সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

হেমচন্দ্র ঘোষ আজ এক প্রায় বিস্মৃত নাম। সারা জীবন দেশের জন্য ভেবেছেন, দেশের জন্য কাজ করেছেন। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে সরাসরি দেশপ্রেমমূলক বাণী শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। পরবর্তী কালে তিনি দাবিও করতেন, স্বামীজির সঙ্গে তাঁর সেই সাক্ষাৎই তাঁর জীবনের লক্ষ্য চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট করে দিল। 


অরবিন্দ ঘোষ তাঁর 'বন্দেমাতরম্‌' পত্রিকার বিভিন্ন নিবন্ধে বারবার বিবেকানন্দের উল্লেখ করতেন। তিনি বিবেকানন্দকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণাপুরুষ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।


বিপ্লবীরা সেই সময়ে স্বামীজির দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁরা তাঁর লেখাপত্র থেকে খুঁজে নিতেন উদ্দীপনা। এর বিপুল সাক্ষ্য সেই সময়ের নানা জনের স্মৃতিতে, রচনায় থেকে গিয়েছে। হেমচন্দ্র ঘোষ এ বিষয়ে স্বয়ং এক দৃষ্টান্ত যে, স্বামীজির বাণীর প্রভাবে শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে!


কিন্তু দেশের স্বাধীনতা আন্দোন সংক্রান্ত কাজেকর্মে স্বামীজির এ হেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকার কথা কি ব্রিটিশরা জানত না?  


আরও পড়ুন:  Kamaladevi Chattopadhyay: 'সিধুজ্যাঠা'র স্ত্রী শিল্পী-সংগ্রামী কমলাদেবীকে আজ ক'জন মনে রেখেছে?


জানত। খুব ভাল করেই জানত। বহুদিন ধরেই জানত। ১৮৯৬ সালেই স্বামীজি যখন ইংল্যান্ডে যান, তখন লন্ডন পুলিস তাঁর সম্পর্কে একটি গোপন রিপোর্ট তৈরি করে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিবেকানন্দ নাম্নী ব্যক্তিটির উচ্চতা ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি, ভারী চেহারা, ডানদিকের কপালে কাটা দাগ। সন্ন্যাসী হলেও রাজনীতি সম্পর্কে উৎসাহী।


পরবর্তী কালে বিবেকানন্দের প্রভাব যে বাংলা এবং বাংলার বাইরের বিপ্লবীদের উপরও ছড়িয়ে পড়েছিল, তা স্বীকার করেছিলেন সেই সময়ের ব্রিটিশ পুলিসের কর্তা চার্লস টেগার্টও। বিবেকানন্দ-প্রয়াণের ঠিক পরেই টেগার্ট রামকৃষ্ণ মিশনের উপর একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন। ওই রিপোর্টে স্বামীজির বেশ কিছু রচনাকে 'আপত্তিকর' হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বাংলা ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীরা স্বামীজির দ্বারা অনুপ্রাণিত। ওই রিপোর্টে আর একটি অভিযোগও এনেছিলেন টেগার্ট। বলেছিলেন-- স্বামীজি মায়াবতীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পুলিসের নজর এড়িয়ে থাকার জন্য!


স্বামীজির সঙ্গে দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্কের কথা স্বীকার নিয়েছিলেন বিপ্লবী তথা তাঁর ছোট ভাই ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত। তিনি পরবর্তী সময়ে লেখেন, 'বিবেকানন্দের প্রতি আকর্ষণের ফলে বিপ্লবীরা তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হয়েছিলেন। মিশনের সঙ্গে অনেক বিপ্লবীর ছিল নিবিড় যোগাযোগ। অনেক বিপ্লবী পরবর্তী জীবনে রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়েছেন, এ দৃষ্টান্তও কম নয়। …আমার সতীর্থ স্বামী জ্ঞানাত্মনন্দ (পূর্বাশ্রমে সুধীরকুমার রায়চৌধুরী) পূর্ব জীবনে বিপ্লবী ছিলেন। তাঁকে আমার সঙ্গে প্রায় একই সময়ে ১৯১৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। বৎসরাধিককাল অন্তরীণ এবং বন্দিজীবন যাপন করার পর মুক্তি পেয়েই তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দেন।'


কিন্তু, এ তো গেল স্বাধীনতা-যজ্ঞে বিবেকানন্দের মন্ত্রশক্তির নানা নজির ও প্রেক্ষেপটের কথা। কিন্তু হেমচন্দ্রের সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল? 


আসুন, এবার ঢুকে পড়া যাক সেই প্রসঙ্গে। ১৯৭৮ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের ব্রহ্মচারী শঙ্কর বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার নেন। হেমচন্দ্র ওই সাক্ষাৎকারে বলেন বিবেকানন্দের মৃত্যুর একবছর আগে, ১৯০১ সালে তিনি বিবেকানন্দের সংস্পর্শে আসেন। তখন বিবেকানন্দ তাঁকে বলেছিলেন, 'আমাদের প্রথম দরকার স্বাধীনতা – Political freedom, তাই সর্বপ্রথম ইংরাজকে এদেশ থেকে তাড়াতে হবে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বুলি কপচিয়ে নয়, গায়ের জোরে, সংঘবদ্ধ সংঘটিত আক্রমণের সাহায্যে, Organized collective action under one leadership. তারা (ইংরেজরা) দস্যু, তস্কর, পরস্বাপহারী, তারা intruders, exploiters, তারা blood suckers-- আমাদের মায়ের বুকে বসে রক্ত খাচ্ছে। এই রাক্ষসদের আমাদের ধ্বংস করতে হবে। What right the Britishers have to rule our country? They shall have go back to England. It is our birthplace. To drive these intruders and plunderers away from our country, therefore, is your only religion. এই তোমাদের একমাত্র ধর্ম-- the only programme to be executed… যে ভাবে হোক, যে-কোনো প্রকারে হোক..।’


এ হেন হেমচন্দ্র ঘোষের জন্ম ১৮৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর। ১৯০১ সালে রাজনৈতিক জীবন শুরু হেমচন্দ্রের। উল্লাসকর দত্তের সাহায্যে বারীন ঘোষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। তিনি অনুশীলন ও যুগান্তরগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ রেখে নতুন দল গঠনের প্রেরণাও অনুভব করেন। ১৯০৫ সালে শ্রীশ পাল, হরিদাস দত্ত প্রমুখ সহযোগীদের নিয়ে 'মুক্তিসঙ্ঘ' গঠন করেন। ১৯০৬ সালে হেমচন্দ্র অরবিন্দ, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বিপিন পালের মতো বিপ্লবীদের সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতায় 'মুক্তিসঙ্ঘে'র একটি শাখা শ্রীশ পাল শুরুও করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৯০৮ সালে নন্দলাল ব্যানার্জির হত্যা (ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির দায়িত্বে ছিলেন এই পুলিস অফিসার) এবং ১৯১৪ সালে রডা কোম্পানির অস্ত্রলুণ্ঠন তাঁর বড় কাজ। ১৯১৪ সালেই হেমচন্দ্রকে রডা কোম্পানির অস্ত্রলুণ্ঠন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯১৮ সালে তাঁকে রাজবন্দি হিসাবে হাজারীবাগ কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন কারাগারে কাটানোর পরে মুক্তি হয় তাঁর। মুক্তি পেয়ে কলকাতায় আসেন ও গোপনে দল সংগঠনে সক্রিয় হন। পরে হেমচন্দ্রদের 'মুক্তিসঙ্ঘ' পরিচিত হয় 'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স' নামে। তখনও দারুণ সক্রিয় তিনি। ১৯৩০ সালে দার্জিলিংয়ে তদানীন্তন বাংলার গর্ভনর জন অ্যান্ডারসন হত্যার চেষ্টা করেন। ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্রের সমর্থনে সরব হন। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল-পর্বে জেলের বাইরে ছিলেন মাত্র দেড় বছর। 


পরবর্তী কালে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার প্রদত্ত তাম্রপত্র তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। অগ্নিযুগের এই আগ্নেয় সন্তানের মৃত্যু হয় ১৯৮০ সালের ৩১ অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুতে ভারতমাতা তার এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারায়। 


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)


আরও পড়ুন: Khudiram Bose Death Anniversary: 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি'