শর্মিলা মাইতি


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

বইয়ের নাম- ডাগআউট


লেখক- গৌতম ভট্টাচার্য


প্রকাশক- দীপ প্রকাশন


বাইশগজের পিচে সাহিত্যের সিঞ্চন আর পাথরে পদ্মফুল ফোটানো প্রায় একই রকম দুষ্কর। কারণ সংখ্যাতত্ত্ব সেখানে একনায়কের মতো রাজত্ব করে। নামে ভদ্রলোকের খেলা হলেও ছাড় নেই। নিপাট ভদ্রলোককেও মাপা হয় নম্বরের দাঁড়িপাল্লায়। ফর্ম-ফিটনেস-ডায়েট-স্কিল সম্বলিত এই টিম গেমে কোথাও এতটুকু বিচ্যুতি মানেই কেরিয়ারে যবনিকাপাত। এমনকী চূড়ান্ত তর্কপ্রিয় ক্রিকেটলাভারও আটকে যান এই স্ট্যাটিসটিকসের ফাঁদে। বাংলা সাহিত্যে ক্রিকেটের অপার আকাশ দেখিয়েছিলেন মতি নন্দী। কল্পনার সুস্বাদে মোড়া। গৌতম ভট্টাচার্যের দুনিয়ায় তারকা প্লেয়াররাই কুশীলব। ঝরঝরে গদ্য, নির্মেদ কয়েনেজ আর অসম্ভব দ্রুতগতিসম্পন্ন চিত্রনাট্য, তাঁর হাতিয়ার।


ভূমিকার ১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় পাই, এই কটি লাইন। ডাগ আউটে পাশাপাশি বসে একজন প্লেয়ার আর একজনকে উত্সাহ দেয়, ক্যাপ্টেন খোলসা করে খেলার টেম্পো অনুযায়ী তার পরিবর্তিত ছক। ডাগ আউট দেখায়, প্রচণ্ডতম চাপের মুখোমুখি হয়ে মাইক্রোস্কোপে একএকজনের চরিত্র... এক কথায় মেডিক্যাল রিপোর্ট বানিয়ে দেয় প্রতি সদস্যের।


যাঁরা এখনও ক্রিকেট মানে ঝিঁঝি-ই বোঝেন, বর্তমান ক্রিকেটের কাব্য বিরাটপর্বে পৌঁছে গেলেও তাঁরা আদিপর্বে লটকে থাকেন, বড় জোর এক ছটাক গাভাসকার কিংবা এক সের সচিন জমানো তাঁদের ফ্রিজারে, সেইসব পাঠককেও পড়িয়ে নেওয়াটা লেখকের কাছে চ্যালেঞ্জ। ক্রীড়াসাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য যে-টেকনিকে পুরো ডাগআউট লিখেছেন, তাতে তাদের মনের মাঠেও ক্রিকেটের পিচ তৈরি হয়ে যাবে। ইতিহাসের আশ্রয় নিয়ে তিনি শুরু করেননি, শেষও করেননি। শুধু গল্পের ফাঁকফোঁকরে, ইংরেজিতে যাকে বলে বিটউইন দ্য লাইনস, সেখানে ভরে দিয়েছেন পরিমিত, জ্ঞাতব্য, অল্প অল্প গল্প কথা। যাতে নিতান্ত অশিক্ষিত পাঠকও তরতরিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন। ইনফর্মেশনের ভার বা ভয়, কোনওটাই পাঠককে কুণ্ঠিত না করে। যেসব সহজ কথা যায় না বলা সহজে। বহুদিনের অভ্যেস ও নিয়মিত শান-দেওয়া কলমে লেখকের কথার জাহাজ এমন চলতে থাকে, যেন ঠোঁটের অতি-স্বচ্ছন্দ।


তার চেয়েও বড় কথা, সম্পূর্ণ ক্রিকেট-অনভিজ্ঞ পাঠককে একটা আন্তর্জাতিকতার আস্বাদ দেওয়ার কাজ করছে ডাগআউট। গৌতমের কলমেই অনেক ক্রিকেটীয় পরিভাষা সংস্কৃতের মোড়ক ছেড়ে চলিত-গতি পেয়েছে তো বটেই, সঙ্গে রয়েছে সাতটি মহাদেশের অগণিত দেশ ও শহরে বসে ক্রিকেট কভার করবার অভিজ্ঞতা। কখনও লর্ডসে, কখনও শারজায়, কখনও সাউথ আফ্রিকায়। অনেক সময়েই এমন ঈর্ষণীয় একটি সাংবাদিক জীবন যখন জাবর কাটে (লেখকের ভাষায়) তখন আমিত্ব-ই প্রবল হয়, নির্বাচিত তারকারা হয়ে যান অতিথিশিল্পী। কিন্তু গৌতম এখানে ফোকাস হারাননি। পাঠকের কল্পনাকে দাঁড় করাতেই হবে ডাগআউটে। ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতার বিরাট বপু থেকে ঠিকঠাক রঙ নিয়ে পাঠকের জন্যে ক্যানভাস তৈরি করেন কজন? স্মৃতির পথ দিয়ে বরং এই ভূপর্যটনের কাহিনি, শুধুমাত্র ক্রিকেটকে, ক্রিকেটারদের উত্সর্গ করে লিখে আরও কিছুকিছু রেখে দিলেন। সম্ভবত, পরের এবং তার পরের বইয়ের জন্য। টুকটাক ভ্রমণপর্বের স্বাদ থাকবে সেখানেও।


যা হোক, এই জাহাজে মোট পনের জন। ব্লার্বে বলা- এক ফুট দূর থেকে যাঁদের নিয়মিত দেখেছেন এবং দেখছেন সাংবাদিকতার তিন দশকে। সংক্ষেপে লেখক যাকে বলছেন স্বপ্নের টিম ইন্ডিয়া। সে স্বপ্ন শুধুই আবেগমন্থিত বিনয়ভাষ্য নয়, যুক্তিগ্রাহ্যতায় সুঠাম। দুর্বলতাগুলো কাটছাঁট করে সঠিক লাইন আর লেংথের নিয়ার-পারফেক্ট টিম। নির্বাচকের চেয়ারে বসে নয়, প্রত্যেকের ক্রিকেটজীবন ডিসেকশন টেবলে ফেলে বাছাবাছির কাজটা সেরেছেন। এমন ম্যাচ-উইনিং টিম যা তিন ধরনের ফর্ম্যাটে জেতার মতোই। খেলতে পারবে উপমহাদেশ ও বাইরেও। ভূমিকাতেই যথাসম্ভব ক্লিয়ার করেছেন অতি-উত্সাহী পাঠকের সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর। কেন উপমহাদেশে খেলা হলে হ্যাডলি বাদ যাবেন, তাঁর জায়গা নেবেন স্টিভ ওয়। কেনই বা বিরাট কোহলির বিধ্বংসী পারফরম্যান্সের পরও ধোনিই থেকে যাবেন টি-টোয়েন্টি ক্যাপ্টেন। কেনই বা সচিন-সৌরভ থাকতে আধবুড়ো ইমরান হবেন টেস্ট ক্যাপ্টেন। ডাগআউট সাজালেন নিজের যুক্তিকাঠামোতেই। যেন তিনি জানেনই, বিরুদ্ধ মতামতের বারুদ কোন কোণ থেকে আসতে পারে!


তবে আবেগের সমুদ্রমন্থন না করলে কি এমন বই ওঠে?  গৌতমের লেখার ধরন শুধু পাঁচিলের উপরে বসে পর্যবেক্ষণের নয়, তিনি নিজেও এই মঞ্চে সশরীরে বর্তমান। কখনও মুচকি হেসে শেন ওয়ার্নের মহিলা-পটানো দেখছেন। যেটুকু দেখতে পাচ্ছেন না. সেটুকু কল্পনার কাগজ-প্লেনে উড়িয়ে দিচ্ছেন, অতিরিক্ত স্বভাবকৌতূহলী পাঠকের রসদ জোগাতে। টেনে বের করে আনছেন জাভেদ-ইমরানের অন্তরঙ্গ রসিকতা। তিনি সবার সঙ্গী। তিনি ডাকসাইটে প্রশ্নকর্তা, নিছক প্রশ্নের কাগজ হাতে ধরে নয়, চতুরভাবে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যান স্ক্রিপ্ট চেঞ্জ করে। কখনও তিনি দুই প্রজন্মের ভেতরের না-বলা কথাগুলোর ব্রিজ তৈরি করছেন। এই ডাগআউটেই দেখা বিরাটের চোখের জল। মলাটেও লেখকের সহাস্য, উজ্জ্বল উপস্থিতি। একেবারে অন্দরের খবর আছে এ বইয়ে, তার হাতছানি আছে মলাটেই!


তালিকায় প্রথমে ইমরান, শেষে কর্ণধার কোচ রাজ সিং দুঙ্গারপুর। অর্ডারটা কেন এমন হল, সে বিষয়ে যদিও বিশদভাবে জানাননি তিনি। কিন্তু কারণটা সহজেই অনুমেয়। একফুট দূরত্বে এসে ইমরানের সেক্স-অ্যাপিলে আটকেছেন লেখক। নারীর মতোই মুগ্ধতায়। ইমরানের অপ্রতিরোধ্যতা, চূড়ান্ত গতিময়তা তাঁকে টানছে ক্রিকেট ছাড়াও অন্যদিকগুলোয়। তাঁর ক্যানসার হাসপাতাল, তাঁর ইউনিভার্সিটি, সমাজকল্যাণমূলক কাজ। পাঠক চেহারা পাচ্ছেন এক পূর্ণ ইমরান খানের, এমনকি যাঁদের কাছে ইমরান ইতিহাস বা কুইজের প্রশ্নের গণ্ডিতেই শেষ, তারাও। অতি কঠোর নির্বাচকও মাঝেমাঝে ক্যাপটেন বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নিজের মনের নরম কোণটার ডাকে সাড়া দেন। একের বেশি যোগ্য খেলোয়াড় সামনে থাকলে। সাদা বাংলায় যাকে বলে পক্ষপাতিত্ব। ইমরান খান চ্যাপ্টারে লেখকের ঘটনা বর্ণনাক্রম এমনভাবে এগিয়েছে যে, এটা যে লেখকের প্রেমপর্ব, বুঝতে ফুটনোট লাগে না। হবে না-ই বা কেন?  নানা প্রতিকূল-অনুকূল পরিস্থিতির সঙ্গী তিনি। সফরসঙ্গীও। কাজেই, জানেন অনেকটাই। সানডে ম্যাগাজিনে লেখেন গৌতম, ইমরান খান টকস অ্যাবাউট নাথিং আদার দ্যান ক্রিকেট। সেই সাক্ষত্কার পড়ে পাক পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেয় সানডে ব্যান করবার। আবার কখনও অনুপুঙ্খ বর্ণনা মিয়াঁদাদের জবানিতে, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বন্ধু ইমরানকে বাঁচানোর। কোথাও লিখলেন কেন মনীন্দর সিংহ বন্ধ করেছিলেন ইমরানের অসম্মানসূচক মিমিক্রি, কোথাও বা ডিভোর্সী ইমরানের আত্মানুসন্ধান। কখনও লিখলেন, খেলা-ছেড়ে-দেওয়া ইমরানের ক্রিকেট নিয়ে সারগর্ভ দুটি লাইন- ওটা একটা অনুশীলন ছিল, যা আমার বাকি জীবনের জন্য তৈরি করে দিয়েছে। জাস্ট এইটুকু!


এহেন ব্যক্তিত্বকে ক্যাপ্টেন হিসেবে মেনে নেবেন কি আজকের প্রজন্ম? তবে সে প্রশ্নের জন্য উদার দরজা খুলেই রেখেছেন লেখক, কোথাও জোর করে চাপিয়ে দেননি মতামত। তবে গাওস্করের বেলা উপচে ওঠে কৈশোরের ভক্ত-সত্তা। ভক্তের দল যেভাবে নায়কের উপরেই বেঁধে রাখে তার যাবতীয় উচ্চাশা। শেষ পংক্তিতে লেখকের কলমে সেই উদ্বেল ভাবাবেগ। ২৫ বছর আগে লেখা সিলি পয়েন্ট থেকে-র উদ্ধৃতিই আবার তুলে দিচ্ছেন, যা পঁচিশ বছর পরেও একইরকম থেকে যাবে। নবীন, আগুয়ান সাংবাদিকদের যাবতীয় তর্কের একমাত্র ঢালই হবে বুকে লিখে রাখা গাওস্করের নাম। একই সঙ্গে গাওস্করের প্রতি অনুরাগ ও তাঁর টাইমলেস অ্যাপিল, দুটোই বোঝানো গেল। পিটার রোবাকের সঙ্গে সাক্ষাত্কারের সময়েও উঠে আসে তাঁর প্রসঙ্গ, যেখানে রোবাক বলছেন, ...যুদ্ধটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও গাওস্কর কেন নিজের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, আজ তো ইন্ডিয়ার কোনও কিছু ইংল্যান্ডের কাছে প্রমাণ করবার নেই। গাওস্করের হেলমেটহীন মাথা বীরেন্দ্র সহবাগের কাছেও যেমন অনুকম্পার, লেখকের কাছেও। তবুও তুলনার সংকেত তিনি টেনেছেন এখানে ওখানে। তাঁর মতে, মাস মার্কেটের অবিসংবাদী নায়ক ছিলেন না গাওস্কর। সে জায়গাটা এখন কপিলদেব, সচিনের দখলে। (ইদানীং বিরাট কোহলিরও) গাওস্করের পটচিত্রটা মেলে ধরার জন্য গৌতম স্মৃতি খুঁড়ে বের করেছেন জানা-অজানা নানা ঘটনা। যা অনেকের কাছেই সম্পদ হয়ে থাকবে, যাঁরা অনবরত ক্রিক-ইনফোর আশ্রয়ে বেঁচে আছেন পরগাছার মতো। তাঁরা কি কোনওদিনও জানতে পারতেন, কৈশোরে দেখা দেশ-জুড়ে দারিদ্র্য ও ফলস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর ডাক, সেটাই আসলে আমূল বদলে দিয়েছিল গাওস্করের খাদ্যাভ্যাস। কোনও নামীদামি ডায়েট বিশেষজ্ঞের প্রেসক্রিপশনে নয়!


তবে হ্যাঁ, তালিকায় ভিভ রিচার্ডস, রিচার্ড হ্যাডলিদের আগে কেন বীরু আসবেন, সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়নি। তবে ভিভ রিচার্ডসের কাহিনিতে আমআদমির প্রশ্ন অবশ্যই জাগবে, নীনা গুপ্তাকে নিয়ে। ইমরান পর্বে যেমন একটি পদ গুঁজে দিয়েছেন জিনাত আমনের প্রসঙ্গ তুলে। ভিভ রিচার্ডসের জীবনের এই পর্বটা নিয়ে লিখতে বসে খোলসা করে বলেছেন তাঁর চ্যালেঞ্জের কথা। আসা যাওয়ার মাঝখানে যে ব্যতিক্রমী অভিনেত্রীর সজল জীবনকাহিনি ছুঁয়ে গেলেন গৌতম, কৌতূহল অবসানের সঙ্গেসঙ্গে কয়েক ফোঁটা চোখের জলও যেন রেখে গেলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমাজে যা গ্রহণযোগ্য, ভারতীয় সমাজে প্রেম-জাত সন্তানকে প্রতিপালন করে সারাজীবন প্রেমকেই প্রতিষ্ঠা দেওয়ার মতো কঠিন কাজটা করলেন যিনি, সেই নীনা গুপ্তার জন্যেও।


খেলার দুই প্রতিশব্দ- ক্রীড়া এবং লীলা। শেষেরটির প্রতিই যে কৌতূহলের পাল্লা ভারি হবে তাতে সন্দেহ কী?  গৌতমের এই ডায়াস কিন্তু মোটেই নারীবর্জিত নয়। তাঁর নির্বাচিত নায়কদের নারীপ্রীতির দিকটিও তুলতে ছাড়েননি। এইসব নারীরা কখনও ‘অতিথি’-শিল্পী, কখনও পার্শ্বচরিত্র। বাইশ গজ বাদে অন্যত্র তাদের দর্পিত যাতায়াত। তাঁর স্বপ্নের টিমের মেম্বারদের সরাসরি সেসব রহস্যময়ীদের নাম নিয়ে জানতে চেয়েছেন রাখঢাক না করে। (যদিও সৌরভ, সচিন বা ধোনিকে রেখেছেন নিভৃত দূরত্বে!)এক বিশেষ পরিস্থিতিতে ওয়াসিম আক্রমকে জিজ্ঞাসা করেছেন, জনৈক গীতার কথা। যথেষ্ট উত্তর না পেয়ে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, মাঠের বাইরে কি আপনার উইকেটের সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে যে নামও মনে রাখতে পারছেন না!


সচিন সৌরভকে তিনি দেখেছেন বন্ধুর চোখে। এঁদের নিয়ে লিখেছেন তিনি বিস্তর। সচ, দাদাতন্ত্র তার একএকটি উজ্জ্বল উদাহরণ। তা সত্ত্বেও কিছু নতুন দেওয়ার বাকি থাকেই, এই বাকি-টা এখানে পূরণ করে দিলেন তিনি। সচিনের চ্যাপ্টারের নাম-ভালবাসার রাজপুত্র। তাছাড়া আর কীই বা হতে পারে নাম! ক্রিকেটের সৌরজগতে একটি গ্যালাক্সি তো তিনিই। সচিন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি কখনও বিশ্লেষণাত্মক। কখনও বা ভরেছেন অন্যান্য মুগ্ধ সেলিব্রিটির কোট নিয়ে।


সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় চ্যাপ্টারের ভিত্তিতে যদি সূচিপত্রটা তৈরি হত, তবে সবার প্রথমে জায়গা পেতেন যিনি, তিনি গ্রেগ চ্যাপেল। এই পর্ব পড়ার অভিজ্ঞতাটা এক কথায় আইকনোক্লাস্টিক। এক সময়ে গোটা দেশ যাঁকে ভিলেন ঠাউরেছিল, তাঁর এমন মধ্যবিত্ততা, উদারচেতা চেহারাটা দর্শক-পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্যে কব্জির জোর চাই। পরিবর্তিত আধুনিক সময়ে গ্রেগ চ্যাপেলকে নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ যে আছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যে ভারতীয়ের আত্মিক সম্পর্ক, তা ধরা দেয় স্টিভের চ্যাপ্টারেও। মাদার টেরিজার অনুপ্রেরণায় তিনি শুরু করেছিলেন উদয়নের কাজ। আজও তাঁদের কাছে তিনি স্টিভদাদা।


কিন্তু ধোনি-তে এসে মন ভরে না। ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীর একাংশ যে তাঁর আনটোল্ড স্টোরি একেবারে রুপোলি পর্দায় দেখে ফেলেছে। স্বয়ং লেখকও তা নিয়ে উপন্যাসোপম রিভিউ লিখেছেন। এর পরের না-বলা কথা বলতে গেলে আরও মশলা চাই। চাই আরও চুম্বক। বরং তাঁর লেখনীতে উঠে এল স্থিতধী, তীক্ষ্ণদৃষ্টির এক বলিষ্ঠ ক্যাপ্টেন। ২৮ বছর পর যাঁর হাতে উঠেছিল বিশ্বকাপ। আর ক্যাপ্টেন কুল তাঁর পরদিনই ডিগ্ল্যামারাইজড। মাথা ন্যাড়া করে চলে এসেছেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটসাহিত্যে নিরুচ্চারে তাঁর নাম অবশ্যই লেখা থাকবে।  


বিরাট কোহলির চ্যাপ্টারটাকে বলা চলে ক্লাইম্যাক্স। ধুন্ধুমার অ্যাকশন প্যাকড। ফর্মুলা ভেঙে নয়া কোনও আমদানী। বিরাট বলেই সম্ভব এমন উজ্জ্বল দিনের স্বপ্ন দেখা। পরের পর শত্রুনিধনযজ্ঞ। অধুনা জেনারেশনের কাছে মাহি আর বিরাট, এই দুজনই আইকন। এক জায়গায় লেখক লিখেছেন, নিজের কন্যার উদাহরণ দিয়ে নতুন জেনারেশন নিজেদের মতো করেই নির্বাচন করে নেয় তাদের নায়ককে। যে যতই বিখ্যাত হোক, যতই উজ্জ্বল হোক স্কোরবোর্ড, ছেড়ে যেতে একদিন হবেই। নবীনকে দিতে হবে পথ ছেড়ে। পরক্ষণেই জানিয়েছেন, মশালটা নবীনের হাতে দিলেও নবীন শ্রদ্ধাবনত থাকে প্রবীণদের কাছে। কেননা তাঁদের দেখেই তো ক্রিকেট চেনা! তাই চোখের জল মুছতে মুছতে বিরাট কোহলি আসেন অবসরপ্রাপ্ত সচিনের কাছে। সচিনও ছুটে যান খেলা থেকে বিরতি-নেওয়া গাওস্করের ঘরে।


রুপোলি পর্দার মতোই  এক জমজমাট চিত্রনাট্যে এক এক করে অবতীর্ণ তাঁর তারকারা। টি-ব্রেক, লাঞ্চ-ব্রেক ব্যতিরেকেই ভরপুর ক্রিকেট-ময় চলচ্চিত্র। ঝলমলে বিরাট-পর্ব আর গম্ভীর রাজ সিং দুঙ্গারপুরের নির্মেদ আলেখ্য শেষ করে মনে হবে... মনে হওয়ার কিছু নেই, আত্মবিশ্বাসে ভর করে লেখক নিজেই লিখে দিলেন-


ডাগআউটের কথা অমৃতসমান!


অর্থাত্, যে সব পুণ্যার্থীর দল এতক্ষণ মন দিয়ে বইটি পড়েছেন তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে অমৃত ভরে নিতে পারবেন আপন-আপন কুম্ভে। হতে পারেন কেউ সচিন, কেউ কপিল, কেউ সৌরভ, কেউ বিরাট কোহলির ফলোয়ার। সফেন ফ্যানসমুদ্রে আরও বেশি করে রঙিন রঙিন জাহাজ ছেড়ে দিয়ে সমাপ্তি টেনেছেন লেখক।


রিচার্ড হ্যাডলির এপিসোডে এই গৌতমই লেখেন, বিজয়ীরা কখনও ক্লান্ত হয় না। তারা সুখের বিশ্রাম নেয়। কাজেই, ভূমিকার শুরুর লাইনগুলোয় পদত্যাগপত্র টাইপ করার মনমরা অভিজ্ঞতাটুকু না থাকলেও তো চলত! তবুও যখন লেখা শেষ, আর ছেপে বেরনোর পর মারকাটারি বেস্টসেলার হয়েও গিয়েছে ঝকঝকে সবুজ মলাটের ডাগআউট, তখন ওটুকুকে নিমপাতাভাজা-র মতোই জ্ঞানে জিভে লাগাবেন ক্রিকেট-ভুকরা।


তেতো পেলে তবেই না স্বাদ খোলে!


আরও পড়ুন, রইস বড়ই অসহিষ্ণু, কালস্রোতে রইবে কি?