানে পলিটিক্স, একটা সর্বাধিশায়ী রাজনীতি, সমাজে একটা প্রায় সর্বগ্রাসী ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করল। রাজনীতি আগেও ছিল কিন্তু তার এতটা সর্বগ্রাসী-- তা ভালো না মন্দ আমি জানি না-- হয়ে ওঠা, ঠিক এরকমটা ছিল না। অডিও-ভিসুয়াল এই যে ন্যারেটিভটা বাংলায় তৈরি করল এবং অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমে যে ক'জন এটা করেছেন, আমি অডিও-ভিসুয়াল-ই বলছি, সেখানে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামাজিক, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক একটা  ভূমিকা আছে। যেটা তাঁকে সম্পাদক ও সাংবাদিক  হিসাবে নিশ্চয়ই স্মরণীয় করে রাখবে। 

তবে শেষে এইটুকুই বলতে পারি, আমি কিন্তু তাঁকে আজীবন ব্যক্তিগত দিক থেকেই দেখে যাব।

আরও পড়ুন: সময়ের ছাই

.