সঙ্ঘজননী সারদাদেবী, এক শাশ্বত মাতৃমূর্তি
জগৎকে আপন করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার।
সৌমিত্র সেন
মুসলমান ডাকাত আমজাদ। তাঁকে এলাকাসুদ্ধ মানুষ যে শুধু ভয়-ই করে তা নয়, মুসলমান হিসেবে একটু ঘৃণাও করে। এ হেন আমজাদের এঁটো নিজের হাতে মুছে নিয়েছিলেন সারদাদেবী।
সময়টা উনিশ শতকের ছোঁয়াছুঁয়ি, বাছবিচারের মহারক্ষণশীল হিন্দু বাঙালি গ্রাম্য়সমাজ। সেখানে সারদার এই আচরণ যেন আকাশ থেকে খসে পড়া পূর্বাপরহীন অলৌকিক এক 'জেসচার'! যেখানে হিন্দু-মুসলিম, উঁচু-নীচু, দলিত-ব্রাহ্মণে কোনও ভেদ নেই! যে-বিষয় নিয়ে এই দুর্দান্ত অগ্রগতিশীল একুশ শতকীয় ভারতও নিয়ত লেজেগোবরে হচ্ছে, সেই বিষয়ে সেই কতদিন আগেই নিছক মানবিক দিক থেকেই কত বড় আধুনিক ভাবনার ছাপ রেখে গিয়েছেন সারদাদেবী।
ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে সারদাদেবী এক সাক্ষাৎ বিপ্লব। অথচ নিরুচ্চার। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর মহাসমাধির আগে মাকে বলেছিলেন, তাঁকে (মাকে) অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্ব মানে, ভক্তদের দায়িত্ব। ভক্তদের পথদেখানো। এই কলকাতা শহরের মানুষগুলির ভারও ঠাকুর মায়ের হাতেই অর্পণ করেছিলেন। বলেছিলেন-- কলকাতার লোকগুলি সব কিলবিল করছে, তাদের দেখো। দেখেওছিলেন সারদা। ঠাকুরের সাক্ষাৎশিষ্য়েরা মা'কে দেখে অবাক হয়ে যেতেন। তাঁরাও স্বীকার করতেন, মা ঠাকুরের চেয়েও অনেক ব্য়াপকভাবে ও নির্বিচারে ভক্তদের দায়িত্ব নিয়েছেন।
মঙ্গলবার সেই বিশ্বজননী, ভারতজননী, সঙ্ঘজননী কলকাতাজননী মা সারদার ১৬৮ তম জন্মতিথি। বাঁকুড়ার জয়রামবাটীতে ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। বাংলায় ১২৬০ সনের ৮ পৌষ, অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে।
করোনা-আবহে এবারে কোনও উদযাপনই হচ্ছে না। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের শাখাগুলিতেও এবার মায়ের জন্মতিথি সংক্রান্ত কোনও উৎসব হচ্ছে না। তবে ভক্তদের সঙ্গে তো মায়ের আধ্যাত্মিক যোগাযোগ, অলৌকিক যোগাযোগ। উৎসবের মাধ্যমেই হোক বা নিরুৎসব কোনও নিমগ্ন স্মরণের পথেই হোক-- মা সর্বথা তাঁর সন্তানের শিয়রে মূর্ত।
শ্রীরামকৃষ্ণের পত্নী ও সাধনসঙ্গিনী এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্ঘজননী মা সারদা আসলে এক ব্যাপ্ত মাতৃমূর্তি। তিনি সকলের মা। তাঁর কথাতেই আছে, তিনি সতেরও মা, অসতেরও মা।
একবার এক ভক্ত মায়ের কাছে ভারতীয়দের ওপর ইংরেজদের অত্যাচারের কথা বলে ইংরেজদের বিষয়ে তাঁর কোনও বিরূপতা প্রত্যাশা করে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। সমস্ত বাস্তব স্বীকার করেও সারদাদেবীর সেদিন বলতে বাধেনি যে, ইংরেজরাও তাঁর সন্তান!
শুধু মুখের কথাতেই নয়! প্রথম দেখাতেই যে নিবিড় আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি আইরিশকন্যা মার্গারেটকে গ্রহণ করেছিলেন, ভারতীয় ইতিহাসে তার কোনও তুলনা নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমাজ তখন দারুণরকম রক্ষণশীল এবং তিনি হিন্দু ব্রাক্ষণের বিধবা পত্নী। তাঁর পক্ষে এক 'ম্লেচ্ছ' কন্যা মার্গারেটকে গ্রহণ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। অথচ কঠিন কাজটি অনায়াসে করেছিলেন তিনি।
তবে নারীবাদী ক্ষমতায়নের বিপ্লবপ্রাণিত কোনও আচরণ হিসাবে এ কাজ তিনি করেননি। এ কাজ তিনি করতে পেরেছিলেন, নিছকই একজন মা হিসেবে। এক স্নেহময়ী মা ঠিক যেভাবে তাঁর সন্তানকে গ্রহণ করেন ঠিক সেভাবেই তিনি সেদিন নিবেদিতাকে গ্রহণ করেছিলেন। নিবেদিতা নিজেও স্বীকার করেছিলেন এর গুরুত্ব। মা তাঁকে গ্রহণ করলেন মানে প্রাচ্য কাছে টেনে নিল পাশ্চাত্যকে।
কখনও কথাপ্রসঙ্গে, কখনও ভক্তদের প্রশ্নের উত্তরে জীবনের নানা ছোটখাটো বিষয়ে সারা জীবন ধরে নানা গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য় করে গিয়েছেন সারদাদেবী। আজও যা মানুষকে আলো দেখায়। পথ দেখায়। শান্তি রচনা করে। আনন্দ বিছিয়ে দেয় আত্মার নিভৃতে।
তাঁর জীবনের একেবারে অন্তিমপ্রান্তে উপনীত হয়ে সারদাদেবী বলেছিলেন, 'যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার।'
কিন্তু বাসনা নির্মূল করার প্রসঙ্গে তিনি যা বলে গিয়েছেন, একালের ভোগবাদী পুঁজিবাদী মানবসমাজের পক্ষে তা সম্ভবত তাঁর সব চেয়ে যুগান্তকারী উপদেশ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। ঈশ্বরলাভের প্রসঙ্গে উপদেশ দিতে গিয়ে এক ভক্তকে তিনি 'নির্বাসনা' হতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ঈশ্বরের কাছে নির্বাসনা প্রার্থনা করতে। আজ একালের মানুষ যেভাবে ভোগবিমুগ্ধ বিলাসললিত যাপনে নিত্য অভ্যস্ত এবং পরিণামে ত্রস্ত-তিক্ত-বিরক্ত তাতে সারদাদেবীর এই উপদেশ তাঁদের কাছে আলোর দিশারি হতে পারে।
Also Read: জীবন্ত ভালবাসা-কল্পতরুর অমৃতস্পর্শে তিন অসাধারণের নবজন্ম লাভ