সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আজ, শুক্রবার নাড্ডা-কাণ্ডের জেরে রাজ্যপাল এক সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবহৃত 'ভাষা' নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। রাজ্যপাল অভিষেক ব্যানার্জীকেও সতর্ক করেছেন এই বলে যে, তাঁর এখন অনেক দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন সামনে পড়ে রয়েছে, ফলে অসাংবিধানিক আচরণ থেকে তাঁর এখনই বিরত হওয়া দরকার।


রাজ্যপাল রাজ্যপালের মতোই শিষ্ট ভাষায় একথা বলেছেন। কিন্তু এখন প্রত্যকে দিনই খবরের দিকে চোখ-কান রাখলে রাজনীতির নেতানেত্রীদের থেকে নানা রকম 'মণিমুক্তো' শোনা যায়। কখনও নরেন্দ্র মোদী কখনও মমতা ব্য়ানার্জী, কখনও দিলীপ ঘোষ, কখনও কল্যাণ ব্যানার্জী। এক দশক আগে এক শ্রেণির বামপন্থী নেতাদের কটুবাক্য কানে শোনা পর্যন্ত যেত না, তা এতই কুরুচিকর ছিল। হাল আমলে দিলীপ ঘোষ প্রতিদিনই বাছা-বাছা কিছু না কিছু বলছেন। তা নিয়ে চাপানউতোর হচ্ছে। বেরিয়ে আসছে পাল্টা মন্তব্য। সেই মন্তব্যও 'বিলো দ্য বেল্ট' হচ্ছে। কখনও শাসকদলের তরফে সটান বলে দেওয়া হচ্ছে বিজেপি গুন্ডামি করছে, তার জবাবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি বলেন, গুন্ডামিই হবে, পারলে ঠেকাক।


এ সব দেখে অনেকেরই রাজনীতির প্রতি বিবমিষা জন্মাতে পারে; আসতে পারে বিরক্তিও। তাঁরা মনে করতে পারেন, এই যদি রাজনীতির হাল হয়, তবে থাক বাবা পলিটিক্স, তা দিয়ে কাজ নেই! 
   
অথচ, এটাই কিন্তু রাজনৈতিক আসরের ছবি ছিল না দেশে। বিপরীত দলের, বিপরীত মতাদর্শের নেতাদের মধ্যেও যথেষ্ট সৌহার্দ্য ছিল। অনেক উদাহরণ রয়েছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে কমিউনিস্ট হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জীর সঙ্গে বিপুল পার্থক্য ছিল প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর। কিন্তু জওহরলাল যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন সিপিআইয়ের হীরেন্দ্রনাথকে। মন দিয়ে শুনতেন তাঁর বক্তব্য। ইন্দিরা গান্ধির মধ্যেও এই ঐতিহ্য দেখা যেত। তিনি বিরোধী দলের অনুজ অটলবিহারী বাজপেয়ীকে যথোচিত সম্মান দিতেন। মতপার্থক্য় থাকলেও প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির সঙ্গে অটলজির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা আজ সর্বজনবিদিত। এ তো গেল কেন্দ্রের ছবি। পশ্চিমবঙ্গের ছবিও কিন্তু একইরকম সংস্কৃত ছিল। রাজনৈতিক তর্ক বাংলার সংস্কৃতি হলেও অশিষ্ট কোন্দল কোনওদিনই এ রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল না। বিধানচন্দ্র রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন বিধানসভায় সংখ্যায় অকিঞ্চিৎকর ছিলেন বামপন্থীরা। অথচ শোনা যায়, বক্তব্য পেশ করার ক্ষেত্রে তাঁদের নেতা জ্যোতি বসুর জন্য বাড়তি সময় বরাদ্দ করতেন তিনি। পরবর্তীকালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ও জ্যোতি বসুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা সকলেই জানেন। ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে জ্যোতি বসুর সুসম্পর্কও সুবিদিত। রাজ্যে বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতার মধ্যগগনে তখনও বহু কংগ্রেস নেতার সঙ্গেই বামপন্থী নেতাদের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক বজায় ছিল।



কিন্তু দিনে দিনে এই ছবিটা কি কেন্দ্রে কি রাজ্যে বারবার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। রঙ বদলে গিয়েছে, বাকধর্ম বদলায়নি। আগে সিপিএম-কংগ্রেস, সিপিএম-তৃণমূল দ্বৈরথ ছিল; এখন তৃণমূল-বিজেপি দ্বৈরথ। বিজেপি ও তৃণমূলের দুই নেতা মোদী ও মমতার বাকবিতণ্ডা একটা সময়ে চরমে উঠেছিল। তৃণমূলনেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে 'গণতান্ত্রিক থাপ্পড়ে'র কথা শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মোদীকে 'কান ধরে ওঠবস' করতে হবে। অন্য দিকে, মোদী তৃণমূল নেতৃত্বকে 'তোলাবাজ' তকমা দেন। বলেন, মাফিয়াদের প্রার্থী করেছে তৃণমূল। ২০১৪-র নির্বাচনী প্রচারের বাকযুদ্ধে একজন অপরজনের কোমরে দড়ি পরাবেনও বলেছিলেন। তার পর থেকে বিজেপি-তৃণমূল পারস্পরিক সম্পর্ক ক্রমশ অন্ধকারে গিয়ে ঠেকেছে। মতান্তর যে মনান্তর নয়, এটা ভুলেছে সবপক্ষই। রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে তাঁদের কোনও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক রচিত হয়নি। তাঁরা সব সময়েই দুর্মুখ, সব সময়েই কোন্দলপ্রিয়, সব সময়েই অশিষ্ট, অসংসদীয়; সব সময়েই যুযুধান, যুদ্ধং দেহি-মোডে স্বরাট। 


কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারে আলাদা দল ক্ষমতায় থাকলে দুই দলের মধ্যে বিরোধিতার একটা পরিসর তৈরি হয় এ কথা ঠিক। এবং নির্বাচনী লড়াইয়ের সময়ে সেই দ্বন্দ্ব চরমেও ওঠে৷ কিন্তু এও-ও ঠিক, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা আছে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই দু'টি সরকারের শাসন পরিচালনা করার কথা।


অথচ, এই 'স্ট্রাকচার্ড' ও সঙ্গত একটা সুব্যবস্থার মধ্যেও এত লুপহোলস, এত অসঙ্গতি, এত মিসকমিউনিকেশনের জন্ম দেওয়া হয় যে, দিনে-দিনে রাজনৈতিক দ্বৈরথ শুধু 'রাজনৈতিক' পরিসরেই আবদ্ধ না থেকে তা সমাজের সর্বস্তরে তার ডালপালা ছড়িয়ে তিক্ত অন্ধকারকে আরও বাড়িয়েই দেয়। 


ALSO READ: যা ঘটল তা গণতন্ত্রের পক্ষে লজ্জার, মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমা চাইলে ওঁর সম্মানই বাড়বে: রাজ্যপাল