দেবস্মিতা দাস: কালীপুজোর শুভ সময় বলতেই মধ্যরাত, অমাবস্যা থাকতেই হবে। আঁধার না হলে যেন কালীমাহাত্ম্য জমে না। কালীর সঙ্গে যেন রাতের যোগ ওতপ্রোত। এখন প্রশ্ন ওঠে এই যোগের আদৌ কি কোনও ভিত্তি রয়েছে না কি সম্পূর্ণ ভাবনা থেকেই এর সূত্রপাত? পুরাণ কিংবা বেদে অবশ্য কালীর সঙ্গে রাতের একাত্ম হয়ে ওঠার সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সেখানে কালীমায়ের মূর্তির কল্পনা আসে  ঋগবেদের রাত্রিসূক্ত এবং ব্রাহ্মণগ্রন্থের নিঋতির সমন্বয়ে। কৃষ্ণবর্ণ তামস অন্ধকারের সর্বব্যাপী আচ্ছন্নতা ছাড়া কালীমূর্তি বা কালীর দৈবী ভাবনার সঙ্গে মিল রয়েছে। কিন্তু এমন মিলের কারণ কী? রাত্রিসূক্তে বলা হয়েছে, রাত্রি যেহেতু ঊষাকে গ্রহণ করে আলোকের উদয় ঘটান, কালীও তেমনই অশিব-অমঙ্গল নাশ করে মানুষকে জ্ঞানের আলোর সন্ধান দেন। সেই দ্যোতনা থেকেই এমন ভাবনা। মহাকালী রাত্রির মতোই কৃষ্ণবর্ণা। 


সপ্তশতী চণ্ডীর মধ্যে কালী সেই পরমা শক্তি পরমা প্রকৃতি—যাঁকে সৃষ্টির পূর্বকালে ঋগ্বেদ অন্ধকারের মধ্যে আরও গভীর এক অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করেছে, সেই তাঁকেই তো কালরাত্রি, মহারাত্রি এবং মোহরাত্রির সঙ্গে সমার্থক করে দেওয়া হয়েছে। মার্কেণ্ডেয় পুরাণের শ্রী শ্রী চণ্ডিতে বলা হয়েছে, "কালরাত্রি মহারাত্রিমোহরাত্রিশ্চ দারুণা"। শাস্ত্রবিদদের মতে রাত্রির সঙ্গে এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই ঋগবেদের রাত্রি দেবতার সঙ্গে চণ্ডী-দুর্গা-কালীর অভিন্নতাবোধে চণ্ডীপাঠের আগে ঋগবেদের রাত্রিসূক্ত পড়তে হয়। 


শিবপুরাণে যে কালীর বর্ণনা রয়েছে তিনি ভীষণদর্শনা, করাল বদনা কালী, তাঁর হাতে বিচিত্র খট্বাঙ্গ, তাঁর গলায় নরমুণ্ডের মালা, তাঁর দেহমাংস শুষ্ক, বিশাল বিস্তৃত মুখে লোল জিহ্বা লকলক করছে, চক্ষু দুটি কোটরগত। উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে- 'কালী করালবদনা বিনিষ্ক্ৰান্তাসি পাশিনী ৷৷ বিচিত্রখট্টাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা।অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা। নিমগ্না রক্তনয়না নাদাপূরিতদিমুখা ৷৷' মার্কণ্ডেয় পুরাণে তিনি উগ্রচণ্ডী কালী (উবাচ কালীং কল্যাণীং ললিতং চণ্ডিকা বচঃ)। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে এই কালীই মুক্তকেশী, বিবস্ত্রা, চতুর্ভুজে অস্ত্রধারীনি পদ্মলোচনা শ্যামা। অনেকের মত কালীর ভয়ঙ্কর রূপকে ঢাকতেই আঁধারে পূজিতা দেবী।


তবে বাংলায় রাতের আঁধারে কালীপুজোর বিধান এসে অনেক পরে। স্মার্ত  রঘুনন্দন সম্ভবত খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথিতযশা স্মৃতিশাস্ত্রকার ছিলেন। কিন্তু তিনি তার তিথিতত্ত্ব গ্রন্থে রাত্রি বা  দীপান্বিতার অমাবস্যায় কালীপূজার কোনো বিধান দেননি। বরং তাঁরই অন্য একটি গ্রন্থ কৃত্যতত্ত্বে রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যার রাত্রিতে লক্ষ্মী এবং কুবেরের পুজোর বিধান দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কালিকাপুরাণ মতে কৌশকী অমাবস্যাতেও কালীর আরাধনা শুরু হয় বাংলায়। 


ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান শক্তিদেবতা, দশ মহাবিদ্যার অন্যতমা কালী রাতে পূজিতা হন দ্যোতক ভাবনা থেকেই। পুরাণ থেকে শাস্ত্র, সবেতেই তাঁকে বলা হয়েছে তিনি মহাকাল। তিনি কালকে গ্রাস করেন বলেই কালী। যে রঙে মেশে গিয়েছে বিশ্বের সব রঙ।  মানুষের রোগ, ভয়, তাপ এবং পাপ। তিনি সেই দাহিকাশক্তি যিনি আধাররূপে আদতে আলোর সঞ্চার ঘটান। তাই সেদিন দীপাবলি। সবটাই যেন সেই দ্যোতনা। নেতিবাচক থেকে ইতিবাচকতায় উন্নীত হওয়ার আরেক উৎসব।


তথ্যসূত্র- ভারতের শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, মার্কেণ্ডয় পুরাণ, কালিকা পুরাণ


(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)