সোমশুভ্র মুখোপাধ্যায়


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

‘’যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায়, তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।‘’ এইরকমই এক ধর্মের কথা ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কী ত্যাগ? কিসেরই বা তপস্যা? রবীন্দ্রনাথ তাকে বলছেন, ‘’যেখানে আমিকে না-আমির দিকে ছাড়তে বাধা পাই তাকে অহং বেড়ায় বিচ্ছিন্ন সীমাবদ্ধ করে দেখি। এক আত্মলোকে সকল আত্মর অভিমুখে আত্মার সত্য; এই সত্যের আদর্শেই বিচার করতে হবে মানুষের সভ্যতা।... মানুষের দায় মহামানবের দায়, কোথাও তার সীমা নেই।‘’  রবীন্দ্রনাথ যাকে বলছেন মহামানবের দায়, তা হল আমি থেকে না-আমিতে পৌঁছনো। আবরণময় আমিকে আবরণমুক্ত আত্মতে উত্তরণ। সেটাই তাঁর সাধনা। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেন ‘হওয়া’ বা হয়ে ওঠা। এই হয়ে ওঠার সাধনাই রবীন্দ্রনাথের জীবনজুড়ে, তাঁর সমগ্র রচনার ধারণশক্তি। এই হয়ে ওঠার সাধানাকে শঙ্খ ঘোষ দেখেন দু:খকে জয় করার সাধনা হিসেবে। কেননা রবীন্দ্রনাথ যখন বলছেন, ‘’ছাড়তে-ছাড়তে বাড়তে-বাড়তে মরতে-মরতে বাঁচতে-বাঁচতে আমি কেবলই হব।‘’ তখন শঙ্খের মনে হয়, ‘’আমার ব্যক্তি অংশটাকে যতটা ছাড়তে পারি আমি ততটাই বেড়ে উঠি বিশ্বের দিকে আর মরতে মরতে? সেও ওই একই কথা। আমার স্বার্থ অংশটা যতখানি মরে ততই বেঁচে ওঠে আমার বিশ্বতোমুখ আমি।‘’ এখানে এসে তাঁর মনে হয় রবীন্দ্রনাথের হয়ে হঠার সাধানা আসলে দু:খকে জয় করার সাধনা। যথার্থই বলেন, ‘’এই ছাড়ার মধ্যে, ত্যাগ স্বীকারের মধ্যে একটা দু:খও তো আছে। সত্যিকারের হয়ে ওঠারও একটা অপরিহার্য সম্বল তাই দু:খ।‘’ এ সাধনা তাঁর অন্তর্লীন। এ সাধনা তাঁর অন্তর্জীবনের। জীবনভরের সাধনা ছিল ‘মোর আমি ডুবে যাক নেমে’।  


আর এক সাধনাও চলতে থাকে সমান্তরাল। সেখানেও দু:খ, তবে তার মধ্যে যত না দু:খবোধ, তার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্ববোধ-যা সর্বজনীন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘’মনুষ্যত্বের মধ্যে দিয়া মানুষকে যাহা পাইবে তাহা নিদ্রিত অবস্থায় পাওয়ার নয়। এই জন্যেই সংসারের সমস্ত কঠিন আঘাত আমাদিগকে এই কথা বলিতেছে, উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত। ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গং পথস্তত করয়ো বদন্তি। উঠ, জাগো যথার্থ গুরুকে প্রাপ্ত হইয়া বোধ লাভ করো। সই পথ ক্ষুরধারের ন্যায় দুর্গম।‘’(ধর্ম)। এই সাধনা এক হিসেবে বিবেকানন্দেরও। কেননা রবীন্দ্রনাথের জীবনের ভরকেন্দ্র উপনিষদ, আর বিবেকানন্দের বেদান্ত, যা উপনিষদেরই আর এক নাম।


বিবেকানন্দ যখন বলেন, ‘’ বেদান্তে ঈশ্বর বিষয়ক যে সকল তত্ত্ব আছে, সেগুলির মিলে পূর্ণ মুক্তি। এই মুক্তির পথ ক্ষুরের ধারের ন্যায় তীক্ষ্ণ, দুরাধিগম্য ও কঠিন।...তাহা হইলেও এসকল দুর্বলতা ও বিফলতা যেন তোমাকে বদ্ধ না করে। উপনিষদের বাণী উত্তিষ্ঠাত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত। উঠ, জাগো, যতদিন না সেই লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছি, ততদিন নিশ্চেষ্ট থাকিও না।‘’ (বাণী ও রচনা ৩য় খণ্ড) এই কথা তো কিছুক্ষণ আগে রবীন্দ্রনাথের কাছেও শুনলাম। আর এর মধ্যে দিয়েই পরমকে পাওয়ার কথা ভাবতে পারেন দুজনেই। বিবেকানন্দ বলেন ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।‘’ আর রবীন্দ্রনাথ বললেন, পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয়/ পথের দুধারে আছে মোর দেবালয়।‘’ কিংবা ‘’বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।/নয়কো বনে, নয় বিজন নয়কো আমার আপন মনে / সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়,  সেথায় আপন আমারও / সবার পানে যেথায় বাহু পসারো, সেইখানেতেই প্রেম জাগিবে আমারও / গোপনে প্রেম রয় না ঘরে, আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে--/ সবার তুমি আনন্দধন, হে প্রিয়, আনন্দ সেই আমারও।।


আরও পড়ুন- অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ