কাজে এল না দেশভক্তি, ৩৭০, মহারাষ্ট্র-হরিয়ানা শিক্ষা দিল বিজেপিকে, মানতে নারাজ মোদী
৫ মাস আগেই লোকসভা ভোট হয়েছে। এত বড় জয়ের পর তুঙ্গে ছিল গেরুয়া শিবিরের আত্মবিশ্বাস।
নিজস্ব প্রতিবেদন: হরিয়ানা ত্রিশঙ্কু। মহারাষ্ট্রে কান ঘেঁষে জয়। দুই রাজ্যে বিজেপিকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে দিল জনতা। প্রচারে জাতীয়তাবাদ কাজে এল না। ধরাশায়ী হল জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপির ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের মতো হাতিয়ারও। অনেকেই বলছেন, বেহাল অর্থনীতিতেই নাজেহাল হতে হল গেরুয়া শিবির। হরিয়ানায় ডোবাল খট্টরের মুখ। তাঁকে মেনে নিতে পারেননি ভোটাররা। নরেন্দ্র মোদী অবশ্য বিজয়ী ভাষণে দাবি করেছেন, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা কোনওকালেই বিজেপির গড় ছিল না। কিন্তু দুটি রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখা কোনও অংশে কম কৃতিত্বের নয়। এজন্য ফড়ণবীস ও খট্টরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
৫ মাস আগেই লোকসভা ভোট হয়েছে। এত বড় জয়ের পর তুঙ্গে ছিল গেরুয়া শিবিরের আত্মবিশ্বাস। সেই আত্মবিশ্বাস এতটাই যে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা মহারাষ্ট্র-হরিয়ানায় খুব বেশি সভাও করেননি। ভোটের রেজাল্ট দেখে এখন কপালে চিন্তার ভাঁজ। দুই রাজ্যেই বিজেপি-র প্রচারের প্রধান বিষয় ছিল জাতীয়তাবাদ। লোকসভা নির্বাচনে যে ফর্মুলায় সাফল্য এসেছে, সেই একই ফর্মুলা বিধানসভা ভোটেও প্রয়োগ করে তারা। কিন্তু, এবার আর তা কাজে এলনা। হরিয়ানা ত্রিশঙ্কু। আর মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা এল প্রায় কান ঘেঁষে। অনেক কমে গেল গেরুয়া শিবিরের আসন।
হরিয়ানা
হরিয়ানায় বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হওয়ায় কিং মেকার জননায়ক জনতা পার্টির নেতা দুষ্মন্ত চৌতালা। তাঁর দিকে তাকিয়ে কংগ্রেস-বিজেপি, দু'দলই। ভোটের আগে, রাহুল ঘনিষ্ঠ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অশোক তানওয়ারের ইস্তফা, পরে দলত্যাগ। ক্ষমতা আবার সোনিয়া-ঘনিষ্ঠ, দলের প্রবীণ নেতা ভূপিন্দর সিং হুডার হাতে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার কংগ্রেসকে যাঁরা ধর্তব্যের মধ্যেই ধরেননি, তাঁদের জবাব দিয়েছেন হুডা। কাকা, অভয় সিং চৌতালার সঙ্গে বিবাদের জেরে, আইএনএলডি থেকে বহিষ্কৃত হন ৩১ বছরের দুষ্মন্ত চৌতালা। দেশে সবচেয়ে কম বয়সে সংসদে যাওয়ার রেকর্ড তাঁর। আইএনএলডি ভেঙে জননায়ক জনতা পার্টি তৈরির, ১১ মাসের মধ্যেই সাফল্য পেলেন দুষ্মন্ত। জাট ভোটে ভাগ বসিয়ে আইএনএলডিকে মুছে দিলেন প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী দেবীলালের নাতির ছেলে। হরিয়ানা জাট বলয়ের ৩২টি আসনের মধ্যে ১৫টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস। বিজেপি ৮, জেজেপি ৪ এবং আইএনএলডি ১টি আসন পেয়েছে। ২০১৪-এ জাট ভোট সেভাবে পায়নি বিজেপি। অ-জাট নেতা মনোহরলাল খাট্টারকেই মুখ্যমন্ত্রী করে তারা।
মহারাষ্ট্র
জোট হলেও আসলে লড়াইটা ছিল বিজেপি-শিবসেনার। ভোটের ফল বেরোতেই দেখা গেল, দুই দলেরই আসন কমেছে। কোনও রকমে, মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা ধরে রাখল বিজেপি-শিবসেনা। ২৮৮ আসনের বিধানসভায়, বিজেপির আসন ১০৩। শিবসেনা পেয়েছে ৫৬টি আসন।কংগ্রেস ৪৬ এবং এনসিপি ৫৪টি আসন পেয়েছে। গত বিধানসভা ভোটে তুলনায় বিজেপি-শিবসেনা জোটের ২৬টি আসন কমেছে। ১৭টি আসন বাড়িয়ে নিয়েছে কংগ্রেস-এনসিপি। গত লোকসভা ভোটে তুলনায় বিজেপি-শিবসেনা জোটের ৭০টি আসন কমেছে। ৬০টি আসন বাড়িয়ে নিয়েছে কংগ্রেস-এনসিপি। ফল খারাপ হতেই বিজেপির ওপর চাপ বাড়িয়েছে শিবসেনা। সূত্রের খবর, ছেলে আদিত্য উপ-মুখ্যমন্ত্রী, সরকারে সমান অংশীদারি এবং ভবিষ্যতে সমান আসন ভাগাভাগি চাইছেন উদ্ধব ঠাকরে।
প্রধানমন্ত্রীর মত
নরেন্দ্র মোদী অবশ্য দুটি রাজ্যে আশঙ্কার ব্যাপার দেখছেন না। হরিয়ানায় সংগঠক হিসেবে তাঁর দায়িত্বের কথা স্মরণ করে মোদী বলেন,''এককালে হরিয়ানায় ১০টা আসন পেলেই অনেক ভাবতাম। সেই রাজ্যে ৫ বছর সরকার চালিয়েছি। তারপরও এই জয় কৃতিত্বের ব্যাপার। আজকাল ৫ বছর সরকারের প্রত্যাবর্তন দেখা যায়। মহারাষ্ট্র বা হরিয়ানা আমাদের গড় ছিল না কোনওকালেই। তবুও দুটি রাজ্যে ভালো ফল করেছি। দেবেন্দ্র ফড়ণবীস ও মনোহরলাল খট্টরকে সাধুবাদ জানাই।''
ফল বিশ্লেষণ
মহারাষ্ট্রে জোট হলেও পারস্পরিক অবিশ্বাসে অনেক আসনেই বিজেপি এবং শিবসেনার মধ্যে ভোট ট্রান্সফার হয়নি। মাটি কামড়ে পড়ে থেকে ফিরে এসেছেন মারাঠা স্ট্রংম্যান শরদ পওয়ার। ফল বলছে, নাসিক ও পুণে এলাকায় এনসিপি বিজেপি-শিবসেনা জোটকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। গত বিধানসভা ভোটের তুলনায় এনসিপির ১৩টি আসন বেড়েছে। লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ৩৩টি আসন বাড়িয়ে নিয়েছে তারা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পঞ্জাব ও মহারাষ্ট্র সমবায় ব্যাঙ্কে আর্থিক কেলেঙ্কারি, কৃষক আত্মহত্যা, মারাঠা সংরক্ষণের মতো ইস্যুও গেরুয়া শিবিরের আসন কমিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
দেশের বেহাল অর্থনীতি বড় কারণ তো বটেই। স্থানীয় স্তরে নানা বিষয়ে মানুষের ক্ষোভ ছিলই। ভোটের ফল বলছে, মহারাষ্ট্র-হরিয়ানায় বিধানসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর মুখ বিজেপিকে আগের মতো সাফল্য এনে দেয়নি। সন্ত্রাসদমন, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল, জাতীয় নাগরিক পঞ্জির মতো বিজেপি-র প্রচারের বিষয়গুলিতে কান দেননি ভোটারদের বড় একটা অংশ।
বরং তাঁরা ভোট দেওয়ার সময়, আর্থিক মন্দা এবং বেকারত্বের মতো বিষয়গুলিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।সীমান্তে সরকারের কড়া পদক্ষেপে ভোটারদের নিজেকে যতটা সুরক্ষিত মনে হয়েছে, তাঁর চেয়ে তাঁরা, অনেক বেশি নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছেন, বেহাল আর্থিক অবস্থায়। আর্থিক বৃদ্ধির হার তলানিতে পৌঁছেছে। গাড়ি-সহ উত্পাদন শিল্পে লেগেছে ধাক্কা। মাথা তুলতে শুরু করেছে মুদ্রাস্ফীতি। চাহিদার অভাবে মার খাচ্ছে ছোট ব্যবসা। আর এসবের প্রভাব সরাসরি এসে পড়েছে কর্মসংস্থানে। গত কয়েক মাসে গাড়ি-শিল্প থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। রুটি-রুজি হারিয়ে বা রুটি-রুজি হারানোর আশঙ্কায়, ভোটারদের একটা অংশ বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়েছেন।
ভোটপ্রবণতার বদল
দুই রাজ্যে কংগ্রেসের প্রচারে তেমন ধার ছিল না। সোনিয়া গান্ধী-প্রিয়াঙ্কা গান্ধী একটিও সভা করেননি। রাহুল নমো নমো করে প্রচার সেরেছেন। রাজনৈতিক মহল বলছে, মহারাষ্ট্র-হরিয়ানার জনাদেশ যতটা না বিরোধীদের পক্ষে, তার চেয়ে অনেক বেশি পদ্মপার্টির বিপক্ষে। লোকসভা নির্বাচনে, ওড়িশায় বিজেপি ভাল ফল করলেও, বিধানসভায় জিতে, ক্ষমতা ধরে রাখে বিজেডি। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার ফল দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ভোটে এবং রাজ্যের ভোটে আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে ভোট দিচ্ছেন মানুষ। আর এই প্রবণতা চলতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলিকেও তাদের প্রচারের কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
আরও পড়ুন- মোদী থাকা ও না-থাকার ফারাক, মাত্র ৬ মাসেই কমল বিজেপির ভোট, দেখে নিন পরিসংখ্যান