রাজীবকুমার সাহা


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

।।এক।।


কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না একদমই। নিমুটা মানল না, জোর করে সঙ্গ নিল। মুখ ভার করে বলল, “নতুন জায়গায় বদলি হয়েছ, সেজদা। দু’দিন থেকে একটু গুছিয়ে দিয়ে আসব। তাছাড়া, বছর তিনেক ঘুরে গেল কোত্থাও পা বাড়াইনি। বারণ করলে শুনব কেন?”


বিলক্ষণ টের পেলাম এর পেছনে কার মদত রয়েছে। ভেতর বারান্দার দরজার দিকে নজর ঘোরাতেই একটুকরো শাড়ির আঁচল সরে গেল চকিতে। বুঝলাম, চোখ গরম করেও লাভ হবে না। ভবি ভুলবে না।


 


গাড়ি মিনিট কুড়ি লেটে চলছিল। কামরায় চড়েই নিমু লেগে গেল বিছানা গোছাতে। লোয়ার বার্থ থেকে আমাকে উঠিয়ে দিয়ে পরিপাটি করে বিছানা পেতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ঘুমোবে তো এখন?”


বললাম, “না রে, একটু বসি। ঘুম পেলে শুয়ে পড়ব। তুই ঘুমো গে, যা।”


বাড়ি থেকে খেয়েই বেরিয়েছিলাম। তবুও নিমু মিডল বার্থে চড়তে চড়তে বলে গেল, “দেরি কোরো না বেশি। খিদে পেলে আমাকে ডেকো। সকাল সকাল খেয়ে বেরিয়েছ। বৌদিদি টিফিন ভরে দিয়েছে হটপটে।”


আমি মুচকি হেসে মাথার পেছনে হাত রেখে জুত করে গুছিয়ে বসলাম সীটে। একটা গল্প মাথায় ঘুরঘুর করছে। দেখি ছকে ফেলতে পারি কি না। একটু আধটু লেখালিখির নেশা রয়েছে বৈকি।


।।দুই।।


বৃষ্টি-ধোয়া ছিত্তনগঢ় স্টেশনে যে লোকটা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল তাকে নিয়ে জম্পেশ একটা ভূতের গপ্প ফাঁদা যায়। পরিবেশ-পরিস্থিতি দুটোই এক্কেবারে খাপে খাপ। নিশুতি রাত। আন্দাজ আড়াইটে থেকে তিনটে। হাতে ঘড়ি ছিল না। কিলোমিটার তিনেক আগে থাকতেই গাড়ির জানালার কাঁচে জোর বৃষ্টির ফোঁটা দেখে রুমালে মুড়ে পকেটে চালান করে দিয়েছিলাম।


“হেই বাবু, ও তেসিলবাবু, ইদিকে ইদিকে,” বলে তীব্র হাতনাড়া দেখেই বুঝে গেছিলাম, যে লোকটা স্টেশনে থাকবে বলে আমাকে হেড অফিস থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, এ সেই। কষ্টিপাথরের তালঢ্যাঙা শরীরে আধময়লা একটা খেটো ধুতি আর আকাশিরঙা একটা ঝুল-শার্ট। ভিজে চুল থেকে জল গড়িয়ে নামছে কপাল আর গাল বেয়ে। গর্তে বসা চোখের মণিদুটোর ভোঁতা দৃষ্টি। পাথর-কোঁদা মুখে দেখার মতো শুধু তাগড়াই একজোড়া কাঁচাপাকা গোঁফ। আমি ট্রেন নড়ে ওঠার ঠিক আগমুহূর্তে জামাকাপড়ের সুটকেসটা বাগিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁড়াতে পেরেছি দেখে কী হাসি আর কী হাসি। নিমু হোল্ড-অলটা পাঁজাকোলা করে পেছনে দাঁড়িয়েছিল আমার। লোকটা একটানে ওটা মাথায় চাপিয়ে বলল, “আসুন বাবু, আমার পিছে পিছে আসুন। রাস্তা একটু খারাপ আছে।”


আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে চিনলে কী করে! আমারই তো তোমাকে খুঁজে নেওয়ার কথা ছিল।”


আবার সেই দন্তবিকাশ কৌমুদীর দ্যুতি ছড়িয়ে জবাব এল, “হুই কামরায় সব দেহাতি পাসিঞ্জার ছিল। আপনারা সিরফ বাঙ্গালি ছিলেন।”


“আহা, সে তো অন্য বগিতেও দেহাতি-বাঙালি বা অন্য জাতি মিলেমিশে রয়েছে নিশ্চয়ই।” আমি ওকে প্যাঁচে ফেলবার তাল করি।


“আমি ইকটু বুদ্ধি করেছিলাম। সব বগির কাছে দাঁড়িয়ে তেসিলবাবু বোলে জোরে চিল্লাচ্ছিলাম। ই বগির কাছে এসে চিল্লাতেই আপনি সঙ্গে সঙ্গেই আমার দিকে নজর ফেললেন। মালুম পড়ে গেল।” সলজ্জ হাসি ঝরে পড়ে এবারে।


খুশি হয়ে বললাম, “বাহ্‌, খাসা বুদ্ধি তো তোমার! নামটি কী হে?”


“আমার নাম লছমন আছে, বাবু। লছমন মাহাত। আমি আপনার সব কামকাজ করে দিব। কুছু চিন্তা নেই। আগের তেসিলবাবুর কাজ আমিই করতাম।”


স্বস্তি পেলাম খানিক যা হোক। বাড়িঘর, পড়াশোনা সব রাঁচির মূল শহরেই। দু’-একটা শহরতলিতে বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ছাড়া এধরনের গণ্ডগ্রামে থাকার অভ্যেস কোনও কালেই ছিল না। নতুন চাকরি, উপায়ও নেই। তা একটা মানুষ যদি সঙ্গে সঙ্গে থাকে, ভালোই। অফিস এলাকা সম্পর্কে তো জানি না কিছুই। জিজ্ঞেস করলাম, “তা লছমনভাই, তোমার ঘরটি কোথায়? আমাদের কাছারির কাছেই, নাকি?”


“না হুজুর, ইকটু দূর আছে। সোকাল সোকাল এসে যাব কাজে। চিন্তা করবেন না একদম।”


স্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে এবারে ঢুকতে শুরু করলাম ঝোপঝাড় ভেঙে। সামনেই নাকি একটা জঙ্গল পড়বে। পেরোলেই ছিত্তনগঢ় তহসিল, আমার কাছারি। লছমন হাত তিনেকের একটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে ঝপাৎ ঝপাৎ করে অবলীলায় আগাছা ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে হাসিমুখে। আমরা পেছন পেছন। ওর রণপার মতো কদমের সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের প্রায় দৌড়োতে হচ্ছে। চারদিকে বৃষ্টিভেজা রাতের ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। একহাত দূরে কিচ্ছু দেখা যায় না। অবিরাম ঝিঁঝিঁর ডাক কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে। সুটকেসটা খুলে টর্চটা হাতে নিয়ে রেখেছিলাম স্টেশন থেকে বেরোবার মুখেই। তাই যা রক্ষে। নীরব হেঁটে চলেছি তিনজন। আরও কতদূর কে জানে। জঙ্গলই তো শুরু হয়নি এখনও। নিজেকে মনে মনে গাল পাড়তে পাড়তে চলেছি। লছমনও তখন উসকাল, সকাল আটটা-সাড়ে আটটার আগে কোনও রিক্সাভ্যান পাওয়া যাবে না কোয়ার্টারে পৌঁছতে। কোনাকুনি হেঁটে রাতারাতি পৌঁছতে হলে এই রাস্তাটাই শর্টকাট। কতটুকুই বা পথ? গল্প করতে করতে নাকি পৌঁছে যাব। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। এখন দেখছি স্টেশনে অপেক্ষা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ ছিল। তাও রক্ষে, বৃষ্টিটা ধরে এসেছে।


নীরবতা ভাঙল লছমনই। নিচু গলায় জানতে চাইল, “ও কে আছে, বাবু? আপনার কাজের লোক?”


অবাক হলাম। নিমু বাইরে বেরোলে বাবুটি না সেজে কখনও বেরোয় না। এক নজরেই লছমন নিমুকে ভাইবেরাদর ঠাওরাল কী করে? লোকটার জ্ঞানগম্যি নেহাত মন্দ নয় দেখছি। জবাব দিলাম, “হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। নিমু অনেকদিন আমাদের বাড়িতে আছে। পরিবারের একজনের মতোই।”


একসময় জঙ্গলও শেষ হল, পুবের আকাশও ফর্সা হল। আমার নতুন আস্তানায় ঢুকে দম ফেললাম। ছোটোখাটো একটা টিলার ওপর কোয়ার্টার। দারুণ বলব না, চলে যাওয়ার মতো বটে। হাফ ওয়ালের ওপর টিনের ঘর। মজবুত নয় তেমন। অসুবিধে একটাই। আশেপাশে ছোটোখাটো জন্তুজানোয়ার ছাড়া কথা কইবার লোকজন নেই। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ।


দু’দিন কেটে গেল গাছপালা দেখতে দেখতেই। খানিক দূরেই আমার কাছারি, যে কাছারিতে আমি তহসিলদার হয়ে এলাম। বর্তমান তহসিলদার এসে কোয়ার্টারে দেখা করে গেছেন কাল সন্ধেয়। স্থানীয় মানুষ। বলে গেলেন, আরও দিন দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে কাছারিতে গেলেও ক্ষতি নেই। কিছু কাজ বাকি রয়েছে। আরও দিন দুয়েক লাগবে আমাকে চার্জ বুঝিয়ে দিতে।


সে রাতে স্টেশনে লছমনকে প্রথমবার দেখার পর একটা ভূতের গল্প ভনভন করছিল মাথায়। সত্যি বলতে কী, মাঝেমধ্যে আমার নিজেরই গাটা কেমন ছমছম করে ওঠে লছমনকে দেখে। ওর চালচলন, কথাবার্তা বিশ্লেষণ করতে শুরু করি যখন তখন। বুঝতে পারছি, ওকে নিয়ে আমার অলৌকিক জল্পনার ফলশ্রুতি ওটা। কল্পনাপ্রবণদের বোধহয় ওরকম হতেই হয়। নইলে কি আর গল্প লেখা যায়? ভাবলাম, এই সুযোগ। গল্পটা নামিয়ে ফেলি চটপট। একটু গোছগাছ করে দিয়ে নিমুও ফিরে যাবে দু’দিনের মধ্যেই। তখন আর সময় হবে না ক’দিন হয়তো।


কাগজ কলম টেনে নিয়ে দু’ছত্র লিখেছি কি লিখিনি, লছমন এসে হাজির সামনে। বলল, “বাবু, একটা কথা ছিল।”


বুঝলাম, ওর ‘একটা কথা’ বলতে সে কথাটাই যেটা ছিত্তনগঢ়ে পা রাখা ইস্তক ও আমার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছে। সামান্য হতাশ হয়ে কলম মুড়ে রেখে বললাম, “কী কথা? বলে ফেল।”


লছমন দোনামোনা করে বলল, “আমার খেতিবাড়ি সব গাপ করে দিয়েছে আমার ভাই রামুয়া। জমিনের কাগজও ছিনিয়ে নিয়েছে। নতুন কাগজ বানিয়ে দিন না, বাবু। পুরানা তেসিলবাবুকে বললেই ধমকে ওঠেন।”


এই সহজ সরল মানুষটাকে যে কেউ না কেউ একদিন মাথায় বাড়ি দেবে সে ব্যাপারে আশ্চর্য হইনি। কিন্তু তার এই আকুতি মেটাতে গেলে আমাকে অনেক কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। হয়তো থানাপুলিশও। কাছারিতে সব রেকর্ড চেক করতে হবে। এক্কেবারে নতুন অবস্থায় কতটুকু কী করতে পারব নিজেই সন্দিহান। তাছাড়া সত্যি-মিথ্যের যাচাইটুকুও করা চাই সবচেয়ে আগে। খানিক অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে সান্ত্বনা দিলাম, “বললাম তো লছমন, ঠিক আছে। আমি দেখব কী করা যায়। কাছারিতে যাই আগে।”


লছমন যে বিশেষ আশ্বস্ত হল না, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তারপরও পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে গোমড়া মুখে বিড়বিড় করে অনেক কথা শুনিয়ে গেল রামুয়ার। আমি চুপ করে শুনলাম। এ যাবত প্রায় বার দশেক শুনে ফেলেছি এসব। একটুক্ষণ বসে থেকে লছমন উঠে চলে গেল। নিমু যতদিন রয়েছে কোনও কাজেই হাত দিতে দেবে না ওকে।


আজও সকাল সকাল এসে কানের পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছিল লছমন। সেই এক আবদার। বেশ বিরক্ত হয়ে তাড়িয়ে দিলাম শেষে আজকের মতো। মুখ অন্ধকার করে বাড়ি ফিরে গেল। জানি কাল সকাল না হতেই আবার বসে পড়বে পায়ের গোড়ায়।


মনটা খানিক বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। নিমু বিকেলের গাড়িতে ফিরে যাবে। আমিও কাল থেকে কাছারি যাব। হালকা গা গরম আর সর্দি নিয়ে বেচারা গোছগাছ করে নিচ্ছে।


কিন্তু নিমুর যাওয়া হল না। দুপুরে ভাত খেয়ে উঠেই সেই যে ভারি শীত করছে বলে বিছানা নিল, আর উঠল না। ঘণ্টা খানেক পরেই গায়ে হাত দিয়ে ছ্যাঁকা খেলাম। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। সন্ধে নেমে এসেছে ততক্ষণে। কিছুক্ষণ জলপট্টি দিয়ে ঠিক করলাম যে নিচের বাজার থেকে কিছু ওষুধবড়ি এনে রাখতেই হবে। নয়তো রাতবিরেতে বাড়াবাড়ি কিছু হলে কূলকিনারা পাব না। চারদিকে কিলোমিটার খানেক অবধি কোনও জনবসতি নেই।


নিমুকে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে, হাতের কাছে জলের বোতলটা রেখে টর্চটা নিয়ে রওনা দিলাম বাজারের দিকে। এদিকে আবার অন্ধকার গাঢ় হতেই নাকি সব ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। ত্রস্তপায়ে নেমে গেলাম টিলা বেয়ে।


ওষুধের দোকানে গিয়ে দাঁড়াতেই দোকানির গলায় যখন, “আসুন বাবু, বাঙালি নাকি?” প্রশ্নটা কানে এল, চমকে উঠলাম রীতিমতো।


বছর পঁয়ত্রিশের সুন্দরপানা একটা ছেলে। সহাস্যে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, তবে আজন্ম রাঁচিতে মানুষ। আপনি?”


“আমি পেটের দায়ে, স্যার। ফার্মেসি পাশ করে নিজের শহরে সামান্য পুঁজিতে কিস্যু হবার নয় ভেবেই… কিছু চাই?”


“হ্যাঁ, জ্বরের ওষুধ।”


“ও। পেশেন্ট কই? না দেখে তো কিচ্ছু দিতে পারব না। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া সবই কিলবিল করছে এখানে। নিয়ে আসতে পারবেন না?”


“উঁহু, সম্ভব নয়। নড়তেই পারছে না। তার চেয়ে আপনি যদি আমার সঙ্গে একবারটি গিয়ে…”


“দেখতেই তো পাচ্ছেন। একটাই দোকান। তায় আবার হাটবার। এ মুহূর্তে তো সম্ভব হবে না। কোনও কাজে এলেন? উঠেছেন কোথায়?”


মুচকি হেসে জানালাম, “আমি নতুন তহসিলদার। আছি ওই কোয়ার্টারেই। ওই টিলার ওপরটাতে যে তহসিল কাছারিটা।”


কথাটা কানে যাওয়ামাত্রই ছেলেটার চোখমুখ কেমন পালটে যেতে লাগল। ভয়, নাকি বিস্ময়, নাকি সন্দেহ কিছুই সঠিকভাবে বর্ণনা করা যায় না সে চেহারার। মুখের পানে অপলক চেয়ে আছে তো আছেই।


বিরক্তিটা চেপে রেখে তাড়া দিলাম, “ঠিক আছে। আপাতত গোটাকতক প্যারাসিটামল আর অ্যান্টাসিড দিয়ে দিন। বাকিটা কাল সকালে নয়…”


“না না, আমাকে বলুন, ওখানে কী করছেন আপনারা! তহসিল কাছারি তো বছর দুয়েক হল কিলোমিটার পাঁচেক দক্ষিণে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ওই ছিত্তনগঢ়ের দিকে। এদিকেরটা তো অস্থায়ী কাছারি ছিল। পুরনো অফিস আর কোয়ার্টার বলতে যেটা পড়ে রয়েছে সে তো মানুষের বসবাস যোগ্য নয়। কী করে যেন এক রাতে আগুন লেগে পুড়ে মরেছিল কোয়ার্টারের কেয়ারটেকার। আটকা পড়ে গিয়েছিল।  ক’মাস আগেই তো একজন নতুন তহসিলদার...”


“মানে? কী আবোলতাবোল বলছেন? ওখানে কোয়ার্টার, কাছারি সবই চালু রয়েছে। আর আপনি বলছেন সরিয়ে ফেলা হয়েছে!”


“হ্যাঁ, যা সত্যি তাই তো বলছি। ক’মাস আগেই ওই জঙ্গলে একজন তহসিলদারের লাশ পাওয়া গেছে। আপনি জানেন না কিছু? পোস্টমর্টেম রিপোর্টে হার্টফেল এসেছে। এর আগেও একজন ঠিক এমনভাবেই… নতুন কাছারিতে না গিয়ে ওখানে কি ওঁরা নিজে থেকেই গেলেন, নাকি কেউ ভুলিয়ে নিয়ে গেল সে জানা যায়নি।”


পায়ে পায়ে আরও গুটিকতক হাটুরে জড়ো হয়। সমস্বরে ছেলেটির বক্তব্য আমাকে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে। আমি গলা চড়িয়ে বললাম, “এটা ছিত্তনগঢ় নয়? আমি পষ্ট দেখলাম স্টেশনে লেখা রয়েছে…”


“আরে না মশাই, এটা ভরতগঢ়। অত অত দোকানের সাইনবোর্ড চোখে পড়ছে না আপনার?” কে একজন ঝাঁঝিয়ে উঠল কানের গোড়ায়। চোখের দৃষ্টি, শ্রবণশক্তি আমার কেমন যেন আবছা লাগছে সবকিছু।


হঠাৎ মনে পড়তেই বললাম, “আমাকে তো লছমন নিয়ে এল স্টেশন থেকে। লছমন মাহাত। চেনেন না আপনারা?”


কোত্থেকে জবাব এল, “চিনব না মানে? সেদিনকার ঘটনা। ওই তো ছিল সেই কেয়ারটেকার। এখন বউ-ছেলেপুলেসব মরতে বসেছে না খেয়ে। বড়োভাই রামুয়া রাতদুপুরে হাঁড়িয়া টেনে এসে লাঠিপেটা করে সবক’টাকে। জমিজিরেত যা ছিল লছুয়ার, সব নিজের নামে করিয়ে নিয়েছে ওই শয়তানটা। কে না জানে, মশাই?”


কী করে আঁতিপাঁতি দৌড়ে বাজার থেকে বেরিয়ে এলাম, টর্চ কোথায় ফেললাম কিছুই হুঁশ নেই। একটা গলার স্বরই শুধু মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, ‘ক’মাস আগেই ওই জঙ্গলে একজন তহসিলদারের লাশ পাওয়া গেছে… এর আগেও একজন ঠিক এমনভাবেই…’


হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে টিলা বেয়ে উঠে দাঁড়াতেই টলে গেল শরীরটা। ভাঙাচোরা একটা টিনের ঘর মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে আমার সামনে। এক মানুষ লম্বা আগাছায় জড়িয়ে ধরেছে। চারদিক অন্ধকার। আকাশভর্তি তারায় যতটুকু আলো সেটুকুই। কোথায় বসে একটা পাখি ডেকে যাচ্ছে একটানা, ‘হুককু… হুককু…’। পা দুটো আমার যেন মাটিতে পুঁতে রেখে গেছে কেউ। বুকের ভেতর থেকে কী একটা প্রচণ্ডভাবে লাফাতে লাফাতে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।


ওভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না। আচম্বিতে খানিকটা সম্বিৎ ফিরে পেতেই মরিয়া হয়ে শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু এক করে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা ভাঙা দরজাটা কোনওমতে ফাঁক করে ঘরে ঢুকলাম গিয়ে।


তারপর নিকষ অন্ধকারে এটা ওটা হাতড়ে বেহুঁশ নিমুকে কখনও টেনে-হিঁচড়ে, কখনও কাঁধে তুলে নেমে এসে একদৌড়ে পাকা রাস্তায় পড়েছি কি পড়িনি বুঝে ওঠার আগেই কোত্থেকে কী একটা হয়ে গেল টের পেলাম না। কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময় পেয়েছিলাম মাথায় বেমক্কা একটা চাপমতো টের পেতে।


।।তিন।।


বছরের মাঝামাঝি। শুক্রবার। রাত সাড়ে দশটা। আমাদের সাঁতরাগাছি-আনন্দবিহার আপ উল্কা হয়ে ছুটছে ঘণ্টা দেড়েকের পিছিয়ে পড়া সময়কে পূরণ করে নিতে। নিমু গুটিসুটি মেরে আমার ওপরের বার্থে ঘুমিয়ে কাদা। আমি মশগুল অলৌকিক গল্পের প্লটে। প্রথম দৃশ্য শুরু হবে যেকোনও ছোট্ট একটা স্টেশনে গাড়ি দাঁড়াতেই। কষ্টিপাথরের তালঢ্যাঙা শরীরের একটা লোক হাত নেড়ে চিৎকার করতে থাকবে, “হেই বাবু, ও তসিলদারবাবু, ইদিকে ইদিকে।”


লেখা হল না। একটা তীব্র বিস্ফোরণের আওয়াজ আর বগিটার উত্তাল হয়ে দুলে ওঠা, এটুকুই কেবল…


আতঙ্কবাদীরা দায় নিয়েছিল ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই। শেষতম মুহূর্তে বছর তিনেকের একমাত্র সন্তানের মুখটা ভেসে উঠেছিল চোখে। পরদিন ছোটোবড়ো প্রায় সব কাগজে মোট উনিশ জনের নাম উঠেছিল। চার নম্বর নামটা আমার। দাম পাঁচ লাখ।


আরও পড়ুন- কিছু সত্যি, কিছু বানানো