নিজস্ব প্রতিবেদন : করোনা আবহে কিছুটা অস্বস্তি তো রয়েছেই। তা বলে ম্লান হওয়ার কোনও জায়গা নেই বুধবারের রামমন্দিরের ভূমিপুজো অনুষ্ঠান। ১৩৪ বছরের ইতিহাস জড়িয়ে। রামমন্দিরের ভিত্তি স্থাপনের আগে ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যাক, কোন পথে আজ রামমন্দির প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

১৮৮৫ : 


বিতর্কের শুরুটা কিন্তু বহু আগে। সেই সময়ে মোহন্ত রঘুবীর দাস নামে অযোধ্যার এক পুরোহিত ও রামায়ণ বিশেষজ্ঞ প্রথম মামলাটি করেন। ফৈজাবাদ কোর্টে মামলা করে তিনি জানান, বাবরি মসজিদের চত্বরের বাইরের চাবুতারায় (উঁচু বাঁধানো স্থান) রামচন্দ্রের জন্মস্থান। ইতিহাসের লম্বা গতিপথে সেখানে মোগল আক্রমণের সময়ে মসজিদ গড়ে উঠলেও আসলে এখানে মন্দির ছিল এক সময়ে। সেই স্থানটিতে তাঁরা মন্দির তৈরি করতে চান, কিন্তু তত্কালীন সেক্রেটারি অব স্টেট (লর্ড উডহাউজ) সেটি বাতিল করে দিয়েছেন। তাই তিনি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন। যদিও সেই সময়ে বিশেষ এগোয়নি মামলা।



১৯৪৯-৫০ : 


এই সময়েই মূলত তুঙ্গে ওঠে বিতর্ক। ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বাবরি মসজিদ চত্বরের সেই বিতর্কিত স্থান থেকেই মেলে একটি পুরোনো রামমূর্তি। এমনিতেই দেশভাগ, অন্তর্বর্তী সরকার ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে তুমুল সাম্প্রদায়িকতার ঝড় চলছিল সেই সময়ে। আর তাতে যেন অনুঘটক হয়ে দাঁড়ায় এ ঘটনা। বিভিন্ন স্থানের হিন্দু রামভক্তরা এখানে মন্দির তৈরির দাবি করতে থাকেন। অন্যদিকে মুসলমানরা তার প্রতিবাদে সরব হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে গোটা চত্বরটা সিল করে ডিসপুটেড ল্যান্ড হিসাবে চিহ্নিত করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন।


১৯৫০:


এরপরেই ১৯৫০ সালে ১৬ জানুয়ারি মন্দির পক্ষের নেতা গোপাল সিং বিশারদ ফৈজাবাদ কোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। বাবরি মসজিদ সংলগ্ন স্থানটিতে- যেখান থেকে মূর্তিটি উদ্ধার হয়েছে, সেখানে পুজোপাঠের অধিকার চাওয়া হয়। এবং সেই সঙ্গে মূর্তিটি যেখান থেকে পাওয়া গিয়েছে, সেখান থেকে যাতে সরানো না হয়, তার নির্দেশিকা দাবি করেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখে সাময়িকভাবে জন্মস্থান থেকে মূর্তি সরানো যাবে না বলে নির্দেশ জারি করে ফৈজাবাদ আদালত। এলাহাবাদ আদালতেও তার পক্ষেই সায় দেওয়া হয়।


এরপর সেই বছরেরই এপ্রিলে উত্তরপ্রদেশের গোবিন্দবল্লভ পন্ট শাসিত কংগ্রেস সরকার আদালতের এই ইঞ্জাকশান তোলার জন্য মামলা করেন। অন্যদিকে ১৯৫০ সালের ডিসেম্বরে বিতর্কিত স্থানে পুজোপাঠ চলতে থাকার অনুমতি চেয়ে মামলা করেন রাম জন্মভূমি মন্দির ট্রাস্টের প্রধান পরমহংস রামচন্দ্র দাস। এই ট্রাস্ট আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যদিও তিনি নিজেই আবার মামলা তুলে নেন।



১৯৫৯-৬১ : 


১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে অখিল ভারতীয় আখড়া পরিষদের প্রধান নির্মোহী আখড়া একটি মামলা করেন। সেখানে তিনি নিজেকে জন্মভূমির আসল মালিক বলে দাবি করেন।


এদিকে ১২ বছরে ধরে যদি কোনও জমি, সম্পত্তি অনধিকৃত ও বিতর্কিত হিসাবে গণ্য হয়, সেক্ষেত্রে তার আদি মালিকদের আর মালিকানা থাকে না। এর ফলে চিন্তিত হয়ে পড়েন উত্তরপ্রদেশের সুন্নি সেন্ট্রাল বোর্ড অব ওয়াকিফ-এর সদস্যরা। তাই জমির দাবি বজায় রাখতে ১৯৬১ সালের ১৮ ডিসেম্বর, ১২ বছর হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগেই নড়েচড়ে বসেন তাঁরা। অযোধ্যার মুসলিম বাসিন্দাদের ডেকে এনে সকলে মিলে বিতর্কিত চত্বরটির দখল নেন। সেখানেই তাঁরা প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং মূর্তি সরানোর দাবি করতে থাকেন।


১৯৮৬ :


এই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি আদালত হিন্দু পুজার্থীদের জন্য খুলে দিতে হবে জমির প্রবেশপথ। এই রায়ের প্রতিবাদে গঠিত হয় বাবরি মসজিদ অ্যাকশান কমিটি।



১৯৮৯ : 


ভিএইচপি-র সহ-সভাপতি এবং এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি দেবকীনন্দন আগড়ওয়ালা এরপর আসরে নামেন। তিনি এবছর ১ জুলাই এলাহাবাদ আদালতের লখনউ বেঞ্চে মামলা করেন। সেখানে তিনি বলেন, ১৫২৫ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের স্থপতি ভারত আক্রমণ করেন। ১৫২৮ সালে বাবরের হানায় ধ্বংস হয় রামমন্দির। এরপর সেখানেই তৈরি হয় বাবরি মসজিদ। এর প্রমাণ হিসাবে ১৯২৮ সালের ফাজিয়াবাদের জেলা গেজেটে প্রদত্ত একাধিক তথ্য তুলে ধরেন তিনি। এরপর ১৪ অগস্ট জমিটিতে যেভাবে পুজো চলছে তা চালু রাখার নির্দেশ দেয় আদালত।


এর পরেই রাজীব গান্ধী শাসিত কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সরকার ভিএইচপি-কে রামমন্দিরের শিলান্যাসের অনুমতি দেয়। রামমন্দিরের প্রথম ইঁটটি স্থাপন করা হয়।



১৯৯২ :


বিতর্কিত জমির ভবনটি এই সালের ৬ ডিসেম্বর ভেঙে ফেলা হয়। শুরু হয় তুমুল বিতর্ক ও অশান্তি। প্রতিবাদ, পাল্টা প্রতিবাদে জ্বলতে থাকে অযোধ্যা। কেন এমনটা ঘটল তার তদারকি করতে বিচারপতি লিবেরহ্যানের অধীনে তৈরী হল বিশেষ কমিটি। রিপোর্ট দিতে বেঁধে দেওয়া হল ৩ মাসের সময়সীমা। এই সময়ে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে জারি হল রাষ্ট্রপতি শাসন। ভেঙে দেওয়া হয় কল্যাণ সিং শাসিত বিজেপি সরকার।


১৯৯৩ : 


এই সময়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমারাও অযোধ্যার বিশেষ জমি অধিগ্রহণ অ্যাক্ট পাশ করেন। এর মাধ্যমে বিতর্কিত জমিটি সরকারি সম্পত্তি হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পিটিশন জমা করেন ইসমাইল ফারুকিসহ মসজিদপন্থী নেতৃত্ববৃন্দ।


১৯৯৪: 


"ইসলাম ধর্ম পালনের জন্য মসজিদ অত্যাবশ্যক নয়। বিশ্বের যে কোনো স্থানে, এমনকি খোলা মাঠেই চাইলে নামাজ পাঠ করা যায়," রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। বলা হয়, "তাই রাষ্ট্রের এই জমি অধিগ্রহণ করা সংবিধানবিরুদ্ধ নয়।" এর ফলে ৬৭.৭ একরের মধ্যে ২.৭৭ একরের বিতর্কিত জমিটুকু অধিগ্রহণ করে সরকার।



১৯৯৬ : 


এলাহাবাদ আদালতে এই মামলার বিভিন্ন সাক্ষীদের মৌখিক বিবৃতি নেওয়া শুরু হয়।


২০০২-০৫ : 


এলাহাবাদ হাইকোর্টে শুরু হয় শুনানি। বিতর্কিত স্থানে হিন্দুদের দাবিমাফিক আগে মন্দির ছিল কিনা তা খুঁড়ে দেখে যাচাই করার ভার দেওয়া হয় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে। ২০০৩ সালে জুনে খননকাজ শুরু করার পরেই হিন্দুদের দাবিকে সমর্থন জানায় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রত্নতত্ত্ববিদরা। তাঁরা জানান সেখানে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের প্রমাণ পেয়েছেন বিতর্কিত জমি খনন করে।


আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের রিপোর্টকে মিথ্যা বলে ঘোষণা করেন মসজিদ পক্ষ। সেই বছরেই উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবাণীসহ ৭ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করে সিবিআই। ক্রমেই বাড়তে থাকে অশান্তি। পরিস্থিতি সামাল দিতে মার্চ মাসে বিতর্কিত জমিতে সকল ধর্মীয় কার্যকলাপ বন্ঝ রাখার অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।


২০০৯ :


প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর কাছে রিপোর্ট পেশ করল লিবেরহান কমিশন।


২০১০ :


৩০ সেপ্টেম্বরের রায়ে, বিতর্কিত জমিতে তিনভাগে ভাগ করল এলাহাবাদ হাই কোর্ট। একটি দেওয়া হল সুন্নি ওয়াকিফ বোর্ডকে। একটি নির্মোহী আখড়াকে। অন্যটি রামলাল্লার দলকে। হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গেল অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা ও সুন্নি ওয়াকিফ বোর্ড।


২০১১ :


হাইকোর্টের সুরেই রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। বর্তমান অবস্থাই জারি থাকবে- জানানো হল।


২০১৬ : 


২৬ ফেব্রুয়ারি বিজেপির লোকসভার মন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যন স্বামী বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির করার অনুমোদন চাইলেন।



২০১৯ : 


সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করলেন। তৈরি হল মধ্যস্ততাকারী প্যানেল। কিন্তু মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থতার পর ৬ অগস্ট থেকে শুরু হল দৈনিক শুনানি।


৯ নভেম্বর ২০১৯ : 


রামজন্মভূমি কেসে রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। জানানো হল, হিন্দুরা তাদের জন্য দেওয়া জমিতে মন্দির করতে পারবে। অন্যদিকে অযোধ্যাতেই একটি মসজিদ তৈরির জন্য ৫ একর জমি প্রদান করা হল মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য।


৫ অগস্ট ২০২০ : 


রামমন্দিরের ভূমিপুজো।


আরও পড়ুন- ভূমি পুজোর অনুষ্ঠানে সবার আগে আমন্ত্রণ অযোধ্যা বিতর্কে মামলাকারী ইকবাল আনসারিকে