দিব্যেন্দু ঘোষ


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আকাশে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে!
বসন্ত এসে গেছে...
আমার কাছে, তোমার কাছে, আমার কাছে
বসন্ত এসে গেছে।


হাত ধরে এনেছে কম্পন। থরহরি-ভাইরাস। এমন প্যাঁচ কষান কষছে যে, আমবাঙালির বসন্ত-বিলাস চুপসে আমসি। তাই বলাবলি চলছে, বসন্ত এসেছে, ভেসেছে, মৃদুমন্দ হেসেছে, কান ঘেঁষে ফেঁসেছেও। কার জন্য বসন্ত? কেন বসন্ত? কোন বসের অন্ত? সকল জঞ্জাল দূর করে নতুন প্রাণের সঞ্চারে এখন তীব্র চোনা। নব উদ্যমে নতুনভাবে জেগে ওঠা, নতুনভাবে শুরু করা, হলুদ রঙে রঙিন হয়ে মৃদু হাওয়ায় প্রিয় মানুষের হাত ধরার কবিকৃত প্রেমরসে গদগদ হওয়ার বদলে এখন প্রেমের গায়ে করোনা-কাঁটা। গোলাপ-কাঁটা সেখানে তো নস্যি। বাসন্তিক আবেগ দুদ্দাড় পালানোর মুডে। হাত ধরা নেই। গা ঘেঁষায় মানা। কাছে আসায় বারণ। চুমুকে তো আপাতত ট্রাঙ্কে ভরে তুলে রাখার মতো দশা। বসন্তের আগমনের জন্য অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসে থাকতেন ইংরেজি সাহিত্যের রোম্যান্টিক কবি পার্শি বিশে শেলি। তিনি তাঁর বিখ্যাত কবিতায় পুরাতনের মূর্ছনা ও বসন্তের বন্দনায় তো বলেই ফেলতেন,
শোনো, ঝোড়ো পশ্চিমের উদ্দাম বাতাস,
তুমি শরতের বয়ে চলা গভীর নিঃশ্বাস।
ঝরে পড়া পাতাদের করো তুমি তাড়া,
ওঝার জাদুতে যেন ছোটে অশরীরী অশুভ প্রেতেরা।
হলুদাভ, কালো, ফিকে জ্বরতপ্ত লাল,
রোগাক্রান্ত মানুষের মতো পাতাদের রং আর গাল।
বসন্তের সুনীল বাতাস আসবে কখন?
তূর্যধ্বনি বাজাবে তখন।


কবি মহাদেব সাহার লেখায় বসন্তের উদ্দাম আমন্ত্রণ,
তোমার সঙ্গে প্রতিটি কথাই কবিতা,
প্রতিটি গোপন কটাক্ষই অনিঃশেষ বসন্তকাল।


লোককবি শাহ আবদুল করিম গেয়েছিলেন,
বসন্ত বাতাসে সই গো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে.....


বসন্তের প্রথম দিনে মনের খুশিতে কেউ কেউ তো আহ্লাদে উচ্চারণ করতে শুরু করে দেয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার চরণ, ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত।


কেউ-বা প্রেয়সীর মনোযোগে, আকর্ষণে মায়াবী সুরে গেয়ে চলেন রবিগীত, আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়.....


ফাগুনের প্রথম দিনে হলদে রঙের রাজত্বে বসন্তের ছোঁয়াছুঁয়ি, জেগে ওঠে ঘুমন্ত মন। সেই মন এখন মধ্যবসন্তে পলায়নপ্রিয়। ঘ্যাসঘ্যাস করে বসন্তের গলা কাটতে উদ্যত। মধুর অমৃত বাণী, বেলা পড়তেই তল্লাটছাড়া। গলাবাজিতে গদগদ, প্রেমে পটু, হুল্লোড়-হইচইয়ে হদ্দমুদ্দ বাঙালি ভুবনের ধূলিমাখা চরণে মাথা আর নত করতে নারাজ। ঠোঁটে বিষম বিষ নিয়ে বাঙালি বলতে চাইছে, মন ফুটে বের করে আনতে চাইছে, বসন্ত ফিরে যাক, বসন্ত ফিরে যাক, বসন্ত এখন ফিরে যাক। নিরুদ্দেশের পানে না হেঁটে, বসন্তকে টা টা বাই বাই করে ঘরে সেঁটে যেতে বেদম ইচ্ছুক আমবাঙালি। বসন্ত এখন আর তাদের কাছে দামি নয়, নেহাতই সস্তা। মনোরম ওয়েদার যাক উড়ে যাক। সুতীব্র গরম, প্যাচপেচে ভীষণতা, শরীর-চিড়বিড়ানি শুষ্কতাই সই। অন্তত করোনা তো পালাবে। চাচা আপন প্রাণ বাঁচার মতো কেস।


সেই বাঙালি, যাদের আজ মনে পড়ে যাচ্ছে কোই মিল গয়া-র জাদুকে। ব্রহ্মাণ্ডের কোনও এক ঈশান কোণ থেকে মর্ত্যে এসে এমন হাল্লা মাচিয়েছিল, সেই হাল্লাই এখন হিট। সূর্যের থেকে ভালবাসা নিয়ে নিজেকে শক্তির সাড়ে পাঁচশো ডিগ্রিতে উন্নীত করে রোহিতের মনকে চাঙ্গা করেছিল। ব্যশ, সকালে উঠে রোহিতের অ্যাবনর্মালিটি ফুলটুস নর্মাল। কানকো মার্কা ছুঁচলো মুখ নিয়ে মাঝে মাঝেই ধুপ ধুপ বলে চেঁচিয়ে উঠত জাদু। অমনি চাগাড় দিত পাওয়ার। মাথার ওপর জ্বলন্ত আগুনে সিলভার মার্কা গোল বলটাই নাকি বাঙালির আপাদমস্তক ভয় সেঁধিয়ে দেবে পাতালে। 


বাস, ট্রেন, মায় রিকশো চড়ে ফতুয়া গায়ে চাটুজ্জে মশাই সক্কাল সক্কাল হাঁক পাড়ছেন, ভটচাজ, গায়ে বেশ তাপ লাগছে। এবার তাহলে করোনা পালাবে, কী বলো। ভটচাজ গায়ে একটা শাল জড়িয়ে বারান্দা থেকে উঁকি মেরে মুখে চুকচুক করে কাতর কাঁদলেন, চাটুজ্জেদা, এখনও বেশ শীত শীত করছে। গরম কোথায় পেলেন? 


আমবাঙালিই এখন বেজায় বিশেষজ্ঞ। মেটাল সারফেসে নাকি বারো ঘণ্টা বেঁচে থাকে করোনা। জামাকাপড়ের ওপরে ছয় থেকে তেইশ ঘণ্টা বেঁচে থাকে। ভারী জামাকাপড় কাচা সম্ভব নয় বলে চার ঘণ্টা সূর্যের আলোর নীচে ফেলে রাখলেও নাকি কাজ হয়। পারা চড়চড়িয়ে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গেলেই নাকি নোভেল করোনাভাইরাসের ভিলেনি খতম। তাই প্রবল বসন্তেও গ্রীষ্মের অপেক্ষায় চাতক নয়নে হাপিত্যেশ করে দরজায় খিল এঁটেই প্রার্থনায় সাত থেকে সত্তরের বাঙালি। গরমে গলগল ঘামে আইঢাই-করা বাঙালিও প্রাণ খুলে গাইছে, এসো হে বৈশাখ। খালি গায়ে ছাদে শরীর সেঁকছে কেউ কেউ।


এই প্রথম বসন্তে দরজায় যেন কড়া নেড়েছে অবহেলা। অনেকগুলো বর্ষা শেষে শরতের উষ্ণতা মেশেনি, বরং করোনা-ভয় ফুটেছে। ভালবেসে অবহেলা আসেনি, বরং মধ্য দুপুরের তির্যক রোদের প্রতি প্রেম জাগছে। যদি পালায় করোনা। ঠোঁট উল্টানো তিরস্কার আর অভিশপ্ত অনূঢ়ার মতো একতাল অবজ্ঞাভরে করোনা-কম্পনে বসন্ত তাড়াতে ব্যস্ত আমবাঙালি।