এক নাম না জানা মেয়ের কথা


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

অন্তরা সাঁতরা


 


আমি এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ মেয়ে ছিলাম। পড়াশোনায় খুব ভালো না হলেও খারাপ ছিলাম না। জীবনের লক্ষ্য ছিল বড়ো হয়ে মানুষের জন্য কিছু করার। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করার পর আমি কলেজে  ভর্তি হলাম। সবার মতো আমিও প্রেমের প্রস্তাব পাই, তবে বরাবরের মতোই এসব থেকে দূরে থাকি। কলেজ কমপ্লিট হতে যখন ৮ মাস বাকি তখন বাবা আমার বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু করেন। আমি বিয়ের জন্য মোটেও তৈরি ছিলাম না। অনেক কান্নাকাটি করে কলেজ কমপ্লিট হওয়ার পর বাবাকে বিয়ে দেবার জন্য রাজি করাই।


আমার বিয়ে ঠিক করেন এক শিক্ষিত ধনী ইনঞ্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে। বিয়ের সময় শুনলাম ছেলে নাকি কাজের সূত্রে বাইরে থাকে। কথাটা শুনে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। কারণ আমার বাবা আমায় ছাড়া থাকতে পারত না। তিনি বলতেন,"আমি আমার মেয়ের বিয়ে এত কাছে দেব যেন দুবেলা গিয়ে দেখে আসতে পারি।” আমি তাদের কাছে ঠিক কতটা বোঝা বা দায়িত্ব ছিলাম সেটা ভেবেই আমার মুখে বেদনার হাঁসি ফুটে উঠল।


বিয়ে করে যখন আমি নিজের স্বামীর বাড়িতে পা রাখলাম সবার মতো আমারও এক অজানা অনুভুতির সঙ্গে পরিচয় হল। আমার ইচ্ছা ছিল শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আমার মা-বাবা হবে। কিন্তু আমার শ্বশুর প্রতিবার আমায় মনে করিয়ে দিতেন আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।হাসি মুখে সব কিছু সহ্য করতাম। কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি কিছু বলতেন না। তিনি ছিলেন খুবই চুপচাপ তার কারণ আমি তখন বুঝতে পারতাম না। অষ্টমঙ্গলার পর আমার স্বামী আমায় নিয়ে তার কাজের জায়গায় পাড়ি দেয়। রোজ সকালে উঠে তার জন্য খাবার বানাতে হত। তিনি চুপচাপ খেয়ে চলে যেতেন আর ,রাত করে বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। যেন আমার থাকা বা না থাকা তার কাছে কিছুই নয়। আমাদের মাঝে কোন রকম সম্পর্ক ছিল না। আমি তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারিনি। বরং আমি যেন তার বাড়ির কেয়ারটেকার ছিলাম। একদিন হঠাৎ করেই আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এলেন। শুনলাম আমার স্বামীর কাজে কিছু সমস্যা হয়েছে। আমার শ্বশুর আমায় ডাক দিলেন কিছু দরকারি কথা আছে নাকি তাঁর আমার সঙ্গে। 


আমি যাবার পর শ্বশুর বললেন," দেখ স্বামী মেয়েদের কাছে সব, তোমার উচিত তোমার স্বামী কে সাহায্য করা। তো ও যা বলছে সেটা মেনে নাও।" আমি তাদের কথা কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তারপর আমার স্বামী যা বলল সেটা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বলেন," আমার বসের তোমায় পছন্দ। তিনি এক রাতের জন্য তোমায় চায়। এখন তুমি রাজি না হলে আমার চাকরিটা চলে যাবে ,আর প্রচুর লোন নেওয়া আছে সেগুলো শোধ না করতে পারলে আমার জেল পর্যন্ত হতে পারে। এমনিতেও তো একটা রাতেরই ব্যাপার।"


আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। একটি কথাই মাথায় আসছিল "এরা কি মানুষ!" আমার স্বামীর এত সুন্দর চেহারার মাঝে এত নোংরা রুপ ছিল আমার কল্পনার বাইরে। আমি না বলেও সেদিন নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি ।সেদিন রাতে আমার স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি সবার উপস্থিতিতে আমার ঘরে তার অফিসের বস প্রবেশ করে ছিল।


'ধর্ষণ' নিয়ে অনেক কবিতা, লেখা পরলেও সেদিন আমি নিজে সেই যন্ত্রণা অনুভব করেছিলাম। চিৎকার করেছিলাম খুব কিন্তু কেও বাঁচাতে আসেনি । একসময় সবকিছু শান্ত হয়ে গেল।


নিজের কাজ সম্পন্ন হবার পর বস আমার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল "কালকের জন্য তৈরি থেকো। আজ আমার তাড়া আছে।" 


লোকটি চলে যাওয়ার পর , আমার বর আমার হাত থেকে টাকা গুলো নিয়ে চলেই যাচ্ছিল‌, কি মনে করে আবার ফিরে এসে আমার গা থেকে চাদর টা সরিয়ে আমার শরীরের তৈরি হওয়া কামড় আর আঁচরের দাগ গুলো দেখে ড্রয়ারের কাছে গিয়ে একটা মলম এনে বলল," সরি সোনা, এছাড়া আমার যে আর কিছু করার ছিল না। এই মলম টা লাগিয়ে নাও ঠিক হয়ে যাবে কেমন? "


তার কথা আমার কাছে কাঁটার মতো লাগছিল। কিছু কখন আগের কথা ভাবতেই আমার গা-গুলিয়ে উঠেছিল। বাথরুম যাবার জন্য পা বাড়ালাম।আমি উঠে দাঁড়াতেই পরে যাচ্ছিলাম, কেও একজন ধরে ফেলায় বেঁচে গেলাম। পেছন ফিরে দেখলাম আমার শ্বাশুড়ি, তার চোখে জল। তার চোখের জলের কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম না! আমায় কিছু বলতে না দিয়েই তিনি বলেন,"আমি জানি তুমি খুব দুর্বল কিন্তু, আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। আমাদের এখুনি বেরিয়ে যেতে হবে। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।" শাশুড়ির কোনো কথা আমার মাথায় ঢুকছিল না। তাও নিজের অবাক কাটিয়ে আমি তৈরি হয়ে আসতেই শ্বাশুড়ি আমায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলেন এক অজানা গন্তব্যে। ট্রেনে উঠে জিগ্গেস করলাম আমারা কোথায় যাচ্ছি তিনি বলেছিলেন, "জানি না" হঠাৎ,তার ব্যাগে আমার সব সার্টিফিকেট দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম।


শ্বাশুড়ি মা তখন বলেছিলেন, “এরা মেয়েদের শিক্ষার কোন দাম দিতে জানে না। এদের কাছে মেয়েরা দরকারের বস্তু। আমার ছেলেটাকেও খারাপ করে দিল।” আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম দেখে কান্না-মিশ্রীত কন্ঠে বলেন," আমিও তোমার মত ছিলাম। তোমার মত আমাকেও এমন স্ত্রী হবার মূল্য দিতে হয়েছিল। মেয়েরা এদের কাছে শুধু শারীরিক চাহিদা মেটানোর বস্তু। আজ তোকে বাঁচাতে পারিনি তা বলে রোজ মরতে দিতে পারিনা, তাই তোকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।" আজ আমি তৈরি হয়েছি নিজের পছন্দ মতো— নীল শাড়ি, কপালে ছোট্ট কালো টিপ, হাতে ঘড়ি। স্বামীর দেওয়া কোনো সাজ আমার নাই, শুধু শরীরের সেই দাগ গুলো ছাড়া। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল এখন শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কোনো কাজ নাই। আজ এসব পুরোনো কথা থাক। অনেক লোকজন আজ আমার জন্য অপেক্ষা করছে! কেন অপেক্ষা করছে তাই ভাবছেন তাই না!


আমার বয়স এখন ৩০, নামটা নাহয় আর নাইবা বললাম। ৩ বছর হল আমি একটা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছি, আমি আর আমার শাশুড়ি মা।আমার শ্বাশুড়ি মা মারা গেছেন ২ বছর হল ।তাঁরই উদ্যোগে এই সংস্থার জন্ম। আমার মতো অনেক মেয়ে এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। আমার অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সর্বদা উপস্থিত থাকি। আমাদের সংস্থার এখন খুব নাম ডাক। মেয়েদের মধ্যে স্ব-নির্ভর করা, অসহায় দের আশ্রয় দেওয়া, অন্যায় এর বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিবাদী হয়ে ওঠা আমাদের কাজ।


আমার মা-বাবার খবর আমি জানি না।আজ হয়ত তারা আমায় দেখবে টিভির পর্দায়। আজ সমাজের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলতে চাই,  "মেয়েদের ও সুযোগ দিয়ে দেখ তার সুযোগ পেলে সমাজের মাথা হতে পারে । মেয়েরা দুর্বল নয়, নয় কারো কাছে বোঝা ।" মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। মা-বাবা যতই চেষ্টা করুক তবুও হেরে যায় তারা। অবশেষে মেয়েদের সুখের কথা ভেবে বিয়ে দেয় বড়োলোকের বাড়িতে,কখন কখনও যার পরিণতি হয় বেদনাদায়ক। আচ্ছা এর জন্য কারা দায়ী,বাবা-মা, সন্তানরা, না এই ভেদাভেদ, বৈষম্য যুক্ত সমাজ ? এক শ্রেণী কেবল খেটেই মরে, আর এক শ্রেণী ভোগ-বিলাসে দিন কাটায়! আচ্ছা, এ সমাজ গঠনের নিয়ম কি কোনোদিন পরিবর্তন হবে না ? 


পড়ুন, বাঙালির প্রাণের উৎসবে আমার 'e' উৎসব। Zee ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল শারদসংখ্যা   


 


 (Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)