পায়েল ঘোষ


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ব্যালকনিতে জামাকাপড় তুলতে গিয়ে হঠাৎ তার দিকে চোখাচোখি হয়ে গেল অবন্তিকার। আবার সেই গভীর দৃষ্টি, যেন মনের ভেতরটা পর্যন্ত পড়ে ফেলতে পারবে। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল সে। বুকের মধ্যে যেন সে লাবডুব শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। এই সব অনুভূতি কলেজ আমলে হত, তাই বলে দুটো ছেলের মা হয়ে যাওয়ার পর মানায় নাকি? ছি ছি.. নিজের মনের অস্থিরতায় নিজেই লজ্জা পেল সে।


অবন্তিকা আর সোমনাথ এ পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনে মাস চারেক হল এসেছে। চারপাশ শান্ত, গাছগাছালি ঘেরা জায়গায় এসে দুদিনেই মন ভরে গেছে তাদের। এ যেন পরম শান্তির জায়গা। বাচ্চা দুটোর স্কুল ও বেশ কাছাকাছি। সব মিলিয়ে অবন্তিকার বেশ কাটছিল দিনগুলো। পাড়ার লোকজনও বেশ প্রানবন্ত। আর দিন কয়েক বাদেই দুর্গাপুজো। অবন্তিকাদের ফ্ল্যাটের সামনেই প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে। পুজোর একদম প্রানকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ওদের ফ্ল্যাট টা।


গত কয়েকদিন ধরে লাগাতার প্যান্ডেলের কাজ চলছিল। অবন্তিকা রোজই কাজের ফাঁকে ব্যালকনিতে এসে দেখে যায় কদ্দুর কাজ এগোলো। সেদিনও এরকমই দেখছিল। এমন সময় এক বেশ সুপুরুষ ব্যক্তি প্যান্ডেলের সামনে এসে দাঁড়াল। পুজোর কর্মকর্তা হবে মনে হয়। যারা কাজ করছিল তাদের ভাল করে ইন্স্ট্রাকশন দিচ্ছিল কিভাবে কি কি করবে। অবন্তিকা আলগাভাবে দেখছিল, হঠাৎই ভদ্রলোকের দৃষ্টি তার ওপর পড়ল। সে দৃষ্টিতে কি যে জাদু ছিল তা অবন্তিকাও জানেনা। হাসিমিশ্রিত চোখ তাকে অনেক কথা যেন বলে গেল।


সেই শুরু... এরপর মাঝে মাঝেই দেখা হয় তার সাথে.. ব্যালকনি মারফৎ। সোমনাথ যখন অফিসে বেরোয় তার মিনিট পাঁচেক পর তিনিও বেরোন। প্যান্ডেলের কাজকর্ম দেখে একটা আলগা দৃষ্টি ব্যালকনিতে দিয়ে বেরিয়ে যান অফিস। সারাটা দিন এক অন্যরকম আনন্দে মশগুল হয়ে থাকে অবন্তিকা। এ অনুভূতি প্রেমে পড়ার পূর্বলক্ষণ।


সোমনাথ পুজোর কটা দিন ছুটি নিয়ে নিয়েছে। বাচ্চাদেরও ছুটি পড়ে গেছে। সকালে অবন্তিকা বাড়ীর সবার আব্দারে হিংএর কচুরি করছিল। কাল ষষ্ঠী। কচুরি করতে করতে ভাবছিল কিভাবে পুজোর প্ল্যান সাজান যায়। আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে গিয়ে আড্ডা মারাই যায়। অথবা পায়ে ফোস্কা নিয়ে ঠাকুর দেখা। কিছু তো করতেই হবে। ভাবনায় ছেদ পড়ল কলিংবেলের আওয়াজে। সোমনাথ খুলেছে দরজা।


----- নমস্কার। আরে আসুন আসুন। প্রথম এলেন, বাইরে থেকে চলে যাবেন মানে? আরে অবন্তি একবার এসো।


কিচেন থেকে বেরিয়ে অবন্তিকা স্থির হয়ে গেল! ইনি তো সেই ভদ্রলোক!!


----- নমস্কার। আমি রাহুল। এই পুজোর সেক্রেটারি। আপনারা নতুন এসেছেন। একটু আলাপ করতে এলাম। আরো একটা ব্যাপার। আপনারা যদি এই পুজো কমিটির মেম্বারশিপটা নিয়ে নেন তাহলে দারুন হয়। যত বেশী মেম্বার বাড়বে পুজো তত জমে যাবে।


সোমনাথের মুখ দেখে মনে হল হাইলি ইম্প্রেসড ভদ্রলোকের ওপর।


----- আরে... এতো দারুন ব্যাপার। পাড়ার পুজোতে ইনভলবড থাকার মতন আনন্দ আছে নাকি কিছুতে? চারদিন জমিয়ে আড্ডা খাওয়া দাওয়া... আর কি চাই। তা না হলে এই ভিড়ে কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে ঠাকুর দেখাটা যেন একটা পেইনফুল ব্যাপার। আর আমার দুটি ছেলে তো আমার মাথা খেয়ে নেবে পুজোর দিনগুলোতে বাড়ীতে থাকলে। আর অবন্তিকাও কি ছেড়ে কথা বলবে?


----- সে আর বলতে। এছাড়া আমাদের পুজোয় অনেক ধরনের কালচারাল প্রোগ্র্যাম হয়। যদি আপনার মিসেস বা বাচ্চারা পারটিসিপেট করে খুব ভাল হয়।


----- নিশ্চয়। অবন্তিকা ভীষণ ভালো গান গায়। আজকাল সংসার নিয়েই এত ব্যস্ত এসব করেইনা। দেখুন আপনি যদি রাজি করাতে পারেন।


------ আপনি কি রবীন্দ্রসংগীত করেন?
সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রাহুল।


অবন্তিকার বুকের মধ্যে কেমন যেন অস্থির করছিল। তাও যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় বলল-- দক্ষিনীতে শিখতাম। বছর পাঁচেক।


------- আমি গীতবিতানে শিখেছি কিছুদিন। মা গীতবিতানের টিচার ছিলেন। এখন আমারও চর্চা করা হয় না। অফিসের কাজের এত প্রেসার। আমি সেলসে আছি। মান্থ এন্ড টার্গেট নিয়ে জেরবার। এই পুজোটাই আমার সারা বছরের অক্সিজেন। আর এবার পুজোটা মনে হয় গানবাজনায় জমে যাবে। আজ আসি। আবার দেখা হবে। আর একটা কথা... সপ্তমী টু দশমী বাড়িতে নো রান্না। খাওয়াদাওয়া সব পুজো প্যান্ডেলে।


রাহুল চলে গেল। তার সাথে এক অনাবিল আনন্দ ছড়িয়ে দিল অবন্তিকার মনে। গুনগুন করে সে গেয়ে উঠল 'ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে'।


সপ্তমীর সকাল থেকে হই হই ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। হলদে সাদা ঢাকাই শাড়ীতে অবন্তিকাকে অপূর্ব লাগছে। সবাই মিলে পুজোর কাজ হাত মিলিয়ে শুরু করল। মাঝে দু একবার রাহুলের আনাগোনা হল। অনেকটা অভিভূত চোখে সে তাকিয়েছিল অবন্তিকার দিকে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে সে বাড়ী ফিরছিল একটু বিশ্রাম নেবার জন্য। হঠাৎ কেউ ডাকল।


---- বিকেলে কখন আসবেন প্যান্ডেলে?
ঘিয়ে পান্জাবীতে রাহুল অনবদ্য।


---- একটু রেস্ট নিয়ে। আপনিও কি বাড়ী চললেন।


----- অগত্যা। আপনাকে আজ দারুন লাগছে দেখতে। ভাবলাম একসাথে কোথায় একটু গান টান করব, তা আপনি তো চললেন বাড়ী। সোমনাথ কোথায়?


----- ও তো আগেই চলে গেছে। এতক্ষনে ঘুমিয়েও পড়ল বোধহয়।


----- আপনিও কি ঘুমোতে চললেন? দেখুন একটা কথা বলি,এই পুজোর সময়টা একটুও মিস করবেন না ঘুমিয়ে। যাবেন পাশের প্যান্ডেলের পুজো দেখতে? আমার ওয়াইফ একটু বাপের বাড়ী গেল। তা না হলে ওকে টেনে নিয়ে যেতাম। কিন্ত আপনাকে ছাড়বনা। চলুন।


রাহুলকে না বলার সাধ্যি অবন্তিকার নেই।


------ বেশ চলুন।


------ আপনি আজ্ঞে টা চলবে নাকি 'তুমি' চলতে পারে?


------ বিলক্ষণ চলতে পারে।


বিকেল অবধি কেটে গেল গল্প আড্ডায়। স্কুল ,কলেজ দুজনের সংসারজীবন.. কত কি। অবন্তিকার মনে হল এই রাহুল ওর খুব চেনা। কোথাও যেন এতটুকু অস্বস্তি নেই ওর।


----- কাল একসাথে অষ্টমীর অন্জলি দেবো। বেশী দেরী করবেনা। আর লালপেড়ে শাড়ী পরবে। তোমায় দারুন মানাবে।


------ আর তুমি ধুতি পান্জাবী।


------ এইরে..ঝামেলায় ফেলে দিলে তো! বউ হাজার একবার বলেছে পরতে, পরিনি। এবার তোমায় ইম্প্রেস করার জন্য পরলে বউ সন্দেহ করবে তো!


------ ওসব আমি জানিনা.. কাল ধুতি পরতেই হবে।


----- যো হুকুম ম্যাডাম।


অষ্টমীর সকালে ধুপধুনোর আবছায়াতে অবন্তিকার দুটো চোখ খুঁজে চলছিল রাহুলকে। কিচ্ছু ভাল লাগছিলনা ওর। দু দুটো অন্জলির টার্ন এড়িয়ে গেল ও। এবার টা দিয়েই দেবে। হাতে ফুল নিয়ে সবে মন্ত্রোচ্চারন করতে যাবে, ঠেলাঠেলি করে কে যেন পাশে এসে দাঁড়াল। চেনা আফটারশেভের গন্ধ। ধুতি পান্জাবী পরে রাহুল এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশটিতে।


------ দাও তোমার থেকেই একটু ফুল দাও।
------ টিনএজ জুটির মতন একমনে দুজনে অন্জলি দিল। তার সাথে যেন মনখারাপের বাজনাও বেজে উঠল। পুজো শেষের দিকে।


দশমীর দিন অবন্তিকার মন ভীষণ উদাস। আর তো এক সুন্দর দিনগুলো কাটবেনা। আবার নিয়মের জীবন, নিয়মের ভালবাসা...পুজোর দিনগুলোর স্মৃতি মনিমানিক্যের মতন আগলে রাখবে সে। এগুলোই তো বেলা অবেলায় তাকে সজীব রাখবে।
ঠাকুর বরণ করার পর শুরু হল সিঁদুরখেলা। রাহুলকে দেখল প্রচুর কায়দা কানুন করে ফোটো তুলছে ওদের সবার। বিসর্জনের পর কোলাকুলি শুভেচ্ছা বিনিময় করে অবন্তিকা বাড়ী ফিরছে।
----- শুভ বিজয়া।
চমকে উঠল অবন্তিকা। রাহুল ওর ফ্ল্যাটের সিঁড়ির তলায়।


----- শুভ বিজয়া তোমাকেও।


------ আজ তোমায় বেশ ডাউন দেখাচ্ছে। মন খারাপ কোরো না। আমার সাথে তোমার দেখা হতেই থাকবে সবসময়... মনের মাঝে, প্রাণের টানে। মন খারাপের দিনেও আছি.. হইচইয়ের দিনেও। কাজের জগতে আবার আমরা ঢুকে পড়ব। দেখবে কিভাবে একটা বছর কেটে যাবে। তখন আবার আমি প্যান্ডেলের কাজ তদারকি করব আর তুমি আমাকে ব্যালকনি দিয়ে চুপি চুপি দেখবে।


অবন্তিকার মন খারাপ নিমেষে সরে গিয়ে ঝলমলে মুখে পরিণত হল।


------ এই না হলে মাঝবয়সের প্রেম!!!


দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল। শেষ বিকেলের অস্তরাগ ছড়িয়ে পড়ল ওদের মুখে।


আরও পড়ুন- আদর্শ শঙ্কর, দুর্গমকে সুগম করাই প্যাশন অভিযাত্রী অনিন্দ্যর