সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

বছর এগিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে আসছে নতুন মানুষ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেন তৈরি হচ্ছে না নতুন কোনও ভাবনা? ছবি থেকে সাহিত্যে নতুন ভাবনার স্রোতে মন ভাসাতে ভাসাতেও কেন বদলে ফেলতে পারছি না মূলস্রোতের যে সমষ্টির মন, তাকে? যে-মন চালিত করে ভার্চুয়াল মাধ্যমের শত-সহস্র কমেন্ট? 


কেন উঠছে এ কথা? উঠছে, কারণ সম্প্রতি চলে গেলেন অভিনেত্রী সঞ্চালক মন্দিরা বেদীর (Mandira Bedi) স্বামী পরিচালক প্রযোজক রাজ কৌশল চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু কারওর চলে যাওয়ার খবর তো ডেকে আনে বিষাদ, চোখের জল! অথচ এই সংবাদ যেন এসে পড়ল সাধারণ মানুষের বিচারালয়ে। মন্দিরা বেদীকে দেখা গেল স্বামীর মৃতদেহে কাঁধ দিতে, তাঁর শেষকৃত্যে সামিল হতে। আর অমনি শুরু হয়ে গেল বিচার। 


আরও পড়ুন: অন্তর্বাসের মাপ কত? প্রশ্ন করায় কড়া জবাব Sayantani-র


'মহিলাদের কি স্বামীর শেষকৃত্যে সামিল হতে আছে?', 'পুত্রসন্তান থাকা সত্ত্বেও কেন উনি সামিল হলেন স্বামীর শেষকৃত্যে (Last Rites)?' এমনকি বাদ গেল না মন্দিরা বেদীর পোশাক নিয়ে মন্তব্যও। কিন্তু বিষয়টা আসলে হয়ত কেবল মন্দিরা বেদীকে নিয়ে নয়। এর কারণ বরং সমাজের গভীরে বাসা বেঁধে থাকা দীর্ঘদিনের পিতৃতন্ত্র। আর আইন বদলে গেলেও যে-পিতৃতন্ত্রে এখনও রয়ে গেছে 'বাপের বাড়ি', 'শ্বশুরবাড়ি'র মতো ভাষা। কারণ, আজও বিয়ের সময়ে একজন 'পিতা' (খেয়াল করবেন, সন্তানের উপর মাতারও অধিকার নেই!) সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে  কন্যাকে তাঁর স্বামীর কাছে 'সম্প্রদান' করেন। অর্থাৎ, এক গৃহ থেকে আরেক গৃহে, এক হাত থেকে আরেক হাতে-- এভাবে দান হয়ে যান কন্যা। আর হাওয়ায় হাওয়ায় বদলে যায় তাঁর গোত্র। 


আসলে, প্রায় কোনও কিছুতেই মেয়েদের অধিকার নেই! কোনও এক অলীক উপায়ে গোত্রান্তরিত হওয়ার পরও কি নতুন বাড়ি , নতুন বাড়ির মানুষরা তাঁর নিজের হয়? উঁহু, আর সেজন্যই স্বামীর শেষকৃত্যেও তাঁর অধিকার থাকে না। থাকতে নেই। পুত্রসন্তান না থাকলে, দেওর, ভাসুর বা তাঁদের পুত্রসন্তানরা সামিল হবেন সেই ক্রিয়ায়, কিন্তু স্ত্রী? নৈব নৈব চ। 


তবে, আমরা যদি ভাবি, এ কেবলই আস্তিক মানুষের পৃথিবীতে কিংবা পরলৌকিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রেই সত্য, তা হলে ভুল ভাবব। এই পিতৃতন্ত্র এবং মেয়েদের কোনও অধিকার না দেওয়ার মানসিকতা সর্বত্র। এখনও, মানে, এই ২০২১ সালেও, মেয়েরা যখন শিক্ষিত এবং চাকুরিজীবী, তখনও বেশ কিছু হাসপাতালে কোনও স্ত্রী যদি তাঁর স্বামীকে ভর্তি করাতে নিয়ে যান, তবে সেখানে তাঁর (স্বামীর) বাবার নাম আবশ্যিক! এমনকি বাবা জীবিত না থাকলেও! স্ত্রীর নাম দেওয়ার কোনও জায়গাই (স্পেস) নেই! কারণ, স্বামীর পরিচয়ে স্ত্রীর পরিচয় হতে পারে, তা বলে স্ত্রীর পরিচয়ে স্বামীর পরিচয়? এও কী সম্ভব! তাই  যে কোনও অফিসিয়াল নথিপত্রে এখনও অবলীলায় চাওয়া হয় 'পিতা' কিংবা 'স্বামী'র নাম, কারণ মা বা স্ত্রী কে, তা জেনে কী হবে! 


একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আমরা বুঝতে পারব, আজও এই সমাজ 'পিতৃপরিচয়' নিয়ে কতটা ভাবিত।  সময় বদলে গেলেও, খুব গভীরে রয়ে গিয়েছে পুরনো দুর্গন্ধময় সেই মানসিকতা, যে মানসিকতায় স্ত্রী কেবল সন্তান ধারণের যন্ত্রমাত্র আর মায়ের পরিচয়ও কেবল তাঁর মাতৃত্বে। 'ঘর' ও 'বাহির'-এর এই বিপরীত পৃথিবীতে স্ত্রী কিংবা মা সেই 'ঘর'কে যত্ন করে রাখবেন, কিন্তু 'বাহিরে' তাঁর কদর নেই। আর অধিকার? সে তো ঘর বা বাহির কোথাওই নেই!


আজ যখন পুরুষ ও নারী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটছে, কাজ করছে, অর্থ উপার্জন করছে, ঘর সামলাচ্ছে, একে অন্যের দুঃসময়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখনও পরম নিকটজনের বিদায়কালীন যাত্রায় নিজের মতো করে অংশ গ্রহণে নারীর অধিকার থাকবে না কেন? কোনও স্ত্রী যদি এক্ষেত্রে তাঁর কাঁধটুকু বাড়িয়ে দিতে চান, তাতে এত বিচার হবে কেন? কেনই-বা ছুটে আসবে এত মন্তব্য? শাড়ি না পরে, জিন্স পরলে বুঝি বদলে যায় শোক কিংবা শোকের মান? 


বিচার করার আগে, মন্তব্য করার আগে কেন আমরা ফিরে তাকাই না  শতসহস্র বছর ধরে শিকড় ছড়ানো সেই পিতৃতন্ত্রের (Patriarchy) দিকে, যে পিতৃতন্ত্র শাখা বিস্তার করেছে সমাজের মননেও! অথচ আমরা দেরি করে ফেলছি সেখানে গিয়ে কড়া নাড়তে। আর তাই পিতৃতন্ত্র সমাজের কোলে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারছে। কিন্তু আমাদেরই বারবার সেই সমাজের ঘুম ভাঙাতে হবে, আর ঘুম থেকে তুলে তাকে প্রশ্ন করতে হবে-- মেয়েদের কাঁধ শুধু গোপনেই সব শোক বহন করবে? প্রকাশ্যে আসবে না? 


অফ-শোল্ডার টপের আড়াল থেকে দেখা যায় যে-কাঁধ, সে-কাঁধ যদি বহন করতেই চায় শোকের ভার, প্রকাশ্যে-- কেন পাবে না সে সেই অধিকার? সে-ও তো তার অধিকারই!


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)


আরও পড়ুন: Trolling: এর পিছনে সামাজিক বৈষম্যের গভীর প্রভাব আছে