সব রকম সংকীর্ণতার নাগপাশ ছিন্ন করার গ্রীষ্মসাধনই তাঁর নিজস্ব `বৈশাখ`
তপঃক্লিষ্ট বৈশাখের এই ডাকই তাঁকে দৈনন্দিনের সাধারণ সংসারসাধনার মধ্যেও অসাধারণত্বের মাধুর্যে প্রাণিত করে রাখত
সৌমিত্র সেন: 'শেষ সপ্তক'। ১৩৪২ বঙ্গাব্দের বৈশাখেই রচিত। সেই কাব্যগ্রন্থে একটি বিশেষ কবিতা আছে-- 'পঁচিশে বৈশাখ'। কবির তখন ৭৪ বছর বয়স। সেই সময়ে তিনি এক পূর্ণতায় বিরাজ করছেন। নিজের জীবনটিও তাঁর কাছে তখন অনেক পর্ব-পেরিয়ে-আসা এক অধ্যায়, যে-অধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে তিনি সংযোগ করতে পারেন টীকা, অর্থ, অন্বয়। এই 'পঁচিশে বৈশাখ' কবিতায় যেন অনেকটা সেই সুরই। গদ্যছন্দে লিখিত দীর্ঘ এই কবিতায় কবি একেবারে সেই বালক রবিতে পৌঁছে গিয়েছেন। লিখেছেন এমন চরণ-- 'একদিন ছিলেম বালক।/...সেই বালক না আছে আপন স্বরূপে,/না আছে কারও স্মৃতিতে।...সেদিন জীবনের ছোট গবাক্ষের কাছে/সে বসে থাকত বাইরের দিকে চেয়ে।' এইখানটায় এসে আমাদের মনে কেমন করে, আমরা যেন বালক-রবির সেই নিঃসঙ্গতার অংশীদার হয়ে পড়ি। কিন্তু এ-ও জানি, এই নিঃসঙ্গতাটুকু, এই নির্জনতাটুকু না হলে (বস্তুত যা সারাজীবনই তিনি খুঁজেছেন, কখনও পেয়েছেন, কখনও পাননি) তাঁর চলে না।
সে যাই হোক, মূল কথা হল, এই কবিতায় তিনি নিজের জীবনের সব পর্বকেই ছুঁয়ে গিয়েছেন। সেখানে একে-একে এসেছে 'প্রদোষের আলো-আঁধার', 'ফাল্গুনের প্রত্য়ুষে' দেখা-দেওয়া কোনও এক কালান্তরের পঁচিশে বৈশাখ, ও 'তরুণ যৌবন বাউলে'র কথা, এসেছে বসন্তী রঙের পঁচিশে বৈশাখের রঙ-করা প্রাচীরের ভেঙে-পড়া, জীবনের 'বন্ধুর পথ', 'তরঙ্গমন্দ্রিত জনসমুদ্রতীরে'র প্রসঙ্গ, এসেছে আত্মসাধনায় নৈরাশ্য ও গ্লানির কথা, জীবনরণক্ষেত্রে দিকে দিকে জেগে-ওঠা 'সংগ্রামের সংঘাতের কথাও। এই সব বলতে-বলতে কবি ক্রমশ 'প্রৌঢ় প্রহরের' প্রসঙ্গে চলে আসেন এবং তা থেকে আর একটু এগিয়ে ক্রমে 'এক চরম সংগীতের গভীরতায়' প্লাবিত হওয়ার বাসনা জ্ঞাপন করেন। মহাকবিতাটি শেষ হয়।
৭৪ বছরের রবীন্দ্রনাথ শরীরে-মনে যত ক্লান্তই হন, যত বিষণ্ণ-ব্যথিত-তিক্তই থাকুন ভিতরে-ভিতরে, নিজেকে কিন্তু ধনুকের ছিলার মতো নিত্যদিন টানতে ভোলেন না, তার উপর চাপিয়ে দিতে ভোলেন না অমেয় কর্তব্যভার। যা, এক হিসেবে দেখতে গেলে ওই 'চরম সংগীতের গভীরতা'রই নামান্তর।
ষাট বছরের রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এক অমেয় কর্তব্যভার নিজের কাঁধে অর্পণ করেই রেখেছিলেন। ১৯১৬ সালে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা একটি চিঠি থেকে সেটা জানা যাচ্ছে। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে ছেলেকে চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি। সেখানে কবি লিখছেন, '...শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে-- ঐখানে সার্ব্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চ্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে-- ... ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্চে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে। ঐ জায়গাটিকে সমস্ত জাতিগত ভূগোল বৃত্তান্তের অতীত করে তুলব এই আমার মনে আছে— সর্ব্বমানবের প্রথম জয়ধ্বজা ঐখানে রোপণ হবে। পৃথিবী থেকে স্বাদেশিক অভিমানের নাগপাশ বন্ধন ছিন্ন করাই আমার শেষ বয়সের কাজ।'
যে কোনও রকম নাগপাশের বন্ধন ছিন্ন করার যে-সঙ্গীতসাধন, তা তাঁর পরিণত মনের ফসল, এ কথা ঠিক। সেই যে লড়াই, তার যে তপঃ, তা বরাবর তাঁকে চালিত-প্রাণিত করেছে। কিন্তু সব লেখাতেই তা যে উচ্চকিত সুর বহন করবে, তা-ও তো নয়।
আশ্চর্যের হল, 'জন্মদিনে' নামেই একটি পুরোদস্তুর কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন কবি। ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিনের এই কাব্য একেবারে তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ের রচনার মধ্যে পড়ে। কেননা তখন তাঁর ৮০ চলছে। রোগশয্যায় শুয়েই চলেছিল এই কাব্য-রচন। সেখানে সরাসরি তাঁর জন্মদিনের বা জন্ম-তারিখটির কোনও প্রত্যক্ষ প্রসঙ্গ ওঠেনি। কিন্তু সেখানেও তিনি যা লিখেছেন, তার গাঢ় রস থেকে চলকে উঠেছে বেদনার যে-রূপমূর্তি, রসের আসরে তা বিহ্বলতার চ্যুতিই। কিন্তু দার্শনিকতার নিভৃত রণনে তা মন্দ্রিত। এই কাব্যেরই একটি কবিতায় শোনা যায় এমন বিধুর পঙক্তিমালা-- 'পুরাতন আমার আপন/শ্লথবৃন্ত ফলের মতন/ছিন্ন হয়ে আসিতেছে। অনুভব তারি/আপনারে দিতেছে বিস্তারি/আমার সকল-কিছু-মাঝে।/প্রচ্ছন্ন বিরাজে/নিগূঢ় অন্তরে যেই একা,/চেয়ে আছি, পাই যদি দেখা।' দেখা পেয়েছিলেন কি? কে জানে!
অথচ বছরচল্লিশের তরুণ কবি বৈশাখের দিকে মুখ ফিরিয়ে লিখেছিলেন এক অপূর্ব কবিতা। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে রচিত 'বৈশাখ' নামের সেই কবিতা শুরুই হয়েছিল 'হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ/ধূলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,/তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল/কারে দাও ডাক--/হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?।' সেই ভয়াল ক্লিষ্ট গ্রীষ্মদিন, সেই তাপকম্পিত বৈশাখ কাকে ডাক দিয়েছিল? কবিই স্বয়ং সেই প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু তাঁর জীবনের এই প্রান্তভাগী বৈশাখের ছায়া-ছবি দেখতে-দেখতে আমাদের মনে না হয়ে পারে না যে, এই ডাক কবিকেই। তপঃক্লিষ্ট বৈশাখের এই ডাকই তাঁকে দৈনন্দিনের সাধারণ সংসারসাধনার মধ্যেও অসাধারণত্বের মাধুর্যে প্রাণিত করে রাখত এবং রাখত বলেই তিনি চলেছেন, আটকে গিয়েছেন, আবার চলেছেন; গড়েছেন, ভেঙেছেন আবার গড়েছেন। অবারণ সেই অভিযাত্রা, অমানুষী তার দহন।
বৈশাখের কাছে, গ্রীষ্মের কাছে কবি সারা জীবন ধরে বারবারই ফিরেছেন। না হলে 'নাই রস নাই, দারুণ দহনবেলা', বা 'দারুণ অগ্নিবাণে রে', বা 'এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ' বা 'মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি' বা 'প্রখর তপনতাপে' বা 'মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে'র মতো কাব্যগীতি ঝরত না তাঁর কলমে। যে-সব গানের কথায়-সুরে মর্মে ঠিকরে ওঠে গাঢ় তাপ, ছিটকে পড়ে ঘন ছায়া; যে-ভাষাছন্দে মূর্ত হয় অবারিত অপ্রতিহত গ্রীষ্ম। কবির জীবনসাধন যে আসলে আদতে গ্রীষ্মসাধনই, এই কথাটিই যেন পলাতকা ছায়া ফেলে রাখে তাঁর এই জীবনভর গ্রীষ্ম-উদযাপনে।
তা হলে 'পঁচিশে বৈশাখ' কবিতাটি বা 'জন্মদিনে' কাব্যগ্রন্থ যখন লিখছেন প্রৌঢ় বৃদ্ধ অবসন্ন কবি, তখন কি তাঁর মনে তাঁর নিজেকেই দেওয়া মহাসাধনের প্রসঙ্গ, তার সূত্রে লভ্য একান্ত নিজস্ব সাফল্য-বিফলতা, অমেয় কর্মভারের অর্জন-বর্জন কোনও রেখাপাত করছে না? তিনি কি কেবলই লেখার ঝরনাধারায় স্নাত হয়ে লিখে চলেছেন?
ছোট একটা বিষয়ের দিকে চোখ রাখলে যেন দরজাটা খুলে যায়। কবির নিজের হাতে নিজের কবিতার সংকলন 'সঞ্চয়িতা'র প্রথম কবিতাটিই 'মরণ', ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর; আর ওই বইয়েরই শেষতম কবিতাটি? 'শেষ লেখা' কাব্যের 'তোমার সৃষ্টির পথ'! যেখানে আপন আলোকে ধৌত সত্যের কথা বলেছেন কবি। সত্য-সাধন? সে তো গ্রীষ্ম-সাধনই, সে তো বৈশাখ-সাধন, জন্মদিন-সাধন, তপঃক্লিষ্ট রুদ্রেরই সংগীত। যা মরণ থেকে সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায়, বন্ধন থেকে মুক্তির দিকে।