দেবাশিস বিশ্বাস


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আমি এখন 'সামিট ফিভারে' ভুগছি। এই জ্বরটা আমার সঙ্গে সারা জীবনই থাকবে। কেননা, আমরা নেপালের আমা ডাবলাম শৃঙ্গ জয় করতে গিয়ে প্রায় মুখ থেকে ফিরে এলাম। মাত্র কয়েক মিটার পথ। তবু ফিরতে বাধ্য হলাম। খারাপ আবহাওয়ার জন্যই এটা ঘটল। এই যে, আর একটু গেলেই শৃঙ্গ জয় করা হয়ে যেত কিন্তু হল না-- এই শূন্যতার অনুভূতিটিকেই পর্বতারোহীদের ভাষায় বলে 'সামিট ফিভার'।


নেপালের অপূর্ব সুন্দর শৃঙ্গ এই আমা ডাবলাম। 'আমা ডাবলাম' মানে 'মাদার্স নেকলেস'। কেন স্থানীয় মানুষ এটিকে 'মা' বলে উল্লেখ করেন? কারণ, পর্বতটি এমন দেখতে ঠিক যেন মা দু'হাত দিয়ে আগলে রেখেছেন। সেই মায়ের হার হল এই শৃঙ্গ।



আমা ডাবলামকে দুর্গম বা কঠিন বলাটা ঠিক হবে না। কিন্তু এটুকু বলব যে, বাইশ হাজার ফুটের বেশি এই শৃঙ্গটি 'টেকনিক্যালি টাফ'। এবং এটা জেনেই আমরা বেরিয়েছিলাম। এখানে একটি 'হ্যাঙ্গিং গ্লেসিয়ার' আছে। সেখানে ঝোড়ো হাওয়া তো থাকেই। তুষারধসও ঘটে। আগে আগে এ অঞ্চলে এ সব কারণে বেশ কিছু দুর্ঘটনাও ঘটেছে। 


যাই হোক, প্রথমেই বলি, কোভিড-পর্বে আমাদের অভিযান প্রথম থেকেই নানা বাধার মধ্যে পড়েছে। পরিবহণ পাওয়ার সমস্যা তো ছিলই। ছিল কোভিড-পর্বের নতুন করে আরোপিত কিছু কড়াকড়ি ও জটিলতাও। সে কারণেও অনেকগুলি ধাপে আমাদের অনর্থক দেরি হয়ে গিয়েছে।


আমরা প্লেনের চেষ্টা করেও না পেয়ে কলকাতা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে শিলিগুড়ি যাই। সেখান থেকে পানিট্যাঙ্কি কাকরভিটা। তারপর ভদ্রপুর। এখান থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইটে কাঠমাণ্ডু। তারপর লুকলা।  লুকলা থেকেই হাঁটা শুরু। প্রথমে ফাকদিং। সেখান থেকে নামচে বাজার। এখানে একদিন থাকা। তারপরে ডেউচা। শেষমেশ আমা ডাবলাম বেসক্যাম্প। 


এই পথে কাগজপত্রের চেকিং এবং কিছু কিছু বিষয়ের নতুন করে কাগজপত্র তৈরি করতে গিয়ে আমাদের অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। কোভিড টেস্ট আমাদের করানোই ছিল। আবারও করাতে হল। সেই নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে অবশেষে আমরা বেরোলাম। এর মধ্যে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যও (যেটা এই ধরনের অভিযানেরই অংশও) আমরা বেশ কদিন ব্যয় করলাম। বেসক্যাম্প থেকেও আমরা হাঁটাহাঁটি করলাম। 'অ্যাক্লামাটাইজেশন' পুরোপুরি হল। মোটামুটি ভাবে আমাদের ধরা ছিল, আমরা ১৭-১৮ নভেম্বর নাগাদ চূড়ান্ত অভিযান শুরু করতে পারব। কিন্তু সেটাও হল না। কেননা সেই সময়ে হঠাৎই আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করল। ফলে আবারও অপেক্ষা। ভাল আবহাওয়ার খবর পেয়ে আমরা ক্যাম্প-২'র দিকে হাঁটা লাগালাম। আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৮ নভেম্বর। ক্যাম্প ২ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল।


কিন্তু তারপরই সঙ্কট। আগে এ অঞ্চলে ক্যাম্প-৩ ছিল। কিন্তু আগে যে-গ্লেসিয়ারের কথা বললাম তার জন্য সেখানে খুবই বিপদের আশঙ্কা থাকে। ফলে ক্যাম্প-৩'র অস্তিত্ব এখন আর নেই। এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন সোজা চলে যেতে হয়। আমাদেরও তাই করতে হল। ২৮ নভেম্বর রাত ১০টা নাগাদ আমাদের বেরনো। ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ আমি ক্যাম্প-৩'র আওতায় পৌঁছলাম। তখন সেখানে আবহাওয়া খুব খারাপ। ঝোড়ো হাওয়া। আমার দলে ছিলেন আরও দুজন। মলয় মুখার্জী এবং সত্যরূপ সিদ্ধান্ত। তবে আমার দলে আমিই এগিয়ে ছিলাম। ফলে আমি যখন ক্যাম্প-৩ পেরোচ্ছি তখন আমার আশপাশে আমার শেরপা নিম দরজি ছাড়া আর কেউ নেই। পরে শুনি যে, সত্যরূপ অসুস্থ হয়ে নেমে যেতে বাধ্য হন। হেলিকপ্টারে করে তাঁকে নামানো হয়। তবে মলয় আরও অনেকটা যেতে পেরেছিলেন। শৃঙ্গ পর্যন্ত নয়। খারাপ আবহাওয়ার কারণে তাঁকেও মাঝপথ থেকে ফিরতে হয়েছিল।


যাই হোক, আমার কথা বলি। ওই অঞ্চলে আমার শরীর বেশ কাহিল। খারাপ আবহাওয়ার সঙ্গে লড়তে গেলে জীবনীশক্তি কমে আসে। তবু দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছিলাম। পথ তো কিছু নেই। পাথরের সরু রিজ, খাঁড়া দেওয়াল। কোনও রকমে দড়ি ধরে-ধরে এগিয়ে যাওয়া। পথের সৌন্দর্য অপূর্ব। কিন্তু মুহূর্তে মুহূর্তে বিপদ ওত পেতে। তবু লক্ষ্যের দিকে আরও খানিকটা এগোলাম। সেখানে একটা 'হাম্প' পেলাম। সেটা পেরোলেই আমি আমা ডাবলামের হাতের কাছে চলে যাব। কিন্তু না, ওখানেই একটু থেমে গেলাম। না থেমে উপায় ছিল না। সামান্য পথ কিন্তু দুর্দান্ত খারাপ পরিস্থিতি। শীতও পড়ে গিয়েছে ওখানে। শীতে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়। আমি যদি আরও এগোই আরও সময় লাগবে। কিন্তু নামতে তো হবে। আবহাওয়া আরও খারাপ হয়ে গেলে যদি নামতে না পারি! ঝুঁকি নিতে পারলাম না। ফিরে এলাম। মাত্র ১০০ মিটার দূর থেকে ফিরলাম। তবে সব থেকে মর্মস্পর্শী হল, আমার জন্য হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে মিংমা শেরপার আমার জন্য অপেক্ষা করা। উনি আমাকে নিয়ে লুকলা ফিরবেন। ভাবা যায়!  


এই অভিযানকে টেকনিক্যালি যদি সফল না-ও বলতে পারি, তবু এক হিসেবে সফলই বলব। কেননা, যে পর্যন্ত যে ভাবে যেতে পেরেছি, সে পর্যন্ত তো আমরা সফল। আর এই ছোট্ট ব্যর্থতা থেকেই তো পরবর্তী কালে আরও বড় অভিযানে নামব। এটাই তো পৃথিবীর অভিযানের ইতিহাসের মূল কথা। এই না-পাওয়াটাই তো আমায় পরে আরও সফল অভিযানের দিকে নিয়ে যাবে।


আরও পড়ুন:    শহরে 'দুয়ারে সরকার' প্রকল্পে প্রথম স্বাস্থ্যসাথী কার্ড পেলেন মমতা ব্যানার্জী!