দিব্যেন্দু ঘোষ


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

তোর বুঝি ভেঙে গেছে পুতুল খেলার সংসার,


সময় দেখবি সব জোড়া লেগে যাবে


চুপ কর বোকা মেয়ে কাঁদিস না আর


মেলায় কাটার দাগ জোড়া লাগে ফাটা


জটিলতা হয়ে যায় খুব সাদামাটা


চুপ কর বোকা মেয়ে কাঁদিস না আর


“মহিমা”র সংসারে কবীর সুমনের গানটা বড় তেজিয়ান। কিশোরীদের গালে আড়মোড়া ভাঙে সুখী উপত্যকা। খিলানের গা বেয়ে সময় বয়ে চলে। সময়ের সেই টিকটিক শুনতে ভারী বয়েই গেছে ওদের। ফেলে আসা শ্বাপদসঙ্কুল সমাজের দিকে উত্থাপন করে শাণিত তরবারি। ওরা আজ সব পেয়েছিল খেলাঘরে খেলনাপাতি সাজায়। জীবনের খেলাঘর বাঁধতে শেখে। নিস্তরঙ্গ নয়। বরং কোলাহল-জর্জর পরশমণিতে ওরা আচ্ছাদিত। ওদের কাছে এটাই বেঁচে থাকা, জেগে ওঠা। আজ ওরা আপন মহিমায় মহিমান্বিত।


পরিবার। পড়শি। দারিদ্র্য। অসহায়তার সুযোগ। গ্রাম থেকে শহর। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে বিছানা। মন-শরীরে ধামসানো কালশিটে। উদ্ধার। আলো। জীবনবোধ। সংস্কৃতি-চেতনা। উচ্চশির। টানটান শিরদাঁড়ায় সংগ্রামের সাহজাত্য। লড়াই জেতার আনন্দ। অদৃশ্য সুতোগুলো একের পর এক গেঁথে চলে মহিমা। কোনও এক নারী নয়, এক সমবেত নারীশক্তি। অন্ধকার থেকে আলো চেনানোর পাঠশালা। অন্যায়-অত্যাচার ভেঙে দাপিয়ে বেড়ানোর আনন্দ আশ্রম। সেই আশ্রমিকদের দেখতে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পা রেখেছিলাম মহিমা-য়।


যে চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে আনন্দ ভেসে বেড়ায়। খেলে বেড়ায় বিভাবরী সুখ। সব ভালর আয়োজন স্মিতা সিংয়ের হাত ধরে। আর সঞ্চয়িতা ওই শিশু-কিশোর-তারুণ্যের সমাজমনস্কতা জাগিয়ে তোলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে। পাচার হয়ে যাওয়া কিংবা দিনের পর দিন যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হতে, শরীর-মনে নিঃস্ব হতে থাকা কিশোরীদের নাচের ছন্দে জীবনের পাঠ দেন। “যখন তোমার ভাঙবে ঘুম” কিংবা “বাঁধ ভেঙে দাও”-এর মতো ডান্স ড্রামায় ওই মেয়েরাই জাগিয়ে তোলে আগল ভাঙার ধ্বনি। নাচের মধ্যে দিয়ে শিক্ষা, চেতনা ও সঙ্ঘবদ্ধ মনের দিনলিপি লিখে দেন সঞ্চয়িতা। স্মিতা সিং, সঞ্চয়িতা হালদারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় শুনে আসা কথারা মনে ঢেউ তুলল। কঠিন অথচ পেলব, দৃঢ় অথচ আন্তরিক কয়েকটি মুখের দিকে তাকিয়ে অজান্তেই কলমের ডগা বেয়ে গড়িয়ে এল কালি। লেখা হল দুটি গল্প। কল্পনা নয়, একান্তই বাস্তব। গল্প নয়, আটপৌরে সত্যি।


ওদের কথা


সাঁইথিয়ার মেয়েটি 


বীরভূমের সাঁইথিয়া। শহর ছাড়িয়ে নিস্তব্ধ গ্রাম। প্রত্যন্ত পরিবেশ। কতই বা বয়স মেয়েটার! বড়জোর এগারো। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝতে থাকা পরিবার অল্প বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। স্কুল, বই-খাতা, লেখাপড়া তো ওদের কাছে শুধুই স্বপ্ন। শিক্ষার আলোহীন মেয়েটার শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হল না। কারণ, তার গায়ের রং কালো। এ কেমন অস্থির সমাজ, এ কেমন অসুস্থ সংসার। কালো বউ, তাই স্বামীর সংসারে ঠাঁই নেই। ফিরে এল, বলা ভাল ফিরিয়ে দেওয়া হল বাপের ঘরে।


খুব আদরে থাকা হল না। শুরু হল পাড়া-পড়শির ফিসফাস। সব উপেক্ষা করেও বাবা-মা কাছছাড়া করেনি মেয়েকে। কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎই মেয়েটির সঙ্গে কার্যত যেচেই আলাপ জমায় ওদের গ্রামেরই এক মহিলা। কলকাতায় কাজে লাগিয়ে দেবে বলে ভাব জমায়। কাজের আশায় বারো বছরের মেয়েটি ওই মহিলার হাত ধরে। সেই হাত অন্ধকার গলিতে আছড়ে ফেলে মেয়েটিকে। সোনাগাছিতে বিক্রি করে দেয় ওই মহিলা। তারপর শুধুই অত্যাচারের রাত, ঘৃণার রাত, পাপের রাত। ঘন অন্ধকার ভেদ করে প্রায় প্রতি রাতেই বিছানায় নরম কৈশোর নিয়ে লোফালুফি খেলে নিত্যনতুন পুরুষ। বছর দুই এভাবেই কেটে যায়। একদিন পুলিস রেইড করে। উদ্ধার হয় মেয়েটি। তাকে একটি হোমে রাখা হয়। মেয়েটি তখন অন্তঃসত্ত্বা। সন্তান নষ্ট করতে চায়নি। ওই বয়সে মা হওয়ার ঝক্কি। বোঝার বয়সও তো নয়। তবুও মা হতে চায় সে। আপ্রাণ কাঁদে। প্রার্থনা করে। এ সন্তান আমার, আমি মা হতে চাই। শেষমেশ মা হয় সে। জন্ম দেয় ফুটফুটে পুত্রসন্তানের।



শুরু হয় এক নাবালিকা মায়ের জীবনসংগ্রাম। বুকে বল জোগাতে থাকে মহিমা। সন্তানকে শক্তি জোগাতে থাকে মা। বড় হতে থাকে মা ও সন্তান। মনের পূর্ণতা দিতে থাকে মহিমা। সেলাই শিখতে থাকে মা। স্কুলেও ভর্তি হয়। তবে ছেলের সঙ্গে একই স্কুলে ভর্তি হতে চায়নি। পড়়াশোনা থেকে দূর দ্বীপ বাসিনী হয়েই থাকতে চেয়েছিল। হাতের কাজ শিখছিল মন দিয়ে। কিন্তু স্মিতা দেবী তাকে লেখাপড়া শেখাবেনই।


আরও পড়ুন- একদিনের ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যেতে চান? উইকএন্ডে ঘুরে আসুন হেনরি আইল্যান্ড


আজ সে পঁচিশের যুবতী। একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। ব্যাগ, যোগা ম্যাট বানায়। ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে। মহিমা-র বয়েজ হস্টেলে থাকে। মা তাকে মাঝে মাঝেই দেখে যায়। কাজ করে পয়সা জমিয়ে সাঁইথিয়ায় নিজের গ্রামে ছোট্ট জমি কিনেছে। বাবা-মাকে টাকা পাঠায়। আরেকটু রোজগার বাড়াতে হবে। আপ্রাণ চেষ্টা করে সেই কালো মেয়েটি। ছোট্ট একটা নীড়, একান্তই নিজের, যেখানে ছেলেকে নিয়ে থাকবে। স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে সমাজ-বধের শাণিত তরবারি হাতে ছুটে চলেছে সাঁইথিয়ার কুঁচবরণ কন্যা।


যে মহিলা মেয়েটিকে কলকাতায় এনে সোনাগাছিতে বিক্রি করে দিয়েছিল, তাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিস। সাত বছরের জেল হয়। মামলা শেষে সাঁইথিয়ার মেয়েটি তিরিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল। মহিমা-র দরাজ দিলখোলা আলো-ঝলমলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়েটির পরিচয় জানতে চেয়েছিলাম। দৃপ্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়, আমি একজন মা। এটাই আমার পরিচয়। আমার ছেলে আমার পরিচয়েই বাঁচবে। ওকে আমি অনেক বড় করব। ঠোঁটের পাশ দিয়ে জেদ ঝরে পড়তে দেখলাম।


যাদবপুরের মেয়েটি


ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস সেভেন। মাত্র ৬ বছর বয়সেই বাবা মারা যান। মাও মানসিক রোগী। ছোট্ট দরমা ঘেরা ঘরটায় ঠাকুমাই বড় করে তুলছিল দুই বোনকে। পড়াশোনায় তুখোড়। কোনওমতে দুবেলা দুমুঠো কিন্তু মেধাকে দমাতে পারেনি। টালির চাল আর ম্যাড়মেড়ে দাওয়ার প্রায়ান্ধকার গৃহকোণ থেকে শিক্ষার আলো তেড়েফুঁড়ে বের হতে সময় নেয়নি। হঠাৎই জীবন বয়ে গেল অন্য খাতে। এক মহিলার সঙ্গে পরিচয়। কিছু দূরেই বাড়ি সেই মহিলার। রাস্তায় একদিন যেচেই আলাপ করল মেয়েটির সঙ্গে। মাঝে মাঝে বাড়িতে ডাকতে থাকল। এটা ওটা খাওয়ানোর লোভ দেখাত।


নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসারে ভালমন্দ খাবারদাবার মেয়েটির মন কিছুটা হলেও বিচলিত করে দেয়। স্কুল ফেরত সেই মহিলার বাড়িতে মাঝে মাঝেই চলে যেত। কখনও সখনও বোনের জন্যও এটা ওটা পাঠিয়ে দিত মহিলা। মেয়েটিকে যেন বশ করে ফেলল সেই মহিলা। ঘন ঘন যেতে থাকল মেয়েটি। ভালমন্দ খাবার খাওয়াত মহিলা। সেই খাবারে একটু একটু করে নেশার জিনিস মিশিয়ে দেওয়া হত। ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি মেয়েটি। একদিন মহিলার বাড়িতে খাবারের সঙ্গে মিশল কড়া ডোজের ওষুধ। নেতিয়ে পড়ে মেয়েটি। তার পর যৌন নির্যাতন। সেই বাড়িতেই অপেক্ষা করছিল এক মাঝবয়সী পুরুষ। অনেক টাকা দিয়েছিল সেই মহিলাকে। তার বিনিময়ে কচি আনকোরা শরীর।



এরপর শুরু হল ব্ল্যাকমেল। ফোন করে মেয়েটিকে ডেকে নিত সেই মহিলা। লজ্জা, ঘেন্না আর অপরাধবোধ কুরে কুরে খেতে থাকল মেয়েটিকে। কাউকে কিচ্ছু বলতে পারেনি। দিনের পর দিন চলতে থাকল এই ঘটনা। একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। এক বান্ধবীকে সব খুলে বলল সে। পুলিসের কানে খবর যেতে বেশি সময় লাগেনি। অ্যারেস্ট ওই মহিলা। অ্যারেস্ট হয় আরও বেশ কয়েকজন। মেয়েটির বয়স তখন পনেরো। দিনের পর দিন যৌন নির্যাতনে মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলছিল মেয়েটি। মহিমা-র সংসারে ঠাঁই হয়। ছোট্ট বোনটিও বিপথে চলে যেতে পারে চিন্তা করে তাকেও মহিমা-য় নিয়ে আসেন স্মিতা দেবী।


আরও পড়ুন- এক লাফে ৩৯, কেরলের এক পরিবারের ৫ জনের শরীরে মিলল করোনা ভাইরাস


সঞ্চয়িতার হাতে পড়ে মেয়েটি। একটু একটু করে নারীশক্তি চেতনার রঙে পান্না আর চুনীর মতো রেঙে উঠতে থাকল মেয়েটি। অসম্ভব ভাল নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ। সঞ্চয়িতার ডান্স থেরাপিতে সাড়া দিতে থাকল মেয়েটি। ছন্দময় শরীরে জীবনীশক্তি উদ্বেল হয়ে উঠতে সময় লাগেনি। ২০১৮-র নৃত্যনাট্য “যখন তোমার ভাঙবে ঘুম”-এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করল মেয়েটি। দিনের পর দিন রিহার্সাল আর তারপর দৃষ্টিনন্দন ও শ্রুতিনন্দন উপস্থাপনা। একের পর এক শো। একের পর এক প্রশংসা। ততদিনে অবশ্য ফের পড়াশোনা শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষায় প্রথম, ডান্স ড্রামাতেও দুরন্ত অভিনয়। প্রতিভার বিচ্ছুরণে ম্লান হয়ে যাচ্ছে অতীত। মন খুলে হাসছেন সঞ্চয়িতা। তিনি পেরেছেন। অন্ধকার থেকে আলোয় আনতে পেরেছেন। এখন মেয়েটি ক্লাস ইলেভেন। চারটে লেটার নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে। এখনও অনেক পথা চলা বাকি। শুধু যাদবপুরের মেয়েটি নয়, এমন আরও অনেক মেয়ের শরীরে নাচ-গানে বুনে দিতে হবে বীরত্বের আলো, সাফল্যের আলো।


সাঁইথিয়া হোক বা যাদবপুর। অন্ধকার তখনও ছিল। এখনও আছে। থাকবেও। সেই অন্ধকার ভেদ করাই তো স্মিতা সিং বা সঞ্চয়িতা হালদারের জীবনপণ। সংসার তাঁদেরও আছে। স্বামী, সন্তান, পরিবার। কিন্তু বৃহত্তর সংসারের ভার বহনেই তাঁদের আনন্দ। সাঁইথিয়া কিংবা যাদবপুরের মেয়ে দুটি পেরেছে। পেরেছেন স্মিতা, সঞ্চয়িতাও। এখানেই থেমে থাকা নয়। আরও অনেককে পারতে হবে। যাতে আগামী নারী দিবসেও লেখা যায় এমনই মহিমান্বিত নারী-আখ্যান। শাণিত তরবারি হাতে ছুটে চলুক সময়।