ব্যুরো: সরকারি হাসপাতালে দালাল চক্রের অভিযোগ নতুন নয়। ভর্তি হতে, বেড পেতে, অপারেশনের তারিখ পেতে এই দালালরাই টাকার বিনিময়ে মুশকিল আসানে এগিয়ে আসেন। কিন্তু, আজ  আপনাদের এমন এক ঘটনা জানাব যা স্তম্ভিত করে দেয়। সরকারি হাসপাতালে বসে, অপারেশনের সরঞ্জাম বিক্রিতে বেসরকারি সংস্থার হয়ে দালালি করছেন খোদ হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান! এমন ঘটনা কখনও শুনেছেন কী? হ্যাঁ। এরকমটাই ঘটছে।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

চব্বিশ ঘণ্টার স্টিং অপারেশনে পর্দা ফাঁস,  কু-চক্রে চিকিত্সা।


পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিলেন রাজারহাটের অষ্টমী বিশ্বাস। মেরুদণ্ডের হাড়ে চিড় ধরেছিল বৃদ্ধার। সময়মতো অপারেশন  না হওয়ায় সমস্যা বেড়ে যায়। জটিল স্নায়ুর অসুখে হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তিনি। সপ্তাহখানেক আগে বাড়ির লোকেরা বৃদ্ধাকে RG কর মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যান। কী হল তারপর?


শুরুতে সব ঠিকই ছিল। আউটডোরে ডাক্তার দেখিয়ে নিউরো
সায়েন্স বিভাগে বেড পেতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু, তখনও জানা ছিল না কোন বিপদ অপেক্ষা করে আছে। ধাক্কাটা এল কয়েকদিনের মধ্যেই। অষ্টমী বিশ্বাসের বাড়ির লোকেদের নিজের চেম্বারে ডেকে পাঠালেন ডাক্তারবাবু।


সরকারি হাসপাতালে অপারেশনের জন্য কেন বাইরের সংস্থা থেকে প্রতিস্থাপনের যন্ত্রাংশ কিনতে হবে? তাও আবার ডাক্তার যে সংস্থার কথা বলবেন কিনতে হবে সেখান থেকেই? বেঁকে বসে রোগীর পরিবার।


ওষুধ থেকে চিকিত্সা সরঞ্জাম। সবই পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের দোকানে। স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, বাজার দরের থেকে কম দামেই নাকি ফেয়ার প্রাইস শপে এসব মেলে। অষ্টমী বিশ্বাসের বাড়ির লোকেরা ছুটলেন RG করের ফেয়ার প্রাইস শপে।


মেরুদণ্ডে অপারেশনের জন্য কিছু সরঞ্জাম দরকার ছিল।  RG করের ডাক্তারবাবু জানিয়ে দেন সরঞ্জাম কিনতে হবে তাঁর বলে দেওয়া সংস্থার এজেন্টের থেকেই। এক্সেল কার্ডিয়াক ডিভাইস প্রাইভেট লিমিটেড। দক্ষিণ কলকাতার এই সংস্থার এক এজেন্টের ফোন নম্বর রোগীর পরিবারকে দিয়ে দেন ওই চিকিত্সক।


একেবারে সর্ষের মধ্যেই ভূত। নগদ পঁয়ত্রিশ হাজার, সঙ্গে দু-হাজার টাকা ট্যাক্স। বেসরকারি সংস্থার এজেন্টকে সাঁইত্রিশ হাজার টাকা গুনে দিলে তবেই OT-তে পৌছবে চিকিত্সা সরঞ্জাম। যিনি, রোগীর পরিবারকে এ কথা বললেন, তিনি হাসপাতালে ঘোরা সাধারণ কোনও দালাল নন। RG করের স্নায়ুরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সুদীপ্ত চ্যাটার্জি।


এক্সেল কার্ডিয়াক ডিভাইসেস থেকে সরঞ্জাম না কিনলে অপারেশন বন্ধ। নিরুপায় বাড়ির লোকেরা ছুটে আসেন চব্বিশ ঘণ্টার দফতরে। অষ্টমী বিশ্বাসের বাড়ির লোকেদের কাছে ঘটনা জানতে পেরে চক্রের পাণ্ডাদের ধরতে ফাঁদ পাতি আমরা। আমাদের সামনেই চিকিত্সক সুদীপ্ত চ্যাটার্জির দেওয়া নম্বরে ফোন করেন তারা।


পাঁচ মিনিট বাদেই সংস্থার প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে আরেক জন  ফোন করলেন অষ্টমী বিশ্বাসের ছেলের মোবাইলে।


চিকিত্সা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থার সঙ্গে যে RG করের বিভাগীয় প্রধানের যোগ রয়েছে, এরপর সেটা বুঝতে আর অসুবিধা হয় না। টাকা জোগাড় হয়ে গেছে শুনেই বেসরকারি সংস্থার এজেন্ট  সেই ব্যক্তি জানিয়ে দেন তিনি নিজে আসবেন না। তাঁর লোক পৌছে যাবে আমাদের কাছে।


RG করের এমার্জেন্সির সামনে অপেক্ষা করতে থাকি আমরা। রবিবার ছুটির দিনে সাড়ে এগারোটা থেকে টানা তিন ঘণ্টার অপেক্ষা। আড়াইটে নাগাদ রাজীব সাঁধুখা নামে এক ব্যক্তি ফোন করেন রোগীর পরিজনদের মোবাইলে। পরিচয় দেন এক্সেল কার্ডিয়াক ডিভাইসেস প্রাইভেট লিমিটেডের এজেন্ট। RG করের এমার্জেন্সির সামনে এসে নিজের পরিচয় দিলেন  এই যুবক।


চিকিত্সক সুদীপ্ত চ্যাটার্জিই যে তাঁকে পাঠিয়েছেন সেটা জানাতেও ভুললেন না।


ভিজিটিং আওয়ারের মুখে হাসপাতাল তখন ভিড়ে ঠাসা। লোকজনের সামনে টাকা নিতে বেজায় আপত্তি চিকিত্সা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থার এজেন্টের। হাসপাতাল চত্ত্বরে ফাঁকা জায়াগায় নিয়ে যাওয়া হল আমাদের।


গুনে গুনে নগদ সাঁইত্রিশ হাজার টাকা বুঝে নেন রাজীব
সাঁধুখা। টাকার রসিদ চাইতে গেলেই তার জবাব...


রাজীব সাধুখাঁর সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা যখন গোপন ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছে, ঠিক তখনই দূর থেকে আরেকটি ক্যামেরায় বন্দি হচ্ছিল গোটা দৃশ্য। রোগীর বাড়ির লোকেদের কাছ থেকে এজেন্ট টাকা নিতেই আমরা আমাদের আসল পরিচয়টা জানিয়ে দিই।  ফাঁদে পড়েছেন বুঝতে পেরে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা শুরু করেন রাজীব সাধুখাঁ।


ধরা পড়ে চেনা ডাক্তারবাবুকে বেমালুম ভুলে গেলেন এই এজেন্ট।


ততক্ষণে এই এজেন্টকে ঘিরে ধরেছেন অন্য রোগীদের পরিজনেরা। চাপে পড়ে অপরাধের কথা কবুল করেন রাজীব সাধুখাঁ।


হাসপাতালের ভেতর চব্বিশ ঘণ্টার ক্যামেরায় ধরা পড়ে গেছে।



চিকিতসার কু-চক্র। RG করের স্নায়ুরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সুদীপ্ত চ্যাটার্জির সঙ্গে যোগসাজশের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন বেসরকারি সংস্থার এজেন্ট। ঠিক তখনই আমাদের প্রতিনিধির মোবাইলে এল সুদীপ্ত চ্যাটার্জির ফোন। ছুটির দিন বাড়িতে বসে হাসপাতালে দালাল ধরা পড়ার খবর কী করে জানলেন ডাক্তারবাবু? আর সেই দালালকে বাঁচানোর জন্য তিনি এত উতলাই বা কেন? উত্তর মিলল কিছুক্ষণের মধ্যেই।


বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে রোগীর পরিবারকে অপারেশনের সরঞ্জাম কিনতে বাধ্য করার পিছনে এই চিকিতসকের স্বার্থ কী তা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। সেই স্বার্থের রঙ যে মোটেও সাদা নয়, তা আরও পরিষ্কার হয়ে গেল যখন খবর চাপার জন্য টোপ দিলেন তিনি।