শুভঙ্কর রায়


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

'স্পর্ধাবর্ণ' প্রযোজনার শুরুতে পর্দা উন্মোচনের পর দেখা যেত, মঞ্চে প্রবেশ করছেন একজন মানুষ। হাতে বাগানের তদারকির সরঞ্জাম। চলনে ক্লান্তি, কিন্তু দৃষ্টিতে একটা অস্থিরতা। প্রতীক্ষাপর অস্থিরতা। খুব ধীরে ধীরে উদ্যানচর্চার প্রয়োজনীয় বস্তুগুলি ভদ্রলোক অভ্যাসমতো রাখতে থাকেন যথাস্থানে। আর বারবার তার অস্থির দৃষ্টি ফিরে ফিরে যায় সদর দরজার দিকে। একটা সময় পর খানিক আশাভঙ্গের বেদনায় ভারাক্রান্ত চোখে তিনি এগোতে থাকেন লেখার টেবিলে। টেনে নেন কাগজ ও কলম। কলম চলতে শুরু করে। কিন্তু তখনও অশান্ত তাঁর শরীরী অভিব্যক্তি। এইভাবে কয়েক মুহূর্ত কাটে। ক্রমশ দেখা যায় কলমে ভর করে মনোযোগ সহকারে লেখায় ডুবে যান ভদ্রলোক। কিছু সময় লেখা এগোনোর পর সদর দরজায় উপস্থিত হন এক ব্যক্তি। লেখায় মগ্ন ভদ্রলোক উপস্থিত ব্যক্তির কণ্ঠ শুনে তাকান দরজার দিকে। তারপর এতক্ষণের ক্লান্তিশিথিল ভঙ্গিমা ছেড়ে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে যান সদর দরজায় আগন্তুককে অভ্যর্থনা জানাতে। বোঝা যায়, আগন্তুক ভদ্রলোকের প্রত্যাশিত ব্যক্তি-যার জন্য এতক্ষণ তিনি ছিলেন অপেক্ষারত। এই বিবৃত ঘটনাবলীর অভিনয় উপস্থাপিত হতে সময় নিত মঞ্চভেদে চার থেকে ছয় মিনিট। সম্পূর্ণ অভিনয়টি ছিল সংলাপহীন। মঞ্চে এই দীর্ঘ নীরবতা বাঙময় হয়ে উঠত যাঁর অভিনয় গুণে তিনি বাচনশৈলীর স্বাতন্ত্র কিংবদন্তি বাংলার মঞ্চাভিনেতাদের অন্যতম একজন- দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়। বাচন যেখানে সীমাবদ্ধতায় দুর্বল, অভিব্যক্তি  তখন কতখানি কথনচঞ্চল হয়ে উঠতে পারে তার নির্দশন তৈরি করেছিলেন দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় 'স্পর্ধাবর্ণ'-এর আরম্ভ দৃশ্যে। ব্যক্তিগত জীবনে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় সরস চিন্তানন্দিত বাচনে শ্রোতার আগ্রহ আকর্ষণকারী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ২০১৬ সালের ২ রা জানুয়ারি তিনি স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর বিপর্যস্ত হয়ে যায় তাঁর মস্তিষ্কের স্মৃতিপ্রক্রিয়া। হারিয়ে যেতে থাকে চিন্তাসূত্র আর প্রিয় শব্দের দল। তবুও উপস্থিতির উষ্ণতায় তিনি পূরণ করে রাখতেন তাঁর চারপাশ, স্নাত করাতেন পার্শ্ববর্তীদের। ঠিক যেমন অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন দর্শকরা 'স্পর্ধাবর্ণ'-এর প্রথম দৃশ্যে। অবসাদ এবং অস্থিরতার দ্বান্দ্বিক বিক্ষোভের অভিনয়ে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিব্যক্তির চলমানতায় দর্শক টের পেয়ে যেতেন কী আছে বক্ষ্যমাণ। দর্শককে এভাবে প্লাবিত করার 'অভিনয়ের মন্ত্র' অর্জন করেছিলেন দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়। 'অভিনয়ের আমি' শীর্ষক প্রবন্ধে দ্বিজেনবাবু তাঁর সেই 'অভিনয়ের মন্ত্র' প্রকাশ্যে জানিয়ে লিখেছিলেন, অভিনেতা "শুধু একটি চরিত্রের কাহিনি বলে না- দর্শককে নিজের অবস্থানের কথাও মনে করিয়ে দেয়। এই অভিনয় মন্ত্র আমি কখনও ভুলিনি। চেষ্টা করেছি নিজের কায়দা না দেখিয়ে দর্শকের ভালবাসার মানুষ হয়ে উঠতে চরিত্রায়নের মাধ্যমে।" মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রের দর্শককুলের ‘ভালবাসার মানুষ’ এই অভিনেতা প্রয়াত হয়েছেন গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।



১৯৪৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। তাঁ পিতা ডাক্তার সুধীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ। ১৯৭২ সালে সুব্রত নন্দী নির্দেশিত থিয়েটার ফ্রন্ট-এর প্রযোজনা ‘বাগবন্দী’-তে দ্বিজেনবাবুর প্রথম মঞ্চাভিনয়। ক্রমশ তিনি ‘থিয়েটার কমিউন’ নাট্যদলে নীলকণ্ঠ সেনগুপ্তর পরিচালনায় অভিনয় করেন ‘কিং কিং’ এবং ‘দানসাগর’ নাটকে। শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় ‘গালিলেওর জীবন’ এবং ‘দশচক্র’ প্রযোজনায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা যায় তাঁকে। অসিত মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় অভিনয় করেন ‘কুমারসম্ভব’, ‘ঘোড়া’, ‘ভস্ম’, ‘নীলাম নীলাম’ প্রভৃতি নাটকে। ‘শূদ্রক’ প্রযোজনা ‘অমিতাক্ষর’ নাটকে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় যেমন বহুলভাবে প্রশংসিত হয়েছিল একইসঙ্গে দ্বিজেনবাবু অভিনয়ের একটি বিশিষ্ট ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই প্রযোজনার মাধ্যমে। সলিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘সাদা ঘোড়া’ বা বিভাস চক্রবর্তী পরিচালিত ‘বলিদান’, ‘গিরগিটি’, ‘গাজিসাহেবের কিসসা’ প্রভৃতি নাটকে দ্বিজেনবাবু তাঁর অভিনয় দক্ষতার প্রদর্শনে দর্শককে উদ্বেল করেছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘প্রাণতপস্যা’, ‘কুরবানি’, ‘আরোহণ’, ‘তৃতীয় অঙ্ক, অতএব’, ‘ছাড়িগঙ্গা’ প্রভৃতি প্রযোজনায় দ্বিজেনবাবুর অভিনয় দর্শকের মানে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে থাকবে।



দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজের নাট্যসংগঠন ‘সংস্তব’-এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৮২ সালে। এই দলের ১৯৯৩ সালের প্রযোজনা ‘মুষ্ঠিযোগ’ বাংলা রঙ্গমঞ্চে ইতিহাস তৈরি করে। ‘মুষ্ঠিযোগ’-এর নাটককার মোহিত চট্টোপাধ্যায় এবং দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়-এই জাদুকর জুটি  পেয়েছিল বাংলা থিয়েটার। যার শুরু ‘সুন্দর’-এ; ক্রমান্বয়ে এসেছে ‘মুষ্ঠিযোগ’, ‘তুষাগ্নি’, ‘অক্টোপাস লিমিটেড’, ‘এই ঘুম’, ‘ভূতনাথ’ প্রভৃতি। দ্বিজেনবাবুর নির্দেশিত সর্বেশষ পূর্ণাঙ্গ এবং একাঙ্ক প্রযোজনা দুটিরই নাটককার মোহিত চট্টোপাধ্যায়। প্রথমটি একুশ শতক-এর প্রযোজনা ‘নিষাদ’ আর দ্বিতীয়টি ‘বর্ণপরিচয়’ সংস্তব অভিনয় করে অন্য থিয়েটার আয়োজিত নাট্যস্বপ্নকলা- ২০১৫-য়।


আরও পড়ুন- পি.এম.বাগচি ও সেই সময়কার কলকাতা


নাট্যজগতে অভিনেতা এবং পরিচালকরূপে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় চার দশকেরও বেশি সময় মানুষকে মোহিত করে রেখেছিলেন। নাট্যের পাশাপাশি ধারাবাহিক এবং চলচ্চিত্রেও আমরা দেখেছি তাঁর মেধাবী উপস্থিতি। ‘আবার যখের ধন’, ‘চুনিপান্না’, ‘দত্ত বাড়ির ছোট বৌ’ কিংবা ‘লাবণ্যের সংসার’ প্রভৃতি ধারাবাহিকে অভিনয়ে তিনি দর্শকের কাছে হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয়। আবার তরুণ মজুমদারের ‘ভালোবাসার বাড়ি’, ‘চাঁদের বাড়ি’; সন্দীপ রায়ের ‘গোরস্থানে সাবধান’, ‘যেখানে ভূতের ভয়’, ‘বাদশাহী আংটি’, অভিজিত্ গুহ ও সুদেষ্ণা রায়ের ‘বেঁচে থাকার গান’; শৈবাল মিত্রের ‘শজারুর কাঁটা’; সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘অটোগ্রাফ’ এবং ‘জাতিস্মর’-এ দ্বিজেনবাবুর মননশীল অভিনয় তাঁকে করে তুলেছিল ‘দর্শকের ভালোবাসার মানুষ’।



যে কোনও মাধ্যমেই অভিনেতা দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের সাদর প্রশংসা পেয়েছিলেন তাঁর সহজ অভিনয় শৈলীর কারণে। চরিত্র নির্মাণের সময় তিনি ম্যানারিজম বা ভঙ্গি আরোপর্ণের জনপ্রিয় পথগুলি সচেতনভাবেই পরিত্যাগ করতেন। তাঁর চরিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল চরিত্রের ‘ভিতরের মানুষটিকে’ আবিষ্কার করা। এই আবিষ্কার প্রক্রিয়ায় দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় মগ্ন মননশীল প্রয়াসে সাবলীলভাবে প্রবেশ করে যেতেন চরিত্রটির সত্তার অন্তরমহলে। ব্যক্তিগত প্রবণতাগুলি অতিক্রম করে তিনি আয়ত্ত করে নিতেন চরিত্রের যথাযথ এবং মানানসই বৈশিষ্ট্য বা ঝোঁকগুলি। ফলত তাঁর অভিনীত চরিত্ররা অবলীলায় দর্শকের দেখাশোনার অভিজ্ঞতার সহচর হয়ে যেত। অভিনেতার পৃথক অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয়ে দর্শকের কাছে অভিনেতা দ্বিজেনবাবু এবং তাঁর অভিনীত চরিত্র হয়ে উঠত সহ-জ। এমনই সহজ অভিনয়ের গুণে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট সেইসব চরিত্ররা দর্শকের স্মৃতিতে ‘ভালোবাসার মানুষ’ রূপেই থেকে যাবে। 


আরও পড়ুন- আদর্শ শঙ্কর, দুর্গমকে সুগম করাই প্যাশন অভিযাত্রী অনিন্দ্যর