পথ দেখিয়েছিলেন ইস্কনের শ্রীলপ্রভুপাদ? কোভিডে প্রয়াত স্ত্রীকে নতুন করে `আঁকড়ে ধরলেন` স্বামী...
ফেসব্যাগের চেইন খুলে মাকে শেষ দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। মর্মান্তিক! কিন্তু সেটুকু সুযোগও পাননি তাপস। প্রাণাধিক প্রিয় স্ত্রীকে শেষদেখার বিন্দুমাত্র সুযোগও পাননি তিনি, কেননা তিনি নিজেই তো তখন কোভিডে বাড়িতে শয্যাশায়ী!
অয়ন ঘোষাল: তাপস শাণ্ডিল্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনার বোধহয় ওইটুকুই অমিল। কবি লিখেছিলেন, 'তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা?' কবি ছবির 'ছবিত্ব' নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসলে বলতে চেয়েছিলেন, কবির অন্তরে যিনি আছেন তিনি নিছক ছবি নন, ছবিকে অতিক্রম করে তিনি আরও অনেক বহু বিপুল অনন্ত; অনেকটা ওই সুদূরের নীহারিকার মতো। তাপস শাণ্ডিল্য কিন্তু ছবি, বা বলা ভালো মূর্তির মাধ্যমেই তাঁর প্রিয়াকে ফিরে পেতে চান। মূর্তির মূর্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন না-তুলে তিনি বরং মূর্তির সীমার মধ্যেই দাম্পত্যের অসীমকে ধরতে চেয়েছেন।
আরও পড়ুন: 'বরফঢাকা তিলোত্তমা' ভাবের ঘরে চুরি? ফেকের ঠেকে তা হলে আসল ছবি কোনটি?
'এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া'র অবসরপ্রাপ্ত কর্মী তাপস শাণ্ডিল্য এবং তাঁর স্ত্রী ইন্দ্রাণীদেবী, দু'জনেই কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভে, ২০২১ সালের ২ মে, একসঙ্গে করোনা-আক্রান্ত হন। তবে কো-মর্বিড হওয়ায় ইন্দ্রাণীদেবীর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ৩ মে শেষরাতে প্রয়াত হন তিনি। শাণ্ডিল্যদম্পতির একমাত্র পুত্র মাত্র তিন মিনিটের জন্য ফেসব্যাগের চেইন খুলে মাকে শেষ দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। মর্মান্তিক! কিন্তু সেটুকু সুযোগও পাননি তাপস। প্রাণাধিক প্রিয় স্ত্রীকে শেষদেখার বিন্দুমাত্র সুযোগও পাননি তিনি, কেননা তিনি নিজেই তো তখন কোভিডে বাড়িতে শয্যাশায়ী!
অনেক বছর আগের কথা। একবার মায়াপুর ইস্কন মন্দিরে বেড়াতে গিয়ে শ্রীলপ্রভুপাদের নিখুঁত অনবদ্য এক মূর্তি দেখেছিলেন শাণ্ডিল্য দম্পতি। কথাচ্ছলে তখন স্বামীকে ইন্দ্রাণীদেবী বলেছিলেন-- আমাদের মধ্যে যে আগে যাবে, অন্যজন তাঁর স্মৃতিতে এরকম একটা মূর্তি করলে কেমন হয়? স্ত্রীর প্রয়াণের পর স্ত্রীর সেই ইচ্ছের কথা মনে পড়ে তাপসের। তাঁর মূর্তি-ভাবনার শুরু হয়তো সেখান থেকেই।
প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা ব্যয়ে ইন্দ্রাণীদেবীর এই সিলিকন মূর্তি তৈরিতে সময় লেগেছে মোটামুটি ছ'মাস। শুধু মুখটুকু ফুটিয়ে তুলতেই শিল্পী সুবিমল পাল সময় নিয়েছেন পাক্কা তিন মাস। ইন্দ্রাণী দেবীর পোশাকের মাপ তাঁর দর্জির কাছে গিয়ে নোট করে এনে, দিনের পর দিন সুবিমলের ওয়ার্কশপে গিয়ে বসে তাঁকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করিয়েছেন তাপস।
তাই শেষবিচারে তাপস শাণ্ডিল্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনার অমিলের কথাটা হয়তো আর তোলা চলে না। মিলও আছে তাঁর রবিঠাকুরের সঙ্গে। কেননা, তাঁর মনও হয়তো কবির মতোই এখন বলছে-- 'নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি'; কেননা 'আমার নিখিল /তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল'! সিলিকন-মূর্তি অতিক্রম করে তাই দাম্পত্যপ্রেমের দৃষ্টান্তের মূর্তি হয়েই বেঁচে থাকল, বেঁচে থাকবে তাপস-ইন্দ্রাণীর ভালোবাসার এই উচ্চারণ। তাপসের নিখিলে এখন আর মূর্তি কই? এ তো সাক্ষাৎ ইন্দ্রাণীই!