সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

'ময়নাতদন্ত' শব্দটি কেন যে ময়নাতদন্ত, বড়দের মুখে বা টিভির পর্দায় কথাটি শুনে একবারও সেটা ভাবেনি, এমন ছোটবেলা নিশ্চয়ই কারও নেই!


আর ঘটনার পর ঘটনায় ময়নাতদন্তের কী-হয় কী-হয় উত্তেজনা তাড়া করে ফেরেনি, এমন বড়বেলাও নিশ্চয়ই আমাদের দেশে কম নেই!


'ময়নাতদন্ত' শব্দটা শুনলেই কি ছোটবেলায় আমাদের ময়নাপাখির কথা মনে পড়ে যেত না! আলবত যেত! তবে, পরে-পরে বড়দের থেকে আমরা হয়তো একটু-একটু করে জেনেও নিয়েছি যে, আরবিতে 'ময়না' মানে 'অনুসন্ধান'। এই জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের পরেও অবশ্য পাখিভাবনা যেত না আমাদের মন থেকে। কেননা, ততদিনে তো 'সাথীহারা' ছবিতে উত্তমের লিপে হেমন্তের 'ও ময়না কথা কও' গানটিও আমাদের কানে ঢুকে পড়েছে। ফলে তখন সব মিলে ওই 'পাখি তুই ঠিক বসে থাক, ঠিক বসে থাক' মার্কা একটা সিচুয়েশন। কিন্তু তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে ওঠা শালিখজাতীয় এই পাখিটি যে খুব দৃষ্টিপথে ধরা দিত, তা-ও নয়। গাছের মগডালে বসে থাকাই যে স্বভাব এদের। চট করে নাগাল পাওয়া মুশকিলই। 


ছোটবেলার এই অভিজ্ঞতা, কী আশ্চর্য, বড়বেলাতেও হুবহু এক! ঠিকঠাক একটি ময়নাতদন্তের নাগাল পাওয়া দিন-দিন সত্যিই মুশকিল হয়ে পড়ছে এ দেশে।


কেন ময়না পাখি এবং ময়না তদন্ত নিয়ে হঠাৎ এত কিচিরমিচির? 



আসলে, মননীড়ের আঁধারবাসায় ময়নাপাখিটির এই সহসা উড়ে এসে জুড়ে বসার কিছু ঘটনাক্রমও আছে। সুশান্ত সিং রাজপুত এবং হাথরসের দলিতকন্যা।


সেই জুন মাসের মাঝামাঝি থেকেই দেখা যাচ্ছিল, গোটা দেশ ময়নাতদন্ত নিয়ে উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। যিনি ক'দিন আগেও 'পোস্টমর্টেম' শব্দটা খায় না মাথায় দেয়, তা নিয়ে অত মাথা ঘামাতেন না, সেই তিনিও হঠাৎ পোস্টমর্টেম নিয়ে হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল! হবে নাই-বা কেন! সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিল। তাঁর মৃত্যুর ময়নাতদন্তের জন্যও তাই উদগ্রীব হয়ে পড়ল গোটা দেশ। কী-হয় কী-হয় করে হেদিয়ে পড়ল সব্বাই। যেন প্রথমবার বোর্ডের পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায়। 



না, অশোভন কৌতূহল নয় একেবারেই। এ জিনিস মানুষের জানার অধিকার আছে। একজন ছটফটে সুন্দর তরতাজা তরুণ, যিনি শরীরে ডানা লাগিয়ে রোজ যেন নতুন করে উড়ছিলেন তাঁর কেরিয়ারের নবদিগন্তে, তিনি কেন খামখা মরতে যাবেন, মরলে কী ভাবে মরলেন, তা জানবে না মানুষ? একশোবার জানতে চাইবে।


আর ক'দিন আগের হাথরস-কাণ্ড। বছরউনিশের দলিত কন্যাটি তাঁর মায়ের সঙ্গে চাষসংক্রান্ত কোনও কাজে ক্ষেতে যাচ্ছিলেন। সেই সময়ে একদল যুবক তাঁকে আক্রমণ করে। তাঁর গলায় দোপাট্টা দিয়ে ফাঁস লাগায়। তাঁর মেরুদণ্ডে আঘাত লাগে। তাঁকে ক্ষেতসংলগ্ন ঝোপের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। ধর্ষণের অভিযোগ উঠে আসে। ভয়ানক অসুস্থ অবস্থায় মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা ক্রমশ অবনতি হতে থাকায়, তাঁকে পাঠানো হয় দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে। কিন্তু বাঁচানো যায় না। এ পর্যন্ত জেনে কোন পাষাণ, শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না এটা জানার জন্য যে, কেন ধর্ষিতা হতে হল মেয়েটিকে, ধর্ষণের পাশাপাশি মর্মান্তিক শারীরিক আঘাতই-বা কেন পেতে হল! মন তো তাঁর কষ্টে, অপমানে, ঘৃণায় ভেঙে দুমড়ে-মুচড়েই গিয়েছিল, শরীরটাকেও দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার কি খুব দরকার ছিল? এ সব জানবে না দেশের মানুষ! তাঁরা অপেক্ষা করবে না, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে শেষমেশ কী প্রমাণিত হল, সেটা জানার জন্য?



করবেই তো! করবে কেননা, ওই 'ময়নাতদন্ত' শব্দটির উপর যে তার আবাল্য অগাধ বিশ্বাস। 'পাখিই' হোক বা 'তদন্ত', 'ময়না' যে কথা বলে এবং সত্যি কথাই বলে, এ যে তার আজন্মলালিত অকলঙ্ক পবিত্র বিশ্বাস!


এবং কী আশ্চর্য! তার সেই অটল বিশ্বাসে প্রতিদিন প্রতিবার 'কেস বাই কেস' নিদারুণ আঘাত আসছে। সে অসহায় ভাবে প্রত্যক্ষ করছে, পাখি-ময়নার মতো তদন্ত-ময়নাও উড়ে যাচ্ছে। অথবা আড়ালে থাকছে। অথবা চুপটি করে থাকছে, কথা কইছে না!


কেন? কেন? কেন?


এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। এই একটা জায়গা তো অন্তত জনগণমনে এমন ছিল, অনেকটা ওই দেবস্থানের গর্ভমন্দিরের পূতপবিত্রতার মতো, যার ওপরে দ্বিতীয় কোনও সত্য হয় না। এবং যে-সত্যের ধারালো খড়্গে শুধু অপরাধীই নয়, অপরাধের তদন্তে গাফিলতি যারা করে, তারাও কেটে খান খান হয়ে যায়। ময়নাতদন্ত কাউকে ছাড়ে না। বাবা-মা-ভাই-বোন-পুলিশ-প্রশাসন-থানা-হাসপাতাল-আততায়ী-বন্ধু-- কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। পোস্টমর্টেম একটা নির্জলা এবং কঠিন সত্যের নিশানা দেয়। মানুষ হৃদয়ের গভীর থেকে বিশ্বাস করেছে, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলেই ঠিক জানা যাবে, সুশান্তের কী হল; ঠিক জানা যাবে দলিতকন্যাটির কী হল! কিচ্ছুটি চাপা থাকবে না। এই রিপোর্ট সমস্ত রহস্য ও অন্ধকারের ঘোর জটিল বনভূমি থেকেও ঠিক তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উঠে জানিয়ে দেবে-- সত্য কী! সত্য কঠিন। কিন্তু সত্যরে সহজেই নিতে হবে তখন। কেননা সত্যমেব জয়তে!


পক্ষান্তরে, আমরা কী জানছি?


সুশান্ত সিং রাজপুতের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বেশ ধোঁয়াশা। এআইআইএমএস-এর রিপোর্টে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু না বিষক্রিয়া-- এ বিষয়ে যা ব্যাখ্যা দেওয়া হল, তা থেকে ময়না-মুগ্ধ সাধারণ পাবলিক কী এবং কতটুকু বুঝবে? এআইআইএমএস-এর প্রধান বলে দিচ্ছেন-- ময়না-তদন্তে মৃত্যুর সময়ের কোনও উল্লেখ নেই। এটা খুব আশ্চর্যের। মুম্বই পুলিশের উচিত ছিল বিষয়টা দেখা। ঠিকই বলেছেন। সুশান্তের ময়নাতদন্ত থেকে মৃত্যু-সময়ের ময়না উড়ে গেল কেন? সুশান্ত-কাণ্ডের সূত্রেই মাদক নিয়ে ঢি ঢি পড়ে গেল বলিউডে। বাঘা-বাঘা ব্যক্তিত্ব সব সন্দেহের সারণিতে। কিন্তু মৃত্যুর সময়ে সুশান্ত স্বয়ং মাদকগ্রস্ত ছিলেন কিনা, সেটাই জানা গেল না। সিবিআইয়ের সন্দেহের তালিকা থেকে তা হলে মুম্বই পুলিশ বা কুপার হাসপাতাল-- কেউই বাদ থাকল না!


আর হাথরসের দলিতকন্যা? তাঁর ময়নাতদন্তের লিখন হল-- 'ইনজুরি টু দ্য  সারভাইক্যাল স্পাইন প্রোডিউসড বাই ইনডিরেক্ট ট্রমা..'। এঁর শ্বাসরোধের চেষ্টা করেছে অপরাধী, ভাঙা  হয়েছে মেরুদণ্ড! এবং এ সবের জেরেই তাঁর মৃত্যু। আর ধর্ষণ? না, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র শব্দ নেই! ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেল না। শস্যক্ষেতে দলিত-মর্দিত-নিপীড়িত দলিতকন্যার ময়না-সংবাদ থেকেও তা হলে প্রমাণের ময়না উড়ে গেল, রাতারাতি?


তা হলে দেশবাসী কী করবে! পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে? গুমরে মরবে ভিতরে-ভিতরে? প্রচণ্ড রাগে ফুঁসবে? সমস্ত আস্থা-বিশ্বাস পরিত্যাগ করবে? সে না হয় হল! কিন্তু যাঁদের বাড়ির ছেলে ওই সুশান্ত, বা যাঁদের ঘরের মেয়ে ওই দলিতকন্যাটি-- তাঁরা, সেই সব অসহায় পরিজনেরা কী করবেন? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? কী আঁকড়ে ধরবেন? কী সান্ত্বনা নিয়ে তাঁদের জীবনের বাকিদিনগুলি বাঁচবেন? তাঁরা তো বেশি কিছু চাইছেন না। শুধু জানতে চাইছে ঘরের ছেলেটি বা মেয়েটি ঠিক কী ভাবে মরল! একটু বলবেন, হে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা? এটুকু জানা যাবে না?


ময়নাতদন্তের সঙ্গে তো যুক্ত থাকেন চিকিৎসকেরাই। এই পেশায় আসার আগে তো তাঁদের রীতিমতো শপথ নিতে হয়। তা হলে মিথ্যা সেই শপথবাক্য গ্রহণ? বিবেকজাগরণের সেই প্রারম্ভিক ধারাপাত মূল্যহীন? 
একটু-একটু করে পিছোতে-পিছোতে আমাদের পিঠ তো এই শেষ দেওয়ালটায় এসে ঠেকেছে! এর পর? এ বিশ্বসংসারের সব ময়নাই কি তা হলে সেই গানের বাণীর মতোই 'দাঁড়ে-পোষা'?


আরও পড়ুন: হাথরস কাণ্ডে উত্তরপ্রদেশ পুলিসের বড় বয়ান! নির্যাতিতার ধর্ষণ হয়নি, গুজব রটেছে