সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

একদিকে বাতাসে 'বাজল তোমার আলোর বেণু'। আর একদিকে কোমরজলে দাঁড়িয়ে 'ওঁ নমোঃ বিষ্ণু'। অন্য দিকে, আকাশ জুড়ে উচ্ছ্বসিত 'ভো কাট্টা'। 


এ বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখটি ঘুড়ির ওড়ানোর পতপত শব্দের সঙ্গেই এবার জুড়ে দিল পিতৃতর্পণের মন্ত্রের গাম্ভীর্যকেও।


১৭ সেপ্টেম্বর তারিখটি অবশ্য বাঙালির ক্যালেন্ডারে বিশ্বকর্মার ছাপমারা দিন হিসেবেই বরাবরের জন্য স্বীকৃত। কারখানায় ও ছোটখাটো দোকানে প্রযুক্তির দেবতা বিশ্বকর্মার সাড়ম্বর আরাধনা হয় এদিন। সকাল থেকেই পাঁঠার মাংসের দোকানে ভোজনরসিক বাঙালির লম্বা লাইনও পড়ে। আর দুপুর থেকেই শহরের আকাশ নানা রঙের নানা কিসিমের ঘুড়িতে ঘুড়িতে ছয়লাপ থাকে: 'পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা'। আর এসবের সঙ্গে ছাদে-কারনিসে ওই উচ্চকিত 'ভো কাট্টা'! ওইদিন বাঙালির ঘরে-ঘরে অরন্ধনও পালিত হয়। এসব তো চেনা ছবি।


তবে এ বছর এই দিনে মহালয়াও পড়েছে। ফলে সব মিলিয়ে বাঙালির মহাব্যস্ততার দিন এটি। মহালয়ার আগের রাতেই বাঙালি সাধারণত অ্যালার্ম দিয়ে রাখে। আজ রাতেও তারা অ্যালার্ম দিয়ে রাখবে। তারপর ঘুম-ঘুম চোখে উঠে রেডিও বা মোবাইল থেকে ভেসে আসা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ওই অপূর্ব নস্টালজিক কণ্ঠে 'আশ্বিনের শারদপ্রাতে' শুনতে-শুনতে হয়তো বরাবরের মতোই ডুবে যাবে একটি মোলায়েম ন্যাপে। এর পর কারও কারও ক্ষেত্রে থাকবে তর্পণকাজ। আগামিকাল সকাল থেকেই কলকাতায় গঙ্গায় এবং অন্যত্র বিভিন্ন জলাশয়ে তর্পণকারীদের ভিড় হওয়ার কথা। তবে করোনা-আবহে মাস্ক পরে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং রেখে কি সম্ভব হবে তর্পণকাজ? জানা নেই। তবে উপায়ও নেই। এ ভাবেই করতে হবে।


ঘুড়ি ওড়ানোর ক্ষেত্রে অবশ্য এই সমস্যা নেই। কেননা, ঘুড়ি যে যার বাড়ির ছাদ থেকে ওড়াবে। লাটাই-সুতো-ঘুড়ি নিয়ে খুব বেশি হলে জনাচারেকের একটা মিনি জমায়েত করোনার ভ্রূকুটি উপেক্ষা করেই দিব্যি ঘুড়ি-আনন্দে মেতে উঠতে পারবে। মাস্ক হয়তো তারা পরবে, কিন্তু সামাজিক দূরত্ব? না, চৌখুপি ছোট্ট ছাদে সেটা বোধ হয় সম্ভব নয়। তাই অন্তত একটা বিকেলের জন্য ওই দূরত্ববিধি ঘুড়িদের জন্যই না হোক বরাদ্দ থাক। কিন্তু সেটাই-বা কী ভাবে সম্ভব? ঘুড়িরা যদি আকাশে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে চলে তবে তো শোনাই যাবে না ওই বহু-আকাঙ্ক্ষিত 'ভো কাট্টা'!



তর্পণের মতো শোকের রিচুয়্যালের ক্ষেত্রে ভিড়টাই যে 'সিগনেচার', বাঙালি তা জানে। আবার নতুন করে জানলও বোধ হয় আজ। কেননা তর্পণ আগামিকাল হলেও তর্পণের রাজনীতি কিন্তু আজই শুরু হয়ে গিয়েছে। তর্পণ নিয়ে দড়ি টানাটানিতে মেতেছে রাজ্যের শাসকদল ও বিজেপি। এ রাজ্যের শাসকদল তর্পণের অনুষ্ঠানে বাধা দিচ্ছে এই অভিযোগ তুলে বাগবাজার ঘাটে বিজেপি আজই সেরে নিল দলের তরফে তাদের একান্ত নিজস্ব তর্পণ। সেখানে গত এক বছরে দলীয় যে কর্মীরা মারা গিয়েছেন তাঁদের পরিবার নিয়েই এই তর্পণ সারল রাজ্য বিজেপি। 


কিন্তু আমবাঙালির তর্পণ! সেখানে অবশ্য কোনও রাজনীতি নেই! রাজনৈতিক রঙ নির্বিশেষে তর্পণকারী বাঙালিদের পাশাপাশি কোশাকুশি তিল-জল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো পুরোহিতের সংখ্যাও তো এ দিন কম হয় না নদীতীরে। দূর দূর থেকে পুরোহিতেরা কিছু রোজগারের আশায় কলকাতায় আসেন এবং মহালয়ার ভোর থেকেই ভিড় জমান গঙ্গায়। আর ওই 'আলোর বেণু'র রেশ কানে নিয়েই পিতৃহারা বঙ্গসন্তানেরা এদিন বাগবাজার থেকে বাবুঘাট, আড়িয়াদহ থেকে আহিরীটোলা পৌঁছে যান। কারও কারও ধরা পুরোহিত থাকে। যাঁদের থাকে না, তাঁরা গঙ্গায় ঘুরে বেড়ানো পুরোহিতদের থেকেই কাউকে বেছে তর্পণক্রিয়াটি সেরে নেন। তর্পণের ভিড় মহালয়ার দিন মোটামুটি যতক্ষণ অমাবস্যা থাকে ততক্ষণই থাকে। আগামীকালও তাই হবে।



আর তারপরই ঘুড়িতে মজবে বাঙালি। তবে এর মাঝে অরন্ধনের বিশেষ খাওয়া-দাওয়াও থাকবে অনেক বাড়িতে। আগের দিনের রান্না ভাত-ডাল-মাছ-তরকারি এবং সাড়ে বত্রিশ ভাজা দিয়ে দুপুরের ভোজটুকু উপভোগ করেই এক দৌড়ে ঘুড়ি-লাটাই-মাঞ্জা হাতে ছাদে ছুটবে ছুটিব্যাকুল বাঙালিসন্তান। 


এ কথা ঠিক যে, বাঙালি আর আগের মতো ঘুড়ি-মুগ্ধ নেই। সময় কোথায় তার! বাঙালি টিনেজ তো বহু দিন হল প্রযুক্তি-দুনিয়া থেকেই নিজেদের বিনোদন খুঁজে নিচ্ছে। তবে, স্থানবিশেষে লকডাউন-পর্বে কিন্তু ঘরবন্দি বাঙালিকে আবার ঘুড়ি-হাতে ছাদমুখো হতে দেখা গিয়েছিল। ফলে মহালয়া-তর্পণ-তর্পণের রাজনীতি এবং অরন্ধন পেরিয়ে বাঙালি কাল ঘুড়িতেও মজবে বলে আশা করাই চলে।     


আরও পড়ুন- এক ঘাটে পুলিসকে ঘোল খাইয়ে, অন্য ঘাটে তর্পণ সারল বিজেপি