পজিটিভ ভাবুন, পজিটিভে আসুন...
ইতিমধ্যে `কাফে পজিটিভ`-এ রীতিমতো ভিড় জমাতে শুরু করেছেন শহুরে কফি প্রেমীরা। কফির কাপে তুফান তোলার পাশাপাশি কেক, কুকিজ, বার্গার, পেস্ট্রিতেও কামড় বসাচ্ছেন নবীন-প্রবীণরা।
কমলিকা সেনগুপ্ত
কাফে পজেটিভ! এইচ.আই.ভি পজিটিভ! হ্যাঁ...হ্যাঁ, ক্যাফেটেরিয়া এবং এইডস, দুটির কথাই বলছি। কিন্তু, কেন বলছি সেটাই হল প্রশ্ন।
এমনিতে 'পজেটিভ' শব্দটা যতটা আশা দেয় বা উজ্জিবীত করে, ঠিক ততটাই মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ার অনুভূতি এনে দেয় যদি সামনে বসে 'এইচ.আই.ভি'! 'এইচ.আই.ভি পজেটিভ'- ব্যাস, এই শব্দবন্ধই জীবনে দাঁড়ি টেনে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। না, মৃত্যু একেবারে দোরগোড়ায় কি না, সেটা বড় কথা নয়। এইচ.আই.ভি পজেটিভ হওয়া মানে তো বেঁচে থাকার অধিকারই হারিয়ে ফেলা। কি তাই তো? আচ্ছা, আর যদি এই 'এইচ.আই.ভি পজেটিভ'- পরিচয়টাকে স্রেফ পাত্তা না দিয়ে জমিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে কেউ, তাহলে? তাহলে নিশ্চই মানবেন, এই দুনিয়ার 'মোস্ট পজিটিভ' তিনি বা তাঁরাই।
গল্পটা খুব সহজ। তবে, গল্প না বলে গল্প হলেও সত্যি বলাই শ্রেয়। কারণ স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কলকাতা শহরের বুকে যোধপুর পার্ক এলাকায় পথ চলা শুরু করেছে একটা কাফে। আর এই কাফের মালিক থেকে কর্মী, প্রত্যেকই এইচ.আই.ভি পজেটিভ। ব্যাস, এটুকুই। তাই তো বললাম, গল্পটা খুব সহজ। কিন্তু সেই অমোঘ বাণীটি মনে রয়েছে তো, "সহজ কথা যায় না বলা সহজে"। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তাই, এই 'সহজ' কাজটি করতে গিয়ে রীতিমতো বাধার পাহাড় ডিঙাতে হয়েছে স্বপ্ন দেখা চোখ গুলোকে।
আনন্দ ঘর হোম। এইডস আক্রান্তদের একটি হোম। রাজ্যের নানা প্রান্তের এইচ.আই.ভি পজেটিভ শিশু কিশোররাই এই হোমের আবাসিক। সাধারণত, এঁদের বাবা-মায়েরা পাড়া পড়শিদের বলতেও চান না তাঁদের সন্তানদের কথা। কেউ প্রশ্ন করলে সাধারণত বলেন, "ওই কলকাতার এক বোর্ডিয়ে থেকে লেখাপড়া করছে"। মা-বাবাই যাদের পরিচয় দিতে পারেন না সেইসব কিশোর-কিশোরীদের নিয়েই কিছু একটা করার কথা ভাবছিলেন হোম কর্তা কল্লোল ঘোষ। কল্লোলবাবু ভেবেছিলেন, একটা কাফে চালু করা গেলে এইসব ছেলে মেয়েদের জীবনের মূল স্রোতে নিয়ে আসা যাবে। কিন্তু, কাজে নামতেই বুঝলেন বাস্তব পরিস্থিতি।
এমনিতে এইডস নিয়ে সচেতন দেশের সংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা। এইডস আক্রান্তদের স্পর্শ করলে যে কোনও ভাবেই রোগ ছড়ায় না, সে সবও জানে শিক্ষিত শহুরে বাঙালিরা। কিন্তু তবু শহরের বুকে কাফে চালু করার জন্য ১২০ বর্গফুট জায়গা পেতে কল্লোল ঘোষের সময় লেগেছে ছয় মাস। কল্লোলবাবু বলছেন, "(দোকানের জায়গা খুঁজতে গিয়ে) আমি ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ ছয় জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়েছি। সকলেই ভাবছে, মানুষটা পাগল না কি! হঠাত্ কোনও কারণ নেই, এইচ.আই.ভি. পজিটিভ বাচ্চাদের জন্য কাফে খুলবে! এমনকী, এগ্রিমেন্টের ড্রাফটিং পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, জানেন তো, আমাদের যৌথ সম্পত্তি, সকলে রাজি হচ্ছে না"। পরের পর বাধা যখন চোখের সামনে থেকে আকাশকে আড়াল করেছে, ঠিত তখনই এগিয়ে এসেছেন কল্লোল ঘোষের এক বন্ধু। তিনি নিজের গ্যারাজের তালা খুলে দিয়েছেন। সেখানেই, ১২০ বর্গফুটে পথ চলা শুরু করেছে 'কাফে পজিটিভ'। আরও পড়ুন- ওয়ার্ল্ড IQ টেস্টে শীর্ষস্থানে কলকাতার ছেলে অমিত
সব বাধা পেড়িয়ে দোকান তো খোলা গেল। কিন্তু, খরিদ্দার আসবে তো! প্রাথমিকভাবে এমন সংশয় থাকলেও, অচিরেই তা ভুল প্রমাণ হয়েছে। ইতিমধ্যে 'কাফে পজিটিভ'-এ রীতিমতো ভিড় জমাতে শুরু করেছেন শহুরে কফি প্রেমীরা। কফির কাপে তুফান তোলার পাশাপাশি কেক, কুকিজ, বার্গার, পেস্ট্রিতেও কামড় বসাচ্ছেন নবীন-প্রবীণরা। নিজেদের স্বপ্নের এমন সফল উড়ানে এতদিনের করুণ মুখগুলো আজ ঝকঝক করছে। আরও পড়ুন- ‘মা বলেছিলেন, এখনও না ঘুরে দাঁড়ালে, আর কবে দাঁড়াবি’?
কি ভাবছেন, আমার-আপনার মতো রোজকার জীবনের 'নেগেটিভিটি' বা 'পেসিমিজম'-এ মিইয়ে যাওয়া প্রাণগুলির উচিত ওই 'পজিটিভিটি'র মৌতাতে নিজেদের একটু সেঁকে নেওয়ার? মনে হলে যেতেই পারেন। আর হ্যাঁ, ওদের মূল মন্ত্রটা জানেন তো, "পজিটিভ ভাবুন, পজিটিভে আসুন"। তবে, ক্যাফে পজিটিভ-এ পৌঁছতে না পারলেও, অন্তত চলুন পজিটিভ ভাবি...