দুইটি কুসুম বোধ হয় এক ঝরা স্বপ্নই! এখন একই বৃন্তে ঢিসুম-ঢিসুম হিন্দু-মুসলমান
`রাজসিংহ` উপন্যাসের উপসংহারে গ্রন্থকারের নিবেদন অংশে বঙ্কিমচন্দ্র কতদিন আগেই সেই অমোঘ কথাটি বলেছিলেন: `হিন্দু হইলেই ভাল হয় না, মুসলমান হইলেই মন্দ হয় না, অথবা হিন্দু হইলেই মন্দ হয় না, মুসলমান হইলেই ভাল হয় না। ভাল মন্দ উভয়ের মধ্যে তুল্যরূপেই আছে।`
সৌমিত্র সেন
সাদেক আলি, জাহাঙ্গির আলিদের সঙ্গে কাজি নজরুল ইসলামের কোনও মিল আছে?
না, মিল থাকবেই-বা কেন?
কাজি নজরুল বিশ শতকের এক শক্তিমান কবি, এক অনন্য গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক, অভিনেতা আরও কত কিছু। এই সাদেক বা জাহাঙ্গির কারা? কী এঁদের পরিচয়?
হ্যাঁ, পরিচয় কিঞ্চিৎ পাওয়া গিয়েছে বইকি! খবরপাগল লোকজনদের কেউ কেউ এতক্ষণে তা জেনেও ফেলেছেন। এঁরা হলেন মালদহের দুই স্কুল শিক্ষক। সাদেক মালদহের কৃষ্ণপুর মাদ্রাসা শিক্ষা কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক। জাহাঙ্গির মালদহের শ্রীরামপুর মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক। ব্যক্তিগত জীবনে এঁদের প্রতিভা কিছু থেকে থাকলেও তার দ্বারা সমাজে এঁরা এখনও পর্যন্ত পরিচিত নন। এঁরা পরিচিত শিক্ষক হিসেবেই। অতএব, নজরুলের সঙ্গে এঁদের কোনও মিলই নেই!
মিল অবশ্য কিছু মিলেছে। কাজি নজরুল আর এই দুই শিক্ষক সকলেই জাতিগত ভাবে মুসলিম।
না, এর চেয়েও সাঙ্ঘাতিক মিল পাওয়া গিয়েছে সম্প্রতি।
গতকাল মালদহ থেকে এই দুই শিক্ষক আরও জনাছয়েক শিক্ষকের সঙ্গে কলকাতার বিকাশ ভবনে শিক্ষাসংক্রান্ত কিছু কাজে এসেছিলেন। এবং কাজের অবসরে বিশ্রামের জন্য আগে থেকেই সল্টলেক এলাকার গেস্ট হাউসের ঘর বুকিং করে রেখেছিলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, ঘর নিতে গিয়ে তাঁরা দারুণ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়লেন। তাঁদের একরকম প্রায় তাড়িয়েই দেওয়া হল সেখান থেকে। বলা হল, ঘর মিলবে না! কেন? পরিষ্কার করে না হলেও ঠারে-ঠোরে তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হল, জায়গা মিলবে না কারণ, তাঁরা মুসলিম!
ঠিক এখানেই নজরুলের সঙ্গে মিল তাঁদের। নজরুল একবার এক পরিচিতের বাড়িতে আমন্ত্রিত ছিলেন। সেখানে খাওয়ার সময়ে তিনি যখন পঙক্তিতে বসতে যাবেন, তখন সমবেত হিন্দু লোকজন তাঁর সঙ্গে একই পঙক্তিতে বসে খেতে অস্বীকার করেন। ঘটনার নগ্নতায় ও আকস্মিকতায় স্তম্ভিত ব্যথিত দুঃখিত নজরুল সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এবং বাড়ি ফিরেই লিখে ফেলেন তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা যেখানে জাতের নামে বজ্জাতির উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
কেন এরকম হল?
সাধারণ মানুষ থেকে বুদ্ধিজীবী সকলেই বুঝতে পারছেন এবং কেউ কেউ বলছেনও যে, এ রাজ্য থেকে হাড় হিম করে দেওয়া আল কায়দার জঙ্গির যোগাযোগের খবর পাওয়ার পরেই একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি সকলের স্পর্শকাতরতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। সন্দেহ বেড়ে গিয়েছে। ঘৃণা বেড়ে গিয়েছে। ফলে সেই সম্প্রদায়ের লোকজন দেখলেই অন্যেরা ভীষণ প্রতিকূল একটা আবহাওয়া তৈরি করে ফেলছেন। হয়তো, ঠিকই কথাগুলি। কিন্তু খুব ঠিক কী?
আচ্ছা, এ-লেখা যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের কি মনে পড়ছে, কদিন আগেই বিখ্যাত একটি ফুড ডেলিভারি সংস্থার এক মুসলিম ডেলিভারি বয়কে ওই ফুড ডেলিভারি সংস্থার এক গ্রাহক সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন শুধু ছেলেটির জাতিপরিচয়ের কারণেই? খুব কষ্ট করতে হবে না। দেখবেন, একটু খুঁটিয়ে ভাবলেই এরকম ঘটনা পরপর মনে পড়ে যাবে। এ বার আপনি ভাবতে থাকুন, এই রকম যত ঘটনা ঘটে, তার আগে কি প্রত্যেক বারেই এরকম জঙ্গি-কাণ্ডও ঘটে যায় একটা-একটা করে কোথাও-না-কোথাও?
না, না, খুব সম্ভবত তা নয়। খবর অত সেট-স্ট্রাকটার মেনে ঘটে না। যা ঘটে, আসলে সেটাই তো খবর। ঘটনার ওপর কি সব সময় নিয়ন্ত্রণ থাকে? বিশেষত এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে? যে মনোভাব গণপরিসরে স্বাভাবিক, সহজাত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই মনোভাবকে তো আর আলাদা করে নিয়ন্ত্রণ করে ঘটাতে হয় না! তা আপনিই ঘটে যায়, কারণ, এক শ্রেণির মানুষ তার মনের অন্ধকারকে সরাতে পারে না, মুছতে পারে না, ফলে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো সে এই সব প্রতিবর্তক্রিয়াগুলি ঘটিয়ে ফেলে। আর এরকম যখন ঘটে, তখন কবি নজরুলও যা, সাদেক আলি জাহাঙ্গির আলিরাও তাই হয়ে দাঁড়ান।
অথচ, এমনটা কি কথা ছিল? হিন্দু-মুসলিম পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আমরা তো কম ভাবিনি। কম স্পষ্ট করে বলিনি।
'রাজসিংহ' উপন্যাসের উপসংহারে গ্রন্থকারের নিবেদন অংশে বঙ্কিমচন্দ্র কতদিন আগেই সেই অমোঘ কথাটি বলেছিলেন: 'হিন্দু হইলেই ভাল হয় না, মুসলমান হইলেই মন্দ হয় না, অথবা হিন্দু হইলেই মন্দ হয় না, মুসলমান হইলেই ভাল হয় না। ভাল মন্দ উভয়ের মধ্যে তুল্যরূপেই আছে।' এর চেয়ে স্বচ্ছ চাঁছাছোলা বক্তব্য আর কি আছে কোথাও (হিন্দুপন্থী এবং মুসলমানবিদ্বেষী হিসেবে যাঁরা বঙ্কিমকে আজকাল তুলে ধরতে চান তাঁরাও আশা করি একটু ভাববেন)?
স্বামী বিবেকানন্দও হিন্দু-মুসলিম নিয়ে ভেবেছেন। এই দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক ব্যবহার নিবিড় ভাবে দেখেছেন। তিনি তাঁর লেখায় খুব জরুরি একটা কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন: 'ইসলাম যেখানেই পৌঁছেছে সেখানকার আদিম নিবাসীদের রক্ষা করেছে। তাদের ভাষা ও তাদের সত্তাও রক্ষা করেছে।' কিন্তু তার পরেও মুসলিমমাত্রই যে ধ্বংসকামী নয়, এ বিশ্বাস আমাদের জন্মাল না। বিবেকানন্দ যে-গৌরবান্বিত ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেখানে ছিল বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামি দেহের একযোগ সহায়তা। তিনি বিভিন্ন সময়ে ইসলামের সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। অথচ, এত কিছুর পরেও আমাদের চেতনা জাগেনি।
রবীন্দ্রনাথও হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে সারা জীবন ধরে ভেবেছেন। নানা জায়গায় নানা ভাবে এই দুই সম্প্রদায়ের বিভেদ মুছে কী ভাবে মিলন সম্ভব সেই আশা ও ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তিনি অবশ্য এই দুই সম্প্রদায়ের সদা-কলহের একটা কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর এক চিঠিতে: 'ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা, অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ।' তবে তিনি অবশ্য আশার কথাও সেখানে শুনিয়েছেন। লিখেছেন: 'হিন্দু-মুসলমানের মিলন যুগ পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে। ..... গুটির যুগ থেকে ডানা মেলার যুগে বেরিয়ে এসেছে। আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসব।'
কবি লিখলেন বটে, আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসব! কিন্তু কবে তা? চির-ইপ্সিত সেই মিলন হবে কতদিনে? গুটির যুগ কি তবে চলছেই? ডানা অন্ধ-বন্ধ করে দিয়ে আর কতদিন আমরা অসহযোগিতার, অসামাজিকতার, অসভ্যতার এই নিভৃত নিবিড় সাধনা চালিয়ে যাব? তত দিন কিন্তু সাদেক-জাহাঙ্গিরদের মুক্তি নেই। সম্মান নেই। গৌরব নেই। ওঁদের কপালে ততদিন শুধুই নীরস নিঠুর তির্যকতা।