সুদেষ্ণা পাল


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সমাজের চোখে তাঁর পরিচয় তিনি একজন বৃহন্নলা। চলতি কথায় হিজড়ে। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত তাঁর জীবন নয়। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই দেখেছেন, কীভাবে তাঁর প্রতি চারপাশের দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে বদলেছে। কখনও চূড়ান্ত উপেক্ষা, কখনও আবার অত্যধিক কৌতূহল। সমাজ থেকে পাওয়া আঘাত-যন্ত্রণা কখনও নীরবে সয়েছেন, কখনও কুঁকড়ে উঠেছেন। তবে দোমড়ানো মোচড়ানো সেই মনটা আজ অহঙ্কারী। কারণ? তিনি আজ 'বাবা'। এই একটা শব্দ তাঁর সব যন্ত্রণায় প্রলেপ দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাঁর জীবনের সেই গল্পকে তুলে ধরেছেন গর্বিত 'বাবা'। যা নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণা জোগাবে আরও এরকম হাজারটা লড়াকু মনকে। ভাবতে শেখাবে তথাকথিত ভদ্র সমাজকে। চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেবে, আমাদের সমাজের ক্ষতটা ঠিক কতটা গভীর।


আর পাঁচটা বাচ্চার মতই বেড়ে উঠছিলেন তিনি। তখন তিনি 'She'। স্কুলে যেতেন। বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন ভাগ করে খেতেন। কিন্তু বয়ঃসন্ধির সময় আসতেই শুরু হল গোলমালটা। বন্ধুদের কেমন যেন অন্যরকম দেখতে হয়ে উঠছে! কই, তাঁর তো সেরকম কিছু হচ্ছে না। বন্ধুরা কেমন যেন ধীরে ধীরে 'নারী' হয়ে উঠছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফারাকটা আরও স্পষ্ট হতে লাগল। সেদিনই তিনি প্রথম বুঝলেন, তিনি 'অন্যরকম'। তিনি 'মেয়েদের মত' দেখতে হতে পারেন, কিন্তু মেয়ে নন। শুরু হল এক অন্য লড়াই। অস্তিত্বরক্ষার লড়াই।


ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে যেটা শুনলেন, সেটা নিজের কানকেও বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। ডাক্তারই তাঁকে বললেন, তিনি ইন্টারসেক্স। চলতি কথায় যাকে বলে হিজড়ে। তাঁর কোনও প্রজননতন্ত্র নেই। তিনি মেয়ে নন। ভয়ে, লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন। গোপন করলেন নিজের আসল 'লিঙ্গ পরিচয়'কে। কিন্তু, তখনও তো আরও একটা বড় লড়াই বাকি ছিল...



রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম। সুপাত্রের সঙ্গে 'মেয়ে'র বিয়ে ঠিক করলেন বাবা। বয়স তখন সবে ২২ বছর। শুরু হল প্রতি মুহূর্তে নিজের সঙ্গে নিজের, সত্ত্বার সঙ্গে সত্ত্বার যুদ্ধ। মুক্তি চাইলেন এই দ্বিচারিতা থেকে। নারীর শরীরে পুরুষকে ধারণ নয়, বাঁচতে চাইলেন তিনি যা সেটা হয়েই। আর তারপর...


একদিন সাহস করে সবার সামনে সত্যিটা বলেই ফেললেন। প্রকাশ করলেন নিজের পরিচয়। ঝড় নামল, বলা ভালো ঝড় উঠল তাঁর জীবনে। এতদিন লুকিয়ে চুরিয়ে অনেক 'পাপ' করে ফেলেছেন! এবার তো তথাকথিত ভদ্র সমাজে তাঁর আর ঠাঁই হয় না! নিজের পরিবারই তাঁকে তাড়িয়ে দিল। বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে জায়গা পেলেন ওঁদের মাঝে। যাঁরা ঠিক তাঁরই মত লড়ছে অস্তিত্বরক্ষার লড়াই। সেখানেই পেলেন নতুন বন্ধু, পেলেন নতুন জীবন। এরপর হঠাৎ একদিন সকালে...


স্বামীর অত্যাচারের হাত থেকে কোনওমতে পালিয়ে এসে তাঁর কাছে সাহায্য চাইলেন এক মা। কোলে ছেলে। সেই মাকে আশ্রয় দিলেন তিনি। শুরু হল 'বাবা'-র দায়িত্ব পালন। 'বধাই' (শিশুর জন্মের খবর পেয়েই চলে যাওয়া নবাজাতকের বাড়ি। সেখানেই নেচে গেয়ে উপার্জিত টাকা) থেকে মাস গেলে যে আয় হত, সেখান থেকেই একটা ভালো পরিমাণ টাকা, প্রায় ২০,০০০ টাকা, প্রতি মাসে সেই নির্যাতিতা মহিলাকে দিতে থাকলেন তিনি। আজ এই 'বাবা'-র টাকাতেই সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটা MBA-পাস করেছেন। আর সেই ছেলেই তাঁর মায়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে 'বাবা'-র।


MBA ছেলের এমন কাজে গর্বে চোখের কোণটা চিকচিক করে ওঠে 'বাবা'র। অহঙ্কারের সঙ্গে বলেন, "আমি আমার বাবার ভালো ছেলে হতে পারিনি। কোনওদিন ভালো স্বামী হওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমি পেরেছি আমার ছেলের বেস্ট বাবা হতে। আমি হিজড়ে। তাই সন্তানের জন্ম দিতে পারিনি। কিন্তু জীবন আমায় একটা সুযোগ দিয়েছে বাবা হওয়ার। আমি বাবা। আমি আমার ছেলেকে পেয়েছি।"