শর্মিষ্ঠা গোস্বামী চট্টোপাধ্যায়


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

‘অর্থ, কীর্তি বা সচ্ছলতা নয়। ভিতর থেকে সার্থকতার বোধ না এলে অভিনেতা ফুরিয়ে যান।‘ সৌমিত্র নিজেই লিখেছেন একথা। চরিত্রের জন্য এক আজীবন লোভ ছিল তাঁর। নানা চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছেটুকুকে জিইয়ে রেখেছিলেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। খুব গর্ব করে বলতেন, মানিকদা অর্থাত্‍ সত্যজিত্‍ রায় তাঁকে বারবার নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয় করিয়েছেন। তপন সিনহাও তাই। এমনকি তরুণ মজুমদারের কাছেও ভিন্ন চরিত্রই পেয়েছেন তিনি। তাই নিজের অভিনয় ক্ষমতার ভার্সাটিলিটি নিয়ে একধরণের তৃপ্তি ছিল সৌমিত্রর। অথচ জীবনের প্রথম স্ক্রিন টেস্টেই ফেল। নীলাচলে মহাপ্রভু ছবিতে স্ক্রিন টেস্ট দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে বাদ দিয়ে নেওয়া হয় অভিনেতা অসীম কুমারকে। 'অপরাজিত'র স্ক্রিন টেস্ট করছেন তখন সত্যজিত্‍ রায়। মানিকবাবুর চিফ অ্যাসিসট্যান্ট সৌমিত্রকে নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। তাঁকে দেখেই নাকি মানিকবাবু বলে ওঠেন, ‘ইস, আপনার বয়সটা একটু বেশি হয়ে গেছে’। এরপরের কথা সবার জানা। সৌমিত্র গেছেন সত্যজিতের জলসাঘরের শুটিং দেখতে। ছবি বিশ্বাসের কাছে ধরে নিয়ে যান সত্যজিত্‍ই। বলেন, তাঁর পরের ছবি অপুর সংসারে সৌমিত্রই নায়ক। ব্যস, বাঙালি পেয়ে গেল তার ফ্যাসিনেটিং টপিক। 


বাংলা ছবিতে এই নতুন নায়কের সংযোজনে বাঙালির উত্তম-সৌমিত্র ঝগড়ার শুরু। কীভাবে গগনছোঁয়া জনপ্রিয়তার উত্তম কুমারের পাশে নিজের একটা আকাশ তৈরি করলেন সৌমিত্র? এর উত্তরও দিয়ে গেছেন তিনিই। বলেছেন, উত্তম কুমার যেমন ছবি বিশ্বাসের ঘরানায় এক বিপ্লব, ঠিক তেমনই উত্তমের ঘরানাকে তিনি ঘা দিয়েছিলেন রিয়ালিস্টিক অভিনয় দিয়ে।আজীবন সেই অভিনয় ধারাটাই বয়ে নিয়ে গেছেন তিনি। তাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের থেকেও অপু, ফেলুদা, ক্ষিতদা, উদয়ন মাস্টাররা বেশি করে থেকে গেছেন দর্শকের মনে।



সৌমিত্র-র জীবনে কোনও সেকেন্ড ইনিংসের প্রয়োজন হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রের খিদেতেই বোধকরি সহজেই পেয়ে গেছেন দর্শকের শ্রদ্ধা। বয়স যত বেড়েছে, তত বেশি করে চওড়া হয়েছে কাঁধ। বক্স অফিস বৈতরণী পার করেছেন ডেভিড গাওয়ারের মত নান্দনিক কভার ড্রাইভে। ‘বেলাশেষে’ থেকে ‘বরুণবাবুর বন্ধু’.....পথে অবশ্য এক ‘ময়ূরাক্ষী’ পার করেছেন। ‘বসু পরিবার’-এর সেটে সত্যিকারের কর্তা।শরীর ততটা সহায় না হলেও এক নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে চোখ এড়ায় না কিছুই। পোস্ত-র দাদু যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে নাতিকে বলেন, ‘আবার বলো, ভালো করে বলো’, তখন মনে পড়ে যায়, প্রায়ই বলতেন, ‘কণ্ঠস্বরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত একটু গানের রেওয়াজ দরকার’। সে রেওয়াজ করতেনও। 


 আরও পড়ুন: ছবি-সংসারের ঘরে-বাইরে এক অপরাজিত অভিযান

দেহ পট সনে নট সকলই হারায়, একথা কি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে খাটে? বোধহয় না। কারণ আমরা তাঁকে নিছক সিনেমার অভিনেতা হিসাবেই পাই নি। মঞ্চে তাঁর এক বিশাল অবদান। সিনেমায় কখনও পরিচালনা করেন নি, কিন্তু মঞ্চে একের পর এক নাট্য প্রযোজনায় পরিচালক হিসাবে কাজ করেছেন। মঞ্চ থেকই অভিনয় জীবনের হাতেখড়ি। গুরু শিশির কুমার ভাদুড়ি। সৌমিত্র বলতেন, ‘শিশির কুমার ভাদুড়ি আমার গুরু ছিলেন বটে, কিন্তু এক অসম বয়সী সখ্যতা ছিল তাঁর সঙ্গে। নানা বিষয়ে আলোচনা হত শিশির কুমারের সঙ্গে’। শিশির কুমারের সঙ্গে মঞ্চে মাত্র একটি নাটকেই অভিনয়, তাও মাত্র একটি শো-তে। ‘প্রফুল্ল’ নাটকে সুরেশের ভূমিকায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাট্য জীবন বাংলা মঞ্চ অভিনয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ‘দ্য মঙ্কিস প’ আবলম্বনে ‘মুখোশ’ থেকে, ‘বিদেহী’, ‘নামজীবন’, ‘নীলকণ্ঠ’ দেখার জন্য বারবার পূর্ণ হয়েছে প্রেক্ষাগৃহ। ‘স্বপ্নসন্ধানী’ দলে অনুজপ্রতিম কৌশিক সেনের সঙ্গে ‘টিকটিকি’ বাংলা নাটকে এক ফেনোমেনন। 



তাঁর পরিচালনায় এই আকালেও শততম রজনী পার করল ‘ফেরা’। ৮৬ বছরেও নাটক নিয়ে সবথেকে বেশি উত্‍সাহী তিনি। মঞ্চে শেক্সপীয়র করতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র। কেবল ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ নয়। এক সামগ্রিক শেক্সপীরিয়ন থিয়েটার। শিশির ভাদুড়িকে দেখার আগেই IPTA-র স্ট্রিট থিয়েটার দেখে ফেলেছিলেন। তাই বোধহয় বারবার বলতেন, ‘আমার অভিনয়কে কোনও বিশেষ ফর্মে বাঁধা যাবে না, নানা ফর্ম এসে জড়ো হয়েছে আমার মধ্যে। আমার চিন্তা, মনন, লেখনী, সবেতেই নির্মাণ আর বিনির্মাণে কাজ করেছে জীবনের নানা অভিজ্ঞতা’।


আরও পড়ুন: প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
 


আসলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কেবল একজন অভিনেতা নন, তিনি কবি। ক্রান্তদর্শী।বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বারবার তাঁর কলম গর্জে উঠেছে। কখনও লেখায়, কখনও সটান রাস্তায়, মিছিলে, প্রতিবাদে, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায়। আবার প্রয়োজনে ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে প্রতিষ্ঠানের পাশেই। সৌমিত্র বলতেন, ‘মানুষ হিসাবে আমি র‍্যাডিক্যাল। এই অনুসন্ধানী মন বারবার প্রশ্ন করে, এতদিন যাঁদের সবকিছু ভালো দেখেছি, তাঁদের সবটাই কি ভালো? যাঁদের খারাপ ভাবতাম, তাঁরা সত্যিই কি এতটা খারাপ? তার উপর দাঁড়িয়েই বারবার বিশ্বাস ভেঙেছে, আবার তার থেকেই জন্ম নিয়েছে এক নতুন বিশ্বাস’।



এই ছিয়াশিতেও তাই তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন ছাব্বিশের অহংকার। সেটুকুই আমাদের সম্পদ। বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার নিতে রাজি হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন প্রসেনজিত্‍ চট্টোপাধ্যায়। বারবার সৌমিত্রকে বুঝিয়ে বলতেন, ‘নিজের জন্য না হলেও, আমাদের জন্য (টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির)পুরস্কারটা নাও’।


অপুর শরীর খারাপের খবরে মূহুর্মূহু বেজে উঠেছে ফোন। হাসপাতালের আপডেট নেওয়ার সময়ে আমাদের উত্‍কণ্ঠাও কি কিছু কম ছিল? রক্তচাপ বাড়ছে, অক্সিজেনের মাত্রা কত, প্লাজমাথেরাপি কাজ করবে কিনা, মস্তিষ্কের এমআরআই করানো যাবে কিনা, ডায়ালিসিস নিতে পারবেন তো, উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছে গোটা দেশ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নেই, আমাদের মনখারাপ। জীবিতকালে বারবার প্রশ্ন করেছি, ‘আত্মজীবনী লিখবেন না? বা জীবনী আকারে কিছু?’ বারবার নেতিবাচক উত্তরই পেয়েছি। বলতেন,’আমাদের দেশে বায়োপিকে সব সত্য কথা লেখা যায় না। তাছাড়া আমার জীবনের সঙ্গে আরও অনেক জীবন জড়িয়ে আছে। তাই তাঁরা কষ্ট পান, এমন কাজ আমার করা উতিত নয়।’ তাই পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় বায়োপিক করতে রাজি হওয়ায় চমকেই গিয়েছিলাম একটু। কিন্তু বোধহয় মনের কোণের সেইটুকু বাস্তব হল। ছবির সব দৃশ্যের শুটিং শেষ করলেন বটে, কিন্তু দেখে যেতে পারলেন না। তার আগেই জীবনমঞ্চ থেকে প্রস্থান নটের।



‘অভিনেতা অভিনয় করেন কেন? দু-চার রাত্রির শখের বা আকস্মিক মঞ্চাবতরণ, অথবা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর শৌখিন উত্তেজনা-অভিলাষীদের কথা আমি বাদ দিচ্ছি। যাঁরা অভিনয়কর্মকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে এই অনিশ্চিত পেশার ক্ষুরধার পথে কোন কারুবাসনার দংশনে হেঁটে চলেন, আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি আমার নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে। দু-চার দিনের শখ সম্বল করে কি অভিনেতা বছরের পর বছর অভিনয় করে যেতে পারেন? কিসের তাগিদে তিনি এই পথে পা রাখেন? সে কি আত্মপ্রদর্শনের তাগিদে? না কি নিছক গ্ল্যামারের হাতছানিতে? অথবা মুদ্রারাক্ষসীর মোহিনী মায়াজালে পড়ে?’-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই মহাপ্রস্থানের পথে বাঙালির কালচারাল আইকন-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।