`খুব ভাল গাইস, কিন্তু বিক্রি হইব না`, সুবিনয়ের গান শুনে বলেছিলেন দেবব্রত!
`সরস্বতীর বরপুত্র` সুবিনয় রায়ের জন্মশতবর্ষ আজ।
সৌমিত্র সেন
নিবিড় বনপথে যেন ঝরনার নিভৃত শব্দগান। রবীন্দ্রগানের পৃথিবীতে নানা পুরুষকণ্ঠের জয়জয়কারের মধ্যে সুবিনয় রায় এমনই একক। অথচ অমোঘ।
সেই একক-অমোঘ বিরল কণ্ঠের অধিকারী মানুষটির আজ, এই ৮ নভেম্বর জন্মদিন। এবং শুধু জন্মদিনই নয়। দিনটি শিল্পীর জন্মশতবর্ষের উদযাপনলগ্নও।
১৯২১ সালের আজকের দিনে জন্ম উত্তর কলকাতার বিধান সরণিতে এক ব্রাহ্ম পরিবারে। শান্তিনিকেতনে রসায়ন পড়ছিলেন। কিন্তু সেখানে অন্যতর রসের টানে ভেসে গেলেন। শৈলজানন্দ মজুমদারের শিষ্য হয়ে শুরু হল তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতসাধনা। পরে খুব মন দিয়ে রাগসঙ্গীতও শিখেছিলেন।
প্রথম দিকে সুবিনয় গান শেখাতেনই বেশি। রবীন্দ্রগানের খাঁটি 'ফর্ম' ঠিক কী, এটা জানতে শিক্ষানবিশিরা তাঁর ওপর ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন। শুধু কি তরুণ ছাত্রেরা? শোনা যায়, স্বয়ং পঙ্কজ মল্লিকও কিছু কিছু গান তাঁর তত্ত্বাবধানে রেকর্ড করেছিলেন।
১৯৪৩ (মতান্তরে ১৯৪৬, ১৯৪৯ সালে) সালে সুবিনয়ের প্রথম রেকর্ড বেরোয়-- 'তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে', 'এই করেছ ভালো'। ইতিহাস বলছে, খুব বেশি সাড়া পড়ে যায়নি সেই গানে।
কেন? কালে-কালে যিনি দেবব্রত-হেমন্তের সঙ্গে এক বন্ধনীভুক্ত হবেন, তাঁর ক্ষেত্রে তো 'এলাম-দেখলাম-জয় করলাম'ই স্বাভাবিক ছিল! ছিল হয়তো। কিন্তু হল না যে, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন শিল্পীর কনিষ্ঠ পুত্র সুরঞ্জন রায়। তিনি বলছেন, 'বাবার গান তো কণ্ঠপ্রধান নয়, গায়কিপ্রধান। তাঁর গানের চলন মেজাজ, রস ও নান্দনিকতার সঙ্গে পরিচয় ছিল না বাঙালি শ্রোতার। একটু শিক্ষিত শ্রোতার জন্যই গাইতেন বাবা। তাই প্রথম দিকে বাঙালি তাঁর গান নিতে পারেনি।'
আসলে তখন তো রবীন্দ্রগানে একটাই আবহ। পঙ্কজ মল্লিক। তাঁর ওই জোয়ারি কণ্ঠের রসে ও টানে তখন ভেসে যাচ্ছেন রবীন্দ্রগানপ্রেমী বঙ্গজন। ফিল্মেও পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রবিঠাকুরের গান। নতুন যাঁরা গাইতে আসছেন, তাঁরাও সচেতন বা অচেতন ভাবে ওই ধাঁচটাকেই নিচ্ছেন।
এ দিকে সেই ধাঁচার মধ্যে এক মূর্তিমান ব্যতিক্রম সুবিনয়। শীলিত উচ্চারণে, তীক্ষ্ণ স্বরক্ষেপে, তাল-লয়ের নিখুঁত ছন্দে সুবিনয়ের গান যেন অন্য এক সাধনললিত শান্ত পৃথিবীর রবি-গান। তাঁর 'বহে নিরন্তর', 'এ কি সুন্দর শোভা', 'সংশয়তিমিরমাঝে', 'তব প্রেমসুধারসে', 'বসে আছি হে', 'জাগে নাথ জোছনারাতে'-- একটা অন্য সাঙ্গীতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের কথা বলে। একটা অন্য আবেগ ও বেদনের মেদুরতা ডেকে আনে।
তাঁর গান বাঙালির না-নেওয়ার ব্যাপারে নাকি অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছিলেন স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাস। সুরঞ্জনবাবুই জানাচ্ছেন, সুবিনয়ের 'বহে নিরন্তর' শুনে দেবব্রত বলেছিলেন-- 'খুব ভাল গাইস, কিন্তু বিক্রি হইব না'!
না, নিশ্চয়ই নিছক মজাই ছিল সেই বক্তব্যে। কেননা, শিল্পীর গান মানুষ নিলে তবেই তো তা বিক্রি হবে। বিক্রি হয়েওছিল বিপুল। ৭০-৮০ দশকের পর থেকে সুবিনয়ের গান নিয়ে বাঙালি স্পর্শকাতর হয়ে পড়ল। খুঁজে খুঁজে শুনতে লাগল তাঁকে।
কেননা, তাঁর কণ্ঠের মধ্যে রসের এমন একটা উত্তাপ ও উদযাপন থাকে যে, কলরোলহীন কোনও নিভৃতলগ্নে শ্রোতার একেবারে মর্মে গিয়ে লাগে সেই সুর। এ ব্যাপারে সুরঞ্জন একেবারে তাঁর ব্যক্তিগত এক স্মৃতির কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, 'আগ্রা ঘরানার রবি কিচলু বাবার গান শুনে আমাকে বলেছিলেন, তোমার বাবা সরস্বতীর বরপুত্র, ওঁর ওপর সরস্বতীর আশীর্বাদ রয়েছে।'
নিশ্চয়ই তাই। না হলে, প্রথম জীবনে যিনি শুধুই একজন সঙ্গীতশিক্ষক, পরবর্তীক্ষেত্রে তিনি একজন অসংবাদিত সঙ্গীতসাধক হিসেবে পরিচিত হন কীভাবে? কী ভাবে তাঁর গানের নিবিড় উচ্চারণ ও বোধ, নিভৃত অনুভব ও দর্শন কাব্যগীতিতে অনুকরণহীন এক অম্লান ঐতিহ্য তৈরি করে দিতে পারে!
আরও পড়ুন: অমিত-সঙ্গের পরে হঠাৎই ঘরের 'বন্ধু' বিভীষণ!