'তখন কি মা চিনতে আমায় পারো'--শিশুকবিতার এই চরণই যেন চিরসত্য রবিজীবনে!

আজ 'মাদার্স ডে',আজ আবার '২৫ বৈশাখও'। রবীন্দ্রনাথ দিয়েই যেন জুড়ে গেল দু'টি উদযাপন।

Updated By: May 9, 2021, 03:19 PM IST
'তখন কি মা চিনতে আমায় পারো'--শিশুকবিতার এই চরণই যেন চিরসত্য রবিজীবনে!

সৌমিত্র সেন

রবীন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, 'মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তাঁর ঘরে তক্তাপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর। তাইতো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না।'

'মা' বিষয়টিকে ঘিরে একটা গভীর শূন্যতা ও দুঃখের চিহ্ন যেন বহন করে রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি। তিনি মাকে পেলেন না, কথাটা খুব সত্যি নয়, আবার মিথ্যেও নয়। সারদাসুন্দরী দেবীর সন্তানসংখ্যা ছিল পনেরো। রবি ছিলেন চোদ্দোতম। ১৮৭৫-এর ১১ মার্চ দীর্ঘ রোগভোগের পরে ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে চলে গেলেন সারদাসুন্দরী। রবির বয়স তখন তেরো বছর দশ মাস। প্রায় ১৪ বছরের কিশোরের মনে মায়ের  তীব্র উজ্জ্বল ছবিই থাকার কথা। কিন্তু পরিবারটি যেহেতু ঠাকুরবাড়ির, তাই তাদের পারিবারিক রীতিনীতিমাফিক মায়ের সঙ্গ বেশি করা হয়ে ওঠেনি শিশু-বালক-কিশোর রবির। ফলত, মা-র মুখ তাঁর চিত্তে বরাবর অস্পষ্ট আবছায়া। 

আরও পড়ুন: স্বপ্নের ভারত গড়তে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ শক্তি ও অনুপ্রেরণা দেয়: মোদী

সন্তানদের ব্যাপারে সারদাদেবীর কি ঔদাসীন্য ছিল? না, ঠিক সেকথা হয়তো বলা চলে না। সরলা দেবী চৌধুরানী লিখছেন- 'সেকালের ধনীগৃহের আর একটি বাঁধা দস্তুর জোড়াসাঁকোয় চলিত ছিল। শিশুরা মাতৃস্তন্যের পরিবর্তে ধাত্রীস্তন্যে পালিত ও পুষ্ট হত।' এই নিয়ম মেনে ছোট্ট রবিকেও মায়ের কোল থেকে যেতে হয়েছিল ধাত্রী-মায়ের কোলে। রবিঠাকুরের ধাত্রী মায়ের নাম ছিল 'দিগম্বরী' যিনি 'দিগমী' বলে পরিচিত ছিলেন। ফলে গোড়া থেকেই মা-বঞ্চিত থাকতে হয়েছিল ছোট্ট রবিকে। 

তবে সারদাসুন্দরীকে সংস্কৃত রামায়ণ-মহাভারত পড়ে শোনাবার জন্য প্রায়ই কোনো না কোনো ছেলের ডাক পড়ত। কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথেরও পড়ত। সঙ্গ বলতে হয়তো সেটুকুই। আর একটি ছবি পাওয়া যায়। 'জীবনস্মৃতি'র পাতায় আছে সেই ছবি। পড়া-থেকে রেহাই পেতে রবি পেট-কামড়ানির অজুহাত জুড়তেন মায়ের কাছে। মা হয়তো বুঝতেন, এ শিক্ষকের কাছে পড়তে না বসারই ছল। তবু তিনি শাসন করতেন না। হয়তো ওইটুকুই মাতৃস্বাদবঞ্চিত ছেলের প্রতি তাঁর করুণামিশ্রিত প্রশ্রয়। সবটা বুঝেই তিনি শুধু চাকরকে ডেকে সে দিনের মতো শিক্ষককে ফেরত পাঠাতেন।

'মা' বলতে তো এইটুকুই। কিন্তু এই ছেঁড়া-ছেঁড়া ছায়া-ছবি গেঁথে-জুড়ে এক নিটোল মাতৃমূর্তি গড়ে তোলা কি সম্ভব হয়েছিল? তা আমরা পরে দেখব।  আপাতত দেখব, ওই সামান্য মাতৃসঙ্গস্বাদটুকু কী গভীর ভাবেই-না কবির মনে রেখাপাত করেছিল। মায়ের মৃত্যুর পরে সেটা বোঝা গিয়েছিল। মায়ের মৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন-- 'প্রভাতে উঠিয়া যখন মা'র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না।' এরপর সকলের সঙ্গে শ্মশানের দিকে পা বাড়ালেন রবিও। আর তখনই রবির সহসাই মনে হল--'এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।'

মাকে ঘিরে এই হাহাকারটুকুই কবির চিরসম্বল। আর কিছু নেই, তাই হয়তো বলেছিলেন-- 'তাইতো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না'! হয়তো সেভাবে পাননি। তবু সারা জীবন তাঁর সাহিত্যে কত রকম মাতৃমূর্তি যে তিনি তৈরি করলেন! কখনও তিনি বীরপুরুষ, মাকে নিয়ে চলেছেন দূরে, কখনও তিনি মায়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেন। কখনও তাঁর উপন্যাসে আমরা 'আনন্দময়ী' মা-কে দেখি, আবার কখনও 'কর্ণকুন্তী সংবাদ' বা 'গান্ধারীর আবেদন'-এর কুন্তী বা গান্ধারী-রূপে প্রতীয়মান হয় তাঁর মাতৃকল্পনা, তাঁর একান্ত নিজস্ব মাতৃপ্রকল্প। এ যেন মা-কে ছুঁয়ে দেখা, ফিরে দেখা, স্মৃতি ও শ্রুতির সম্ভার থেকে ভারী পরদা সরিয়ে দিয়ে আপনার করে পেতে চাওয়া। কিন্তু সেই পাওয়াটা খাঁটি ভাবে ঘটে না বলে তাঁর মা-ও আর আমাদের কাছে গভীরসঞ্চারী হয়ে ধরা দেয় না!

শুধু শেষ পর্যন্ত ওই লুকোচুরিই যেন সত্য হয়ে দাঁড়ায়। 'শিশু' কাব্যের 'লুকোচুরি'
কবিতায় সেই চির-লুকোচুরির ছন্দ আমাদের আনমনা করে, পীড়িতও করে। এই পঙক্তিগুলি যেন ফিরে ফিরে বাজে ---'আমি যদি দুষ্টুমি ক'রে/চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,/ভোরের বেলা মা গো, ডালের 'পরে/কচি পাতায় করি লুটোপুটি,/তবে তুমি আমার কাছে হারো,/তখন কি মা চিনতে আমায় পারো।/তুমি ডাকো, 'খোকা কোথায় ওরে।'/আমি শুধু হাসি চুপটি করে।/যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে/সবই আমি দেখব নয়ন মেলে।/স্নানটি করে চাঁপার তলা দিয়ে/আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে;/এখান দিয়ে পুজোর ঘরে যাবে,/দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে--/তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে/তোমার খোকার গায়ের গন্ধ আসে।/সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে/যখন তুমি যাবে গোয়ালঘরে/তখন আমি ফুলের খেলা খেলে/টুপ করে মা, পড়ব ভুঁয়ে ঝরে।/আবার আমি তোমার খোকা হব,/'গল্প বলো' তোমায় গিয়ে কব।/তুমি বলবে, 'দুষ্টু, ছিলি কোথা।'/আমি বলব, 'বলব না সে কথা।'

আরও পড়ুন: সব রকম সংকীর্ণতার নাগপাশ ছিন্ন করার গ্রীষ্মসাধনই তাঁর নিজস্ব 'বৈশাখ'

.