অনির্বাণ সিনহা


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

শ্রীরামকৃষ্ণকে একটি বাক্যে প্রকাশ করা সম্ভব? শিষ্যদের মধ্যে অগ্রণী স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, সম্ভব। ভারী ভারী শব্দে ঠাসা কোনও জটিল বাক্য বলেননি ঠাকুরের আদরের ,নরেন; বলেছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ মানে ,LOVE PERSONIFIED। মূর্ত ভালবাসা। ভালবাসা শব্দটির উপরই দাঁড়িয়ে বাঁকুড়ার হদ্দ গ্রামের দরিদ্র ব্রাহ্মণের ধর্মজীবন।


১ জানুয়ারি ১৮৮৬। কল্পতরু হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সেই থেকে ভক্তরা যাবতীয় লৌকিক সমস্যার সমাধানে শ্রীরামকৃষ্ণের অলৌকিক হস্তক্ষেপের আশায় বুক বাঁধেন এই বিশেষ দিনে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, প্রিয়জনের রোগ-মুক্তি, স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানের ঘরের কাছে বদলি,মাথা গোঁজার ঠাঁই বা নিতান্ত সংসার ভরণ-পোষণের জন্য একটা সরকারি বা নামি বেসরকারি সংস্থার চাকরি। প্রাণের ঠাকুরের কাছে গৃহস্থের প্রার্থনা নিতান্ত লৌকিক হলেও তা অবহেলার নয়। বেঁচে থাকতে, এক পয়সার তেলেরও যাতে অপচয় না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল দক্ষিণেশ্বরের পূজারী ব্রাহ্মণের। তাঁর অবর্তমানে কী হবে সহধর্মিণী সারদা দেবীর?একেবারে সরকারি চাকুরের মতো পেনশনের বন্দোবস্ত করে গিয়েছিলেন স্ত্রীর জন্য। রানি রাসমণির জামাই মথুরামোহন বিশ্বাসের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের অবর্তমানে পাঁচ টাকা মাসোহারা পাবেন সারদা দেবী।


বাবার অকালমৃত্যুতে মা ও ভাই-বোনেদের নিয়ে অকুল পাথারে পড়লেন ঠাকুরের স্নেহের নরেন। নরেন্দ্রনাথের শত অনুরোধেও নিজে মা ভবতারিণীর কাছে কিছুই বললেন না শ্রীরামকৃষ্ণ। নরেন্দ্রনাথকেই পাঠালেন তাঁর 'চিন্ময়ী'মায়ের কাছে পরিবারের জন্য কিছু চেয়ে নিতে। অথচ, নিজে ঘর-বার করতে করতে আকুল প্রার্থনায় তাঁর 'চৈতন্যময়ী' মাকে বলতে লাগলেন,'দেখিস মা, আমার মুখ রাখিস। নরেন যেন টাকা-পয়সা না চেয়ে বসে'! চোরকে চুরি করতে বলে গৃহস্থকে সজাগ করার এই আজব ব্যবহারের কারণ কী? শ্রীরামকৃষ্ণ কি সাংসারিক চাহিদা বা প্রার্থনার কথা ভগবানকে জানানো নিকৃষ্ট বলে মনে করতেন? কোনও সিদ্ধান্তে পৌছনোর আগে মনে রাখা ভাল, নরেন্দ্রনাথকে গৃহী নয়, ভবিষ্যত সন্ন্যাসী সংঘের নেতা হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সন্ন্যাসীর কাছে ধর্মজীবনের সবচেয়ে বড় অন্তরায় অর্থ ও কাম। অথচ, সংসারী ভক্তের চারটি বর্গ. ধর্ম,অর্থ, কাম ও মোক্ষ। তাই নরেন্দ্রনাথ যা চেয়ে ফেলতে পারেন বলে ঠাকুরের বুক ধুকপুক, গৃহী ভক্ত তা চাইলে সেই ঠাকুরই কল্পতরু। ভক্ত লোভের গাড্ডায় না পড়লে তিনি নিজে যে মুশকিল আসান হবেন তার প্রমাণও হাতে কলমে রেখে গেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ।বারবার, তিনবার। দক্ষিণেশ্বরের কালী ঘরে ঢুকে বিবেক,বৈরাগ্য,জ্ঞান, ভক্তি ছাড়া কিছুই চাইতে পারলেন না নরেন্দ্রনাথ।কোথায় রইল মা-ভাই-বোনেদের পেটের চিন্তা!কোথায় উধাও হল দুঃখিনী মায়ের উপবাসী মুখ! শেষে স্থির সিদ্ধান্তে পৌছলেন, এসব তাঁর ঠাকুর, মানে শ্রীরামকৃষ্ণের 'কারসাজি'। তাই এবার তাঁকেই ধরে বসলেন। 'আপনাকেই বলতে হবে মায়ের কাছে, আমার পরিবারের জন্য'। তাঁকে না জানিয়ে বিছানার তলায় ধাতুর মুদ্রা রাখলে যে মানুষটির শরীর বেঁকে যেত, জ্বলুনি হতো, সেই মানুষটিই শেষে ভবিষ্যত বিবেকানন্দের জন্য কল্পতরু হলেন। বললেন, 'বেশ তাদের কখনও মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না।'


 তবে কি শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেও স্বার্থবোধ কাজ করতো? আপন-পর বোধ ছিল?কেবল নিজের স্ত্রী, নিজের ঘনিষ্ঠতম শিষ্যের জন্যই তিনি কল্পতরু হতেন?অন্তত তিনজন মানুষ আমাদের সামনেই আছেন যাঁদের জীবন ইতিহাস অন্য রকম বলছে।সারদা দেবীর জন্য মাসোহারা ও নরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিবারের জন্য মোটা ভাত-কাপড়ের প্রতিশ্রুতির ঘটনাগুলিকে নিতান্তই যদি মোটা দাগের কিন্তু,অপরিহার্য সাংসারিক প্রয়োজন বলে মানি; তবে এখন যে তিনজনের কথা বলছি তাঁদের ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের ভূমিকা ছিল ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের তুল্য।অতি প্লাবন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন,মরুভূমিতে চাষ-আবাদ, যেমন হাজার হাজার বছরের ভূ-প্রকৃতিকে বদলে দেয় তেমনি, এঁদের জীবনকে আমূল পাল্টে দিয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণের কল্পতরু -স্পর্শ।


গিরীশচন্দ্র ঘোষ। বিবেকানন্দের সম্মান,সম্ভ্রম ও সমাদরের জিসি। শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসার আগে যাঁর নট ও নাট্যকারের জীবনে অর্থ,যশ ও খ্যাতির সঙ্গেই প্রেম,সুরা,নারী,কেচ্ছা সবই ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে।বাংলার প্রথম পেশাদার নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা গিরীশচন্দ্র ঘোষ।প্রথমজীবনে প্রহ্লাদচরিত,বুদ্ধচরিত,চৈতন্যলীলা, প্রফুল্লের নাট্যকার পরে লিখলেন,অভিনয় করলেন, ও নির্দেশনা করলেন সিরাজদ্দৌলা, মির কাশেম,ছত্রপতি শিবাজির মতো নাটক।বঙ্গভঙ্গ বিরোধী তীব্র আন্দোলনের আবহে প্রতিটি নাটক ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করল। শ্রীরামকৃষ্ণের মন ও মুখ কতটা এক ছিল, গিরিশ ঘোষের এই বিবর্তন তাঁর সাক্ষী।থিয়েটারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চের পুরোধা পুরুষকে অভয় ও আশির্বাদের সুরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ' তুই থেটার কর গিরীশ। থেটারে লোকশিক্ষে হয়'। সেই সময়কার ভারতে লোকশিক্ষার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র, পরাধীন দেশের মানুষের মনে জাতীয়তাবোধ জাগানো,দেশের অবস্থা সম্পর্কে তাঁদের সচেতন করা। তাই মাথা থেকে পা পর্যন্ত আধ্যাত্মিকতায় ডুবে থাকা শ্রীরামকৃষ্ণের লৌকিক আশির্বাদ গিরীশ ঘোষকে নাট্যকার হিসেবে পূর্ণতা দিল। সামাজিক নাটক থেকে ধর্মীয় পালা হয়ে  দেশাত্মবোধের নাটকে এসে রঙ্গমঞ্চের গিরীশ ঘোষ হয়ে উঠলেন সাধারণের নট , অসাধারণ নাট্যকার।বাংলার নাট্যজগত সম্পূর্ণ হত না মহিলা অভিনেতাদের অংশগ্রহণ ছাড়া। অথচ, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের সমাজে বাড়ির মেয়েদের থিয়েটার তো দূর অস্ত, পড়াশোনার জন্য বাইরে বেরনোও তখন নিষেধ। এখানেও শ্রীরামকৃষ্ণের কল্পতরু স্পর্শ। যে স্পর্শে কেবল নটী বিনোদিনী দাসী নয় , বদলে গেল বাংলা রঙ্গমঞ্চের মেয়েদের জীবন। পরিবার-গোত্র পরিচয়হীন  বিনোদিনী যেন, সেই সময়ের প্রতীক।সেই সময় যখন, থিয়েটারে 'নামতে' হতো। তাই সমাজের চোখে পতিত বা নিচে থাকা , নিচে নামা মহিলারাই কেবল থিয়েটার করতেন। এককথায় সেই 'থেটার'কে লোকশিক্ষা বলে, অভিনেতাকে লোকশিক্ষকের মর্যাদা দিয়ে সাধারণের চোখে নাট্যমঞ্চকে সম্মানের আসনে বসালেন শ্রীরামকৃষ্ণ। নবজীবন সম্পন্ন সেই রঙ্গমঞ্চকে সামলাতে এরপর হিমশিম খেয়ে গেল বিদেশি শাসক। নট্টমঞ্চের  অর্ধেক আকাশকে মুক্ত করে আসলে দেশের মুক্তির অমৃত ফল সাধারণের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কল্পতরু শ্রীরামকৃষ্ণ। মনে রাখার মতো, গিরীশ ঘোষ স্রেফ আত্মগর্বে মত্ত হয়ে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রিত শ্রীরামকৃষ্ণকে খাওয়ার আসন থেকে তুলে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।তারপরও এমন অহেতুকি ভালবাসা!দে শ ও দশের স্বার্থে।


আরও পড়ুন- বাংলায় ভোটের হাওয়া পালে টানতে ভরসা নেতাজি-আবেগ!


কথামৃতকার শ্রী'ম বা শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তমহলে অতি পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্বের অন্যতম দাবিদার।স্কুল শিক্ষক মহেন্দ্রনাথ যেদিন প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসেন সেদিন সাংসারিক বিবাদে তাঁর মানসিক অবসাদ চূড়ান্ত। ঘর ছেড়ে বিবাগী হবেন বা আত্মহত্যা করবেন।এমনই নানা কথা ভাবতে ভাবতে,দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গার পূর্ব প্রান্তের ঘরটিতে তার ঢোকা। বেরনোর সময় তিনি যেন সংসারহীন এক মানুষ।মনে কেবল একটিই চিন্তা, আবার কবে এই অদ্ভুত মানুষটির কাছে আসবেন।পাশ্চাত্য শিক্ষার গর্বে গর্বিত তিনি, এই প্রথম শুনেছেন এক আশ্চর্য কথা।'ইশ্বরচিন্তা বাক-বিতণ্ডার বিষয় নয়..অথচ,সংসারে সবাই ভাবছে, তার ঘড়িটাই ঠিক চলছে,বাকি সব ঘড়ি ভুল.'এই শ্রী'মই একদিন আধুনিক পৃথিবীকে শোনাবেন ধর্মনিরপেক্ষতার সবচেয়ে বড় বাণী, 'যত মত,তত পথ'। শ্রী'ম-র ভবিষ্যত ভূমিকা সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। এতটাই যে,দক্ষিণেশ্বরে প্রতিদিনকার কথোপকথনের রেকর্ড রাখতে দেখে তাঁর অন্যতম পার্ষদ তারককে (সন্ন্যাস আশ্রমে স্বামী শিবানন্দ,রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ) বলেছিলেন, 'তোকে ওসব করতে হবে না। ওর জন্য আলাদা লোক আছে।' পরদিনই গঙ্গার জলে যাবতীয় রেকর্ড ভাসিয়ে দিয়েছিলেন স্বামী শিবানন্দ।


আরতি-স্তবে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, 'প্রেমার্পণ,সমদরশন'.প্রেমের ঠাকুর , সমদৃষ্টি সম্পন্ন শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন কা'র কতটুকু প্রয়োজন। এও জানতেন কা'র কোথায়,কতটুকু ভূমিকা।সেই ভূমিকা পালনে তার সবটুকু বের করে আনতে আর নিজের সবটুকু তাকে উজাড় করে দিতে, তাঁর একমাত্র পথ ছিল, ভালবাসা।LOVE PERSONIFIED শ্রীরামকৃষ্ণ, আসলে সারাবছরই কল্পতরু।তার ভালবাসার ছায়ায় বসলে, ফল আপনিই  কোলে এসে পড়ে।


আরও পড়ুন- নেহরু থেকে মোদী- গোড়াতেই গলদ! কাশ্মীরের বদলা তিব্বতে নিলে জব্দ হত চিন