প্রবাল ভদ্র


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সবে সন্ধে হচ্ছে। নদিয়ার প্রান্তিক গ্রাম বড়চাঁদঘরের চায়ের দোকানে তখন রূপোলি পর্দার নায়কদের নিয়ে নানা আলোচনা। ইতস্তত-এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে চায়ের কাপ, বিড়ি, কয়েকটা পুরনো কাগজ। আড্ডাপ্রিয় বাঙালির মগজের রসদ। নিছকই চা খাওয়ার তাগিদে ছোট্ট চায়ের দোকানে নেমেছিলাম তিন বন্ধু। সেখান থেকে জুড়ে গেলাম আড্ডায়। সিনেমা, রাজনীতি থেকে আধুনিক গানের একাল-সেকাল। পুঁথিপড়া বিদ্যে নিয়ে আলোচনা জমতে বেশি সময় লাগল না। সেখান থেকে মোড় ঘুরে যাত্রা-থিয়েটার। বাংলা থিয়েটার। নাটক। আজ থেকে দুশো বছরেরও বেশি আগে যে বীজ পুঁতেছিলেন এক বিদেশি, সেই লেবেদফ সাহেবের স্বপ্ন আরও একবার চাড়িয়ে বসল প্রান্তিক গ্রামের মানুষগুলোর সামনে। কথায় বলে, প্রতি বাঙালির ঘরে একজন অভিনেতা থাকবেনই। এখানেও তার ব্যাতিক্রম হল না। চা খেতে খেতে হঠাতই উঠে এলেন একজন। বয়স বড়জোর বাইশ-তেইশ। নাম বললেন মুজিবর। স্নাতক। বাংলা নিয়ে পড়াশুনো। গ্রামেই শখের থিয়েটার করেন। স্বপ্ন দেখেন, নাটক নিয়েই বাঁচবেন। না, বেশি কথা বলার সুযোগ ছিল না। ফিরতে হতই। তাড়া ছিল খুব। অগত্যা।


চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আসতে আসতে মাথায় ঘুরতে থাকল মুজিবরের কথাগুলো। ‘আসলে এখানে নাটকের তেমন সুযোগ নেই’। বাংলা থিযেটারের মফস্বল-শহরে চাপা দ্বন্দ্ব চিরকালীন । আর শুধু বড়চাঁদঘর কেন, বাংলার আনাচে-কানাচে অসংখ্য গ্রাম-মফস্বলের থিয়েটার কর্মীদের তো একই অবস্থা। দিন-রাত এক করে একটা প্রযোজনা তো করলেন, কিন্তু মঞ্চস্থ করবেন কোথায়?  প্রযোজনার অর্থই বা জোগাড় করবেন কীভাবে?  সত্যিই তো, নাটক মঞ্চস্থ করার উপযুক্ত মঞ্চ সব জায়গায় কোথায়? আর কল শো...সেতো অনেক দূরের বিষয়...


তা সে নামী দল থেকে শুরু করে তথাকথিত ছোট দলগুলো। সমস্যা বিস্তর। এরমধ্যেও রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে কাজ করে চলেছে অসংখ্য থিয়েটার দল। লাখো লাখো থিয়েটার কর্মী। একবুক আশা আর দুচোখে গভীর স্বপ্ন নিয়ে। অবিরাম লড়ছেন তাঁদের মূল্যবোধকে সঙ্গে নিয়ে। এ শুধু শিল্পের জন্য শিল্প নয়। নিজের চারপাশটার খামতিগুলো খানিক ভরাটের চেষ্টাও বটে। এক উন্নততর আদর্শ, অস্তিত্বের খোঁজ আর নিজেকে নতুন করে চেনার চেষ্টা।


একজনকে চিনতাম। বহু বহু বছর আগে। পেশায় বাস কন্ডাক্টর। কিন্তু বিকেল পাঁচটার পর নো কাজ। সোজা রিহার্সাল রুম। আরও একজন। পেশায় সবজি বিক্রেতা। একবেলা দোকান। অন্যবেলা থিয়েটার।


অর্থ নেই। প্রচার নেই। নিজের কাজ দেখানোর উপযুক্ত জায়গা নেই। তবু কীসের টানে...কোন অমোঘ আকর্ষণে পতঙ্গের মত থিয়েটার নামক আগুনে ঝাঁপ দেন অসংখ্য নাট্যকর্মী?


জিঙ্ক অক্সাইডের গন্ধ। মুখে হাজার-হাজার ওয়াটের আলো। দিনরাত এক করে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। ফসল, আস্ত একটা প্রযোজনা। যেখানে বাস কন্ডাক্টর বিশ্বজিত্ অনায়াসে হয়ে উঠতে পারেন প্রথিতযশা কোনও লেখক, চিকিত্সক অথবা পৌরাণিক কোনও চরিত্র।


হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও শুধু একটু হাততালির আশায়। মনের গভীরের কোনও স্বপ্নপূরণের আশায়। সেখানে কোনও পাওয়া নেই। শুধুই নিজেকে উজাড় করে দেওয়া। এই নেশার টানেই ছুটে চলেছেন হাজার হাজার নাট্যকর্মী। রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ, শুধুমাত্র এই স্বপ্নকে সামনে রেখেই বাঁচছে অসংখ্য থিয়েটার দল। বাঁচছে বাংলা থিয়েটার।


আরও পড়ুন- একটা নবমীর বর্ষার মুহূর্ত কোলাজ


আরও পড়ুন- তা থৈ থৈ যোনি