সুদেষ্ণা পাল


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

একটি গাছ একটি প্রাণ। এই স্লোগানের সঙ্গে পরিচিত আমরা সবাই। বনসৃজন সপ্তাহ থেকে বৃক্ষরোপণ উৎসব, সবুজ বাঁচাতে এই স্লোগানকে পাথেয় করেই চলছে নানারকম কর্মযজ্ঞ। কিন্তু না, ওদের ওখানে সেরকম কোনও সপ্তাহ পালন হয় না। হয় না কোনও দিন পালনও। আসলে ওরা গাছকে নিয়ে বাঁচে। গাছকে আঁকড়ে বাঁচে। এমনকি নশ্বর দেহে যখন প্রাণ থাকে না, তখনও... মৃত্যুর পরেও ওরা গাছের কথা ভাবে। ওরা বিষ্ণোই। বিষ্ণোই সম্প্রদায়। রাজস্থানের বিষ্ণোই জনজাতি।


সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে এর আগেও বিষ্ণোইদের কথা উঠে এসেছে। হরিণশাবকদের স্তন্যপান করাচ্ছেন বিষ্ণোই মায়েরা, এই ছবি গুগলে সার্চ করলেই মেলে। ভারতে পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এই জনজাতি সম্পর্কে আমার কৌতূহলের শুরুও খানিকটা এরকমই এক প্রতিবেদন থেকে। কিন্তু তখনও জানতাম না, এই বিষ্ণোই গ্রামের পথেঘাটে, ঘরে ঘরে ছড়িয়ে আছে তাঁদের জীবনধারণের আরও কত গল্প। কত লড়াইয়ের ইতিহাস। কত অজানা কথা... সেই অচেনা-অজানার খোঁজ করতেই দিনকয়েক আগে পৌঁছে গিয়েছিলাম রাজস্থানের যোধপুর শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিষ্ণোই গ্রামে।


আমেদাবাদ হাইওয়েকে ডান পাশে রেখে ধুলো উড়িয়ে বাঁ পাশের মেঠো রাস্তায় জিপ যখন ঢুকল, দেখলাম বিষ্ণোই গ্রামে আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষা করছে এক ময়ূর পরিবার। ঘোর লাগল চোখে। জিপ চালক বললেন, "ময়ূর এখানে প্রতি ঘরে ঘরে। আর ঘরে ঘরে ক্ষেতি। এখানকার মানুষের কাছে গাছ থেকে পশুপাখি সবটাই নিজের সন্তানসম নয়। সন্তান-ই ম্যাডামজি।" জিপ এগোতে থাকল। চোখে পড়তে থাকল একের পর এক বিষ্ণোই ঘর। কোনও ঘরে শস্য শুকোতে দেওয়া হচ্ছে। কোনও ঘরে গরুকে স্নান করানো হচ্ছে। কোথাও আবার দুধ দোওয়া হচ্ছে। জিপ চালক বললেন, "রাজস্থানে আপনি অনেকরকম রঙের পাগড়ি পরা মানুষ দেখতে পাবেন। কিন্তু এই বিষ্ণোই গ্রামে আপনি শুধু সাদা পাগড়ি-ই দেখতে পাবেন। সাদা পাগড়ি, সাদা পাঞ্জাবি, সাদা ধুতি। বিষ্ণোই পুরুষদের পোশাক এটাই।"



প্রশ্ন করলাম, আর মেয়েরা? বললেন, "মেয়েদের রং লাল। বিষ্ণোই মেয়েদের বিয়ের পর লাল রঙের শাড়ি পরা বাধ্যতামূলক। শুধু লাল শাড়ি নয়, সঙ্গে ৫-৬ রকম গয়না তাদের সর্বক্ষণ পরে থাকতে হয়। মাথায়, নাকে, কানে, গলায় সোনার গয়না প্রত্যেককে পরতে হয়। সঙ্গে পায়ে রূপোর বালা। আর হাতে চূড়া।" শুনলাম, বিষ্ণোই মেয়েদের বিয়ের সময় নাকি তাঁদের বাপের বাড়ি থেকে এমনি-ই  '২৫-৩৩ তোলা' সোনা মানে কেজি দেড়েক সোনা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য, বর্তমানে সোনার যা বাজার দর, সেই পরিপ্রেক্ষিতে খানিকটা ঢোঁক গিললাম। জিপ এগোতে থাকল...



বিষ্ণোই গ্রাম, গ্রামের মানুষ, বন্যপ্রাণ, জনজীবনের সঙ্গে আলাপ যত জমতে থাকল, ততই সাক্ষী হতে থাকলাম নতুন নতুন চমকের। কিছুদূর গিয়েই চোখ আটকালো রাস্তার পাশে এক গাছে। গাছটাকে ঘিরে অনেকগুলো লাল নিশান পোঁতা। গাছের গায়েও উড়ছে লাল নিশান, লাল চূর্ণী। গাছটাকে ঘিরে একটা লাল রঙের খাঁচা মতো... তৈরি করা হয়েছে একটা বেদীও। কৌতূহলের অবসান হল পর মুহূর্তেই। জানলাম, গাছটির নাম 'খেচরি গাছ'। বেশি পরিচিতি 'বিষ্ণোই ট্রি' নামে। আর এই গাছেই লুকিয়ে বিষ্ণোইদের আত্মত্যাগের ইতিহাস। 'একটি গাছ একটি প্রাণ' নয়, একটি গাছ ৩৬৩টি প্রাণের ইতিহাস...


চিপকো আন্দোলনের কথা সবার জানা। ইতিহাসের বইতে কমবেশি সবাই-ই চিপকো আন্দোলনের কথা পড়েছে। কিন্তু চিপকো আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছিল যে আন্দোলন? সেই আন্দোলনকে জানতে গেলে পায়ে পায়ে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ অনেকগুলো বছর। সালটা ১৭৩০। খেচরি গাছ বাঁচাতে সেদিন মানববন্ধনী গড়ে তুলেছিলেন বিষ্ণোই গ্রামের মানুষরা। নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে গাছকে ঘিরে হাতে হাতে রেখে মানববন্ধনী গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বন্দুকের নল, তলোয়ার, কুঠারের সামনে। পরিণামে সেদিন বিষ্ণোই গ্রামে রক্তগঙ্গা বয়েছিল। প্রাণাধিক প্রিয় গাছকে বাঁচাতে সেদিন শহিদ হয়েছিলেন ৩৬৩ জন মানুষ। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছিল বিষ্ণোইদের সেই আত্মত্যাগের কথা।



বিষ্ণোই শব্দের অর্থ বিশ+নয়, অর্থাৎ উনত্রিশ। ১৪৮৫ সালে যোধপুরের মারওয়াড় এলাকায় গুরু জামবাজির হাত ধরে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের সূচনা হয়েছিল। বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব লুকিয়ে এই '২৯টি' নীতি বা মূলমন্ত্রের মধ্যে। যারমধ্যে প্রধান ও অন্যতম হল গাছ ও বন্যপ্রাণ রক্ষা। ইতিহাস বলে, চিপকো আন্দোলনের প্রায় ২৪০ বছর আগে গাছ রক্ষায় প্রথম আন্দোলন হয়েছিল এই বিষ্ণোইদের হাত ধরেই। নতুন প্রাসাদ গড়ার জন্য ১৭৩০ সালে যোধপুরের মহারাজা অভয় সিং রাঠোর বিষ্ণোইদের গ্রাম খেজারলিতে খেচরি গাছ কাটার নির্দেশ দেন। রাজার সেই নির্দেশ পালন করতে আসে সিপাইয়ের দল। শুরু হয় গাছ কাটা। এদৃশ্য দেখে স্থির থাকতে পারেননি খেজারলি গ্রামের বীরাঙ্গনা অমৃতাদেবী। 'একটা মাথার বিনিময়ে একটা গাছ বাঁচাব', এই স্লোগান দিয়ে খেচরি গাছকে জড়িয়ে ধরে রুখে দাঁড়ান তিনি। তিন মেয়ে আসু, রত্নি, ভাগুকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজার সিপাইদের সামনে। তাঁকে দেখে এগিয়ে আসেন অন্যান্য বিষ্ণোই নারী-পুরুষরাও। একের পর এক খেচরি গাছকে জড়িয়ে ধরে রুখে দাঁড়ান প্রত্যেকে। ফলস্বরূপ, গাছ রক্ষায় ৩৬৩ জন বিষ্ণোইয়ের আত্ম বলিদান। ইতিহাসের পাতায় যা বিষ্ণোই আন্দোলন নামে পরিচিত হয়।


শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বন্যপ্রাণ ও গাছ রক্ষায় বিষ্ণোইদের নিষ্ঠার একচুল অভাব ঘটেনি কোনওদিন। প্রকৃতির কাছে করা প্রতিজ্ঞাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আজও অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছেন বিষ্ণোইরা। আর তাই সনাতনী হিন্দু হয়েও, মৃত্যুর পর বিষ্ণোইরা কখনও দেহ দাহ করেন না। বিস্তীর্ণ বনজমির কোথাও না কোথাও তাঁরা দেহ সমাধিস্থ করে দেন। প্রকৃতির সন্তানকে ফিরিয়ে দেন প্রকৃতির কোলে। একইসঙ্গে গাছ না কাটার প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে যান যেন মৃত্যুর পরেও! কথায় বলে, প্রেম শাশ্বত। প্রেম চিরন্তন। প্রেম অমর। ময়ূর, নীলগাই, কৃষ্ণসার, খেচরি গাছ, সবার সঙ্গে আলাপ সেরে ফেরার পথে চোখ বন্ধ করে জিপের মধ্যে বসে মনে হচ্ছিল, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নিজেদের জীবনধারণে সেই প্রেমেরই জয়গান গাইছেন বিষ্ণোইরা। প্রণাম...


আরও পড়ুন, ছড়িয়ে রয়েছে ৩০ একর জমিতে, হায়দরাবাদে খুলছে দুনিয়ার সর্ববৃহত্ ধ্যানকেন্দ্র


কীভাবে যাবেন- বিষ্ণোইদের সঙ্গে আলাপ করতে হলে আপনাকে প্রথমে পৌঁছতে হবে যোধপুর। যোধপুর থেকেই আপনি বিষ্ণোই গ্রামে যাওয়ার জন্য গাড়ি, জিপ পেয়ে যাবেন। প্রতিদিন সকাল ও বিকেল, দুবেলাই যোধপুর থেকে গাড়ি যায় বিষ্ণোই গ্রামে।