দিব্যেন্দু ঘোষ


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

বাস্তব যখন যেমন


এ প্রকৃতি আমার যেমন, তেমনই তোমার, তেমনই ওদের। অথচ ওদের ব্রাত্য করে, বনজঙ্গল থেকে খাবারের টেবিলে তুলি আমরা। আমরা মানুষ। সভ্য বলি নিজেদের। কিন্তু জঙ্গলের তথাকথিত অসভ্যরা আমাদের নামের পাশ থকে সভ্য তকমা কেটে দিয়ে কান ধরে শিক্ষা দিচ্ছে। কারণ আমরাই মানুষ ও বন্যপ্রাণীর লাইন অফ কন্ট্রোল লঙ্ঘন করেছি। উহানের মাংসের বাজারে যথেচ্ছ বাদুড়, প্যাঙ্গোলিন, নেকড়ের ছানা, হরিণ, ময়ূর, শেয়াল, বেড়াল, স্যালম্যান্ডার, ইঁদুর, সজারু, বাঁদর, শিম্পাঞ্জি, সাপের আঁশ ছাড়ানো হয়েছে। ভাইরাস তাই আমাদের শরীরময় তাথৈ নৃত্য জুড়েছে। আমাদের লকডাউন। আর জীব-জানোয়ারের লক-ফ্রি। বন্যপ্রাণীরা ফিরিয়ে নিতে এসেছে তাদের অধিকার।


পরিবেশ সময় পাচ্ছে নিজেকে সুস্থ করে তোলার। পৃথিবী কাটিয়ে নিচ্ছে তার ক্লান্তি। পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেক কম। কমেছে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলির নির্গমণের পরিমাণ। দূষণকে হারিয়ে প্রকৃতি তাই খিলখিলিয়ে হাসছে।



জলন্ধর থেকে কাংড়া উপত্যকার ধৌলাধর পর্বতমালা। দূরত্ব ২১৩ কিলোমিটার। কল্পনাই ছিল। লকডাউনে সেটাই বাস্তব। স্বচ্ছ নীল আকাশ রূপমতী হয়ে ফিরবে চোখে, কে জানত। আকাশের বুকে অদ্রি। আমাদের চোখকে অন্ধ করে রেখেছিল দূষণ। সে দূষণ কেটে পর্বতের কোলে বরফের মাখামাখি। সূর্যের সোনালি ওমে আকাশজুড়ে নীলাভ দ্যুতি। বারান্দায় বসে তুষারাবৃত পর্বতমালাও বোধহয় বিপর্যয়ের বুকে সপাট চপেটাঘাত। সভ্যতার উত্‍পীড়নে বিরতিরেখা গাঢ় হওয়ায় প্রকৃতি হাসছে, খেলছে, সুখ কুড়োচ্ছে, ফিরিয়ে দিচ্ছে রূপ-রস-গন্ধের আশাদ্রবণ। বসন্ত বিদায় নেয়নি। সে-সুধায় মাখামাখি প্রকৃতি। সেদিন চৈত্র নয়। ডান্সিং ডল ফ্লাওয়ারে ভ্রমরের আকুতি, ঠিক যেন প্রেমিকের গালে প্রেমিকার ভীরু ছোঁয়া। ভেনেসুয়েলান মাউন্টেন রোজ যেন মন-বসন্তের লালিমা বয়ে বেড়াচ্ছে প্রকৃতির কোলে চেপে। প্রকৃতির বন্ধ দরজার ওপারে সৌন্দর্যের বিস্ফোরণ বারংবার, অহরহ। আমেরিকায় লাটে উঠেছে চেরি পর্যটন। তবে মেপল গাছে গোলাপি কুঁড়ির দল প্রাণপ্রাচুর্যে এলোমেলো, মত্ত। পাতাঝরা ডালে ডালে চেরির সাম্রাজ্য। ইয়েলো ফ্লেম বায়ান্ট যেন ঘোমটার আড়ালে প্রেমিককে কাছে ডাকছে।



নির্দ্বিধায় আপন মেজাজে রংবাজি পাহাড়ি ময়নার। ডাহুক, জলপিপি, মুরহেনের কোলাহলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলদরিয়া মন। বসন্ত বৌরী, নীল ল্যাজা বাঁশপাতি, দুধরাজ, রেখা বসন্ত, হুপোর কলতান কানে বাজছে। কই এমন করে কখনও গাইতে শুনিনি কোকিলকে। এত প্রাণখোলা, মেঠো সুরে। বারান্দার ওপারে মেহগনি গাছ বেয়ে কোনওদিন তো এমন করে গড়িয়ে পড়তে দেখিনি প্রকৃতির উদারতা। সবুজ ঝরে গিয়ে শুকনো পাতাদের ভিড় করার সময়। সেই সবুজই যেন চুঁইয়ে পড়ছে ইন্ডিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার, ব্লু থ্রোটেড বারবেট, লিনেটেড বারবেট, গোল্ডেন ওরিওলির কুহুতানে।


     


 মানুষ ঘরে বন্দি। খাঁ-খাঁ রাস্তায় তাই হরিণ-দলের যাকে পাবি তাকে ছোঁ। একসময়ের যান-ভরা রাস্তাতেও নীলগাইয়ের কত নিশ্চিন্ত পথচলা। ভরা রাস্তায় বিলুপ্তপ্রায় গন্ধগোকুল কেমন লুকোচুরি খেলতে মত্ত। ভেনিস থেকে ভিন্দেরওয়াল, মানুষের হাতে ধ্বংস হতে বসা প্রকৃতি নিজেই নিজের ক্ষত সারিয়ে তুলছে। অসময়ে মানুষহীন পৃথিবীতে সক্রিয় প্রকৃতি। মানুষহীন, যানহীন শহরে দূষণের দাপট অস্তমিত। ইতালির গ্র্যান্ড ক্যানালের ঘোলাটে জল স্বচ্ছ হয়েছে। সেখানে উঁকি দিয়েই পালিয়ে যাচ্ছে ডলফিন। ভেনিসের বুরানোয় ডানা মেলছে রাজহাঁস। আগেও ডানা মেলত। তবে, এমন রাজকীয়তায় নয়, এমন স্বকীয়তায় নয়, এমন রূপঐশ্বর্যের ডালি নিয়ে নয়। সাহস বাড়ছে। বুকভরা সাহস। আর একবুক বিশুদ্ধ বাতাস। দেরাদুনের পথেঘাটে তাই দৌড়ে বেড়াচ্ছে হরিণের দল।


আরও পড়ুন- শ্যামবাজারে সজারু, উল্টোডাঙায় উল্লুক, পার্ক স্ট্রিটে প্যাঙ্গোলিন! সত্যি সত্যি সত্যি


 মানুষ তো নিজের স্বার্থেই প্রকৃতিকে ক্ষতবিক্ষত করে। ধ্বংসের লীলাখেলা চলে সবুজের বুকে। বিপন্নতার চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকে বণ্যপ্রাণ। লকডাউনে মানুষের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই ফের বন্যেরা শহরে সুন্দর। সহাবস্থানের পাঠ দিচ্ছে লকডাউন। অসময়ে নীরবে সহাবস্থানের বার্তা দিচ্ছে প্রকৃতিও।