রোশনি কুহু চক্রবর্তী​: ‘পড়েছি আজ রেখার মায়ায়...রেখা আমার যথেচ্ছাচারে হাসে, তর্জনী তোলে না..সে আঁকছে, ভাবছে না সংসারের ভালমন্দ’। ‘শেষ সপ্তক’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠিক এই কয়েকটা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। তুলি, কলম, রঙিন কালি, পোস্টার রং নিয়ে বসে থাকা রবীন্দ্রনাথের এই চেনা ছবিটা পিকাসো, রেমব্র্যাঁ, ভ্যান গগের সেল্ফ পোর্ট্রেটের সঙ্গে কোথাও যেন মিলে যায়। একাকিত্বে ঘিরে থাকা সেই রবীন্দ্রনাথ তুলি ধরেছেন। মনে হচ্ছে কোনও একটা মানুষের প্রতিকৃতি আঁকছেন তিনি। তুলি নিয়ে ছবি আঁকার স্বাধীনতা চরম মাত্রায় উপভোগ করতেন রবীন্দ্রনাথ, এ কথা বলাই বাহুল্য। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING


দু্ঃখে-আনন্দে, শোকে-শান্তিতে তুলি ধরছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত কবির আঁকা চিত্রকর্মের সংখ্যা তেইশশোর বেশি। এর মধ্যে ১,৫৭৪টি চিত্রকর্ম শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত রয়েছে। কবির প্রথম চিত্র প্রদর্শনী দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উদ্যোগে ১৯২৬ সালে প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়। তবে রবীন্দ্রনাথের ছবি কোথাও যেন বৃহত্তর সত্যের কথা বলে। ছবিগুলো গভীর, সহজ, নিখাদ। তিনি নিজেই বলছেন, ‘সরল রেখা আঁকা সহজ নহে। সত্য বলাও সহজ ব্যাপার নহে। সত্য বলিতে গুরুতর সংযমের আবশ্যক। দৃঢ় নির্ভর হয়ে নিষ্ঠার সহিত তোমাকেই সত্যকে অনুসরণ করিতে হইবে, সত্য তোমার অনুসরণ করিবে না।’ তুলির স্বাধীনতা বারবার ফিরে এসেছে রবি ঠাকুরের ছবিতে। আসলে ছবি আঁকা তাঁর কাছে ছিল শিশুর নতুন পাওয়া খেলনার মতো।



শিশু যেমন আনন্দে মাতে নতুন খেলনা নিয়ে, ঠিক তেমনই। কিংবা আজীবন শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে হয়তো ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন, তাই হয়তো চিত্রকলাকে বেছে নেওয়া। সাতষট্টি বছর বয়সে প্রথম তারিখ-সহ রবি ঠাকুরের আঁকা ছবি পাওয়া যায়। তখন রবীন্দ্রনাথ জগদ্বিখ্যাত। তাঁ। ভাবনার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। রবীন্দ্র গবেষকরা বলছেন, ১৮৮০ নাগাদই প্রথম ছবি আঁকায় হাত পাকানো শুরু করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ যখন কোনও শব্দ লিখে কেটে দিচ্ছেন। পরের লাইনে আবারও কোনও শব্দ লিখে মুছতে চাইছেন। তা নিয়েও ছবি তৈরি হচ্ছে। একটা ইমেজারি। সেই ছবি ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। একটা ছন্দও ছিল সেই ছবির মধ্যে। সেই ভাবেই পূরবীর পাণ্ডুলিপিই যেন রবীন্দ্রনাথকে আরও পরিণত চিত্রশিল্পী করে তুলল। ইউরোপ এবং আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি নিয়ে উত্সাহ বাড়ছিল একটা সময়ে। মৃত্যুর ছয় মাস আগে, ১৯৪১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এমন একটা ‘ডুডল’ এঁকেছিলেন তিনি। জীবনের শেষ ১৩-১৪ বছর ভরপুর প্রাণশক্তি নিয়ে ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। ল্যান্ডস্কেপ, পোর্ট্রেট, অনেকগুলো মুখ, ফুল,ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর ক্যানভাসে। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট বিভাগের মধ্যে তাঁকে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। তাই হয়তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "ছবি কী– এ প্রশ্নের উত্তর এই যে– সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। তার ঘোষণা যতই স্পষ্ট হয়, যতই সে হয় একান্ত, ততই সে হয় ভালো। তার ভালো-মন্দের আর কোনো যাচাই হতে পারে না। আর যা কিছু – সে অবান্তর – অর্থাৎ যদি সে কোনো নৈতিক বাণী আনে, তা উপরি দান।"  



কবির প্রত্যক্ষ কল্পনার ছবিতে ছন্দের আনাগোনা। পশু, পাখিগুলিও জীবন্ত হয়ে উঠল তাঁর রঙে-রেখায়। তাই জাদুবাস্তব থেকে খানিকটা দূরেই রইল তাঁর ছবিগুলি। তাঁর ছবির নারীদের মধ্যে কোথাও যেন অন্য এক স্বাতন্ত্র। তাঁর ছবিতে কালো রং এবং আলোর ব্যবহার আলাদ মাত্রা পেল। প্রকৃতিও আশ্রয় পেল তাঁর ক্যানভ্যাসে। যদিও সেটা খুব আশ্চর্যের বিষয় নয়। শান্তিনিকেতনের হলকর্ষণ উত্সবে নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে গ্রামের নানা সামগ্রী, শস্যদানা দিয়ে আলপনা আঁকা হয়েছিল। আর যেটা হয়েছিল সেটা প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ রক্ষায় শিল্পের আঙ্গিকে এক যুগান্তকারী কাজ। যা নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জাপান ভ্রমণের সময় শিল্প নিয়ে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘ভারতে বৃহৎ পটভূমে চিত্রাঙ্কনের প্রয়োজন। এতদিনে নন্দলাল তাহা সফল করিলেন।’



১৯৩৭ সালে ‘খাপছাড়া’, ‘সে’ বইয়ে রবি ঠাকুরের আঁকা ছবি অন্য মাত্রা পেল। সে ছবি রক্ষণশীল নয়। সে ছবি অবাধ, স্বাধীন। রবি ঠাকুরের ছবির তাই কোনও নির্দিষ্ট স্কুল নেই। পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট, মডার্নিস্ট, এমন কোনও বিভাজন তাঁর ছবিতে নেই। এমনকি, তাঁর আঁকা কোনও ছবি কিন্তু একরকমের নয়।প্রতিটা ছবি কোথাও যেন আলাদা, নিঃসঙ্গ। রবি ঠাকুরের গল্পের ভাবধারায় সাদৃশ্য ঘুরে ফিরে এসেছে কয়েকবার। এমনকি , তাঁর গানের সুরেও কিছু ক্ষেত্রে একই আমেজ এসেছে।কিন্তু ছবির ক্ষেত্রে রবি ঠাকুরের আঙ্গিকটাই আলাদা। কোনও কিছুর সঙ্গে মিল নেই।বিস্তৃতি বহুদূর জুড়ে।



তবে অদ্ভুত সাদৃশ্য ভুল বলা হবে না, কবি জীবনের প্রথম পর্বে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছিলেন ‘ছবি ও গান’ ৷ আর তাই, কলমের কালি, ইন্ডিয়ান ইঙ্ক, কখনও বা তুলির বদলে কলমের পিছনের অংশ ও হাতের আঙুল, চেটো দিয়েই একের পর ছবি এঁকে গিয়েছেন চিত্রকর ভানুসিংহ।
রবীন্দ্রনাথের ছবির ভাষা তাই হয়ে উঠেছিল সহজ সত্যের সমাধান।শেষ জীবনের সাহিত্যে যে দর্শন ফুটে উঠেছিল, রবীন্দ্রনাথের ছবির ভাষাতেও সেই দর্শন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই অনায়াসে রামকিঙ্কর বেইজ বলে ওঠেন,‘'আমার ঠাকুর রবি ঠাকুর।’'



কবিতায়, গানে, নাটকের এক-একটি ফর্মে চূড়ান্ত সিদ্ধিতে পৌঁছনো, তার পর সেই সিদ্ধি ঠেলে ফেলে ফের নতুনের সন্ধানে যাত্রা। ক্যানভ্যাসেও নতুনের সন্ধান দিলেন রবি ঠাকুর।