সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ইদ'। লিখেছিলেন নজরুল ইসলাম। কিন্তু গত বছর থেকেই ইদ আর সে-অর্থে 'খুশির' হচ্ছে কই! চারিদিকে করোনার বিষাক্ত নিশ্বাস। নানা কড়াকড়ি, বিধিনিষেধ, সুরক্ষাকবচ। এ বারে করোনা ভারতেই সব চেয়ে নিষ্ঠুর রূপে দেখা দিয়েছে। ফলে ইদ নিয়ে এবারেও নানা বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে। ইদ উল-ফিতর আসলে তো একটি গভীর প্রার্থনা, যা সাধারণত খোলা স্থানে বা বিরাট ঘরে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু করোনার কারণে হয়তো এবছরও তা ওইভাবে হওয়ার নয়। হয়তো যা হবে, তা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই করা হবে।


ইদ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিধিনিষেধ জারি হয়েছে মহারাষ্ট্রে। আরবে যদিও পিছিয়ে গিয়েছে ইদ। ওদিকে প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল সংঘাত চলছে এই 'খুশির' ইদের আবহেই। 


না। তবু উৎসবের মাধুর্য, যা দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ত বাগানে পাকা ফলের ত্বকের মতো নিবিড় উজ্জ্বলতায় ভরে দেয় মন, সেই উৎসব কখনও পুরোপুরি পরাজিত হয় না। হয়তো বিধিনিষেধের কবলে পড়ে তার বাহ্যিক আচারে-অনুষ্ঠানে কিছু ব্যত্যয় ঘটাতেই হয়, কিন্তু তার অন্তরাত্মায়  দীপ্ত থাকে বহুজনের অংশগ্রহণের নিহিত উষ্ণতা, থাকে সহমর্মিতা ও সংযোগের নতুনতর প্রতিজ্ঞা। 


আরও পড়ুন: Netaji Subhash Chandra Bose: কলকাতা টু কোহিমার দীপ্তিমান পথরেখাকে প্রণাম


তাই কবিবাক্য ব্যর্থ হয় না। একমাস উপবাসকঠিন নিরবচ্ছিন্ন সাধনার শেষে প্রতিটি ভক্তিমান মুসলমান তাই এই ইদের দিনটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। বসে থাকেন চাঁদের দিকে তাকিয়েও। চাঁদ নিয়ে হয়তো সাময়িক একটা অস্থিরতা তৈরি হয়। তবু চাঁদ আসে। মসজিদের নিটোল গম্বুজের পিছন থেকে উঁকি দেয় সে। গ্রীষ্মবাতাসের উষ্ণসন্ধ্য়ায় বা ঝড়মাতাল গোধূলিক্ষণ পেরিয়ে হয়তো সে দেখা দেয়। নতুন চাঁদ দেখা মাত্র পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় খুশির বার্ত--'ইদ মোবারক'। রমজান মাসের ২৯তম দিনের পর যদি আকাশে পবিত্র চাঁদের দর্শন না হয়, তা হলে তার পরের দিন ইদ পালিত হয়। 


চাঁদ দেখা দেয় আর সমস্ত মালিন্য, ক্ষত, আঘাত, রক্তস্রোত, ব্য়র্থতা ও বেদনার উপর ঝরে পড়ে তার মদির জ্যোৎস্না। আর তখনই মানুষ ডাক শোনে-- তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।/ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ইদ! এই ইদ খুশির, কেননা এদিনই তো সব দ্বেষ-বিদ্বেষ ভুলে যাওয়ার লগ্ন--আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,/ তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।/ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ইদ।


বলা হয়, এই উৎসবের সূচনা করেছিলেন ইসলামের নবী হজরত মহম্মদ স্বয়ং। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত একমাস রমজানের রোজা পালনের পরে আসে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র উৎসব এই ইদ। শাওয়াল মাসে এই দিনটি পালন করেন মুসলিমরা। এই দিনে মানুষ যা কিছু পেয়েছে তার জন্য সে কৃতজ্ঞতা জানায় আল্লাকে। কোরান অনুসারে, পুণ্যার্থীদের অবশ্যই ইদের নমাজের আগে জাকাত উল-ফিতর দিতে হয়। ইদ শুরু হয় সূর্যাস্তের পরে, রাতে পবিত্র চাঁদ দর্শনের পরে। নতুন চাঁদ দেখা মাত্র পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় খুশির বার্ত--'ইদ মোবারক'।
রমজান মাসের ২৯তম দিনের পর যদি আকাশে পবিত্র চাঁদের দর্শন না হয়, তা হলে তার পরের দিন ইদ পালিত হয়। 


ইদের দিন রোজা রাখা নিষিদ্ধ। উপবাস ভেঙে আনন্দে সামিল হওয়ার লগ্ন এটা। তবে শুধু তো উপবাস নয়, যিনি রোজা রাখেন এটা তাঁর কাছে পরিচ্ছন্নতার ও পবিত্রতার মাস; আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাস; উদারতা, মহানুভবতা ও মানবতায় উদ্ভাসিত হওয়ার মাস। ফলে, প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসী মুসলমানের মনে এদিন প্রবাহিত হয় অফুরন্ত আনন্দধারা। 


হবে না-ই বা কেন? ইদ তো আনন্দেরই উৎসব। 'ইদ উল-ফিতর' এই আরবি শব্দের অর্থ-- উৎসব, আনন্দ, খুশি। 'ইদ' এসেছে মূল শব্দ 'আউদ' থেকে। এর অর্থ-- এমন উৎসব, যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়। ইদের অন্য অর্থ-- খুশি-আনন্দ-উচ্ছ্বাস। 'ফিতর' শব্দের অর্থ-- ভেঙে দেওয়া। আরেক অর্থে 'বিজয়'। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর যে উৎসব উদযাপন করা হয়, তা-ই ইদ উল ফিতর। কিন্তু কীসের বিজয়? সেটা ওই সংযমের সূত্রে। গোটা রমজান মাস রোজা রেখে মানুষ তাঁর ভেতরের সব রকমের নেতিবাচকতাকে নষ্ট করে নিজের নিকৃষ্ট-মনের উপর নিজেরই উৎকৃষ্ট-মন নিয়ে জয়ী হয়। আর তখনই তার মধ্যে থেকে ফুটে ওঠ আলো। ফুটে ওঠে জ্যোৎস্না। ফুটে ওঠে সত্যনিষ্ঠ জীবনযাপনের তাগিদ ও সদিচ্ছা। দিনটি তাই সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করারও দিন। 


ইদ ধনী-গরিব সব মানুষের মহামিলনের বার্তাও বহন করে। কেননা ইদের দিনে ধনী-দরিদ্র, বাদশা-ফকির, মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে সব মুসলমান এক সঙ্গে ইদের প্রার্থনায় অংশ নেন। এবং তখন এক মহাসাম্যের জয়ধ্বনি ওঠে আকাশে।


নজরুল তাঁর ওই ইদের গানে এদিন রূপকার্থে 'প্রেমের মসজিদ' গড়ে তোলার কথাও বলেছেন। সেটা এমনি-এমনি নয়। ওই কুলপ্লাবী সাম্য এলে, মানুষের প্রতি বিদ্বেষ মরলে তখনই তো নিভৃত অন্তরে প্রেমের মসজিদ গড়ে ওঠে। সেই প্রেমের শক্তিতে অতিমারী-যুদ্ধের রক্তচক্ষুও ম্লান হয়ে যায়। মিষ্টি করে তখনও চেয়ে থাকে নরম এক চাঁদ। 


আরও পড়ুন: 'তখন কি মা চিনতে আমায় পারো'--শিশুকবিতার এই চরণই যেন চিরসত্য রবিজীবনে!