সুদীপ দে: পরিযায়ী শ্রমিকরা ভাল নেই। করোনার প্রকোপে গোটা দেশ জুড়ে যখন লকডাউনের কড়াকড়ি, তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, কেরলের মতো রাজ্যগুলিতে আটকে পড়েছেন হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক। শুধুমাত্র বেঙ্গালুরুতেই মোট জনবসতির প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষই পরিযায়ী শ্রমিক (তথ্যসূত্র: দ্য হিন্দু পত্রিকা)।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

এঁদের বেশিরভাগই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বাঙালি। এঁরা মূলত, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগণা এবং হাওড়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে ছুটে এসেছিলেন এই শহরে। এঁদের মধ্যে কেউ রাজমিস্ত্রি বা রাজমিস্ত্রির সহায়ক, তো কেউ আবার কাঠের মিস্ত্রি, বস্ত্রনির্মাণ শিল্পী, অলংকার শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। কেউ আবার এই শহরে গাড়ি চালিয়ে পেট চালান। এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার শহরের বিভিন্ন প্রান্তের আবাসনে সিকিউরিটি গার্ড, ইন্টিরিয়র ডেকরেশন বা বহুতল অ্যাপার্টমেন্টে মেইন্টেনেন্স স্টাফের কাজ করেন। এই সমস্ত মানুষ পুরোপুরি দৈনিক মজুরির উপর নির্ভর না করলেও এঁদের আর্থিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল নয়। তাই এঁরা চার-পাঁচজন, কখনও বা তারও বেশি সংখ্যক মানুষ একসঙ্গে মিলে ৪,০০০ থেকে ৬,০০০ টাকায় এক কামরার ঘরগুলিতে ভাড়া থাকেন।



এঁরা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের সিংহভাগই বেঙ্গালুরুতে আবর্জনা সংগ্রহ করেন। এই সংগৃহীত আবর্জনা থেকে কাঁচের বোতল, প্লাস্টিক ও পিচবোর্ড আলাদা করে পুনরায় বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন এঁরা। এই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলির অবস্থা এই লকডাউনে আরও করুণ। এঁদের পরিবারের মহিলারা শহরের বিভিন্ন আবাসনগুলিতে পরিচারিকার কাজ করেন। এঁরা পূর্ব বেঙ্গালুরুর হোয়াইটফিল্ড, বেলান্দুর, ভার্থুর, কুন্দনাহাল্লি অঞ্চলে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টের পিছনে টিনের আর প্লাস্টিকের অস্থায়ী ছাউনিগুলিতে বসবাস করেন।


কিন্তু বর্তমানে দেশজুড়ে চলা দীর্ঘ লকডাউনের জেরে এঁদের বেশির ভাগেরই রুজি-রুটির পথ বন্ধ। সম্পূর্ণ অচেনা অজানা শহরে আটকে পড়েছেন এমন হাজার হাজার মানুষ। এঁদের কাছে না আছে ফ্রিজ ভর্তি খাবার, না আছে খাবার জোগাড়ের আর্থিক সামর্থ। এমন অগণিত পরিবার এখানে রয়েছে যাদের কাছে তাঁদের শিশুদের মুখে সামান্য দুধ তুলে দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই! স্থানীয় পরিচয় পত্রের অভাবে এঁরা স্থানীয় সরকারের সব রকম সাহায্য থেকেও বঞ্চিত।



দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণার মুহূর্তে ঠিক এই আশঙ্কাটিই দানা বেঁধেছিল বেঙ্গালুরুর বুকে বেশ কিছু সমাজ সচেতন প্রবাসী বাঙালির মনে। তাই লকডাউনে নিজেদের রাজ্যে ফিরে না এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন হাজার হাজার দরিদ্র, অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এ অফিসের দায়িত্ব সামলে এই অসহায় মানুষগুলোকে দু’-বেলা, দু’-মুঠো খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন বেঙ্গালুরুর এই প্রবাসী বাঙালিরা। এই উদ্যোগে তাঁরা পাশে পেয়েছেন কর্ণাটক 'ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতি' (BGVS)-কে।


২৫ মার্চে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হওয়ার পর ২৭ মার্চ থেকে একজোটে এই প্রবাসী বাঙালির দল বিভিন্ন উপায়ে বেঙ্গালুরুতে আটকে পড়া অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের খোঁজ পেতে শুরু করে, যাঁদের অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি। শুরুর দিকে, ৩১ মার্চ পর্যন্ত তাঁরা প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০টি করে শহরে আটকে পড়া বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের খোঁজ বা ফোন পেতেন। স্থানীয় প্রশাসনের সমস্ত বিধি-নিষেধ মেনেই তাঁরা ৮টি গাড়ির জরুরি (ইমারজেন্সি) পাস (Corona Emergency Response Team Pass) জোগাড় করতে সক্ষম হন এবং শুরুর দিনগুলিতে মোটামুটি নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করেই ওই সব দরিদ্র, অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে খাবার ও রেশন পৌঁছে দিতে শুরু করেন।



এই উদ্যোগের মূল কাণ্ডারি ধীমান সাউ জানান, এই ফোন কলের সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৬০টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনও পর্যন্ত BGVS-এর সহায়তায় জনা কুড়ি প্রবাসী বাঙালি মিলে প্রায় ২০ হাজার পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে খাবার ও রেশন পৌঁছে দিতে পেরেছেন। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অন্য রাজ্য থেকে আসা শ্রমিকরাও রয়েছেন তাঁদের সাহায্যের তালিকায়। যেমন, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটকেরই অন্যান্য জেলাগুলি থেকে আসা কয়েক হাজার মানুষ বিপদের সময় দু’-বেলা, দু’-মুঠো খেয়ে বাঁচতে পারছেন।


ধীমানবাবু জানান, এই কর্মকাণ্ডে যাঁরা সামিল হয়েছেন, তাঁদের কারও কাছেই এই কাজ এক মুহূর্তের জন্যেও দান বা সমাজ সেবার মতো কোনও বিষয় হয়ে ওঠেনি। এই দলের প্রত্যেকের কাছেই এটি একটি দায়িত্ব! এক নাগরিক হিসেবে আর এক সহনাগরিকের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব। একজন মানুষ হিসেবে আরেক জন মানুষের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব!


এই জনা কুড়ি প্রবাসী বাঙালি, যাঁরা প্রায় ২০ হাজার পরিযায়ী শ্রমিকদের দু’-মুঠো খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই রাত কাটছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এ অফিসের দায়িত্ব সামলে আর দিনের বেলাটা হাজার হাজার দরিদ্র, অসহায় মানুষের খোরাক জোগাড়ের তোড়জোড়ে। টিকটক, ডালগোনা কফি, নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজনের বিনামূল্য বিনোদনের বিলাসিতা ছেড়ে এঁরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন সহায়সম্বলহীন পরিযায়ী শ্রমিকদের বাঁচানোর তাগিদে।



অফিসের দিনগুলিতে অত্যধিক দূরত্বের কারণে সেখানে সব জায়গায় পৌঁছতে না পারলেও সপ্তাহান্তে শনিবার এই দলের পল্লবী, শীর্ষেন্দু, সুমিতরা সকাল সকাল চাল, আলু নিয়ে পৌঁছে যান, যাতে সহায়সম্বলহীন মানুষগুলোকে একটি দিনও আধপেটা খেয়ে কাটাতে না হয়।


আরও পড়ুন: করোনা রেড জোনগুলিতে বলবত থাকবে লকডাউন, মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে ইঙ্গিত নমোর


ধীমানবাবু বলেন, “স্বেচ্ছাসেবক বন্ধুদের ছাড়াও আমরা পাশে পেয়েছি আরও কিছু প্রগতিশীল সংগঠনকে। এদের মধ্যে রয়েছে বর্ন টু হেল্প (Born to Help), বরাহনগর রামকৃষ্ণ মিশনের ২০০৬ সালের প্রাক্তনীরা, বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন আবাসন কমিটি ও অন্যান্য রাজ্যের ও কর্ণাটকের অন্যান্য জেলার BGVS সদস্যরা। এছাড়াও আমরা পাশে পেয়েছি অসংখ্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের, যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের আর্থিক অনুদান ছাড়া আমাদের পক্ষে এই কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হতো না।”


সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বেড়েছে এই প্রবাসী বাঙালি দলের কাঁধে। তবে সেই তুলনায় এখনও তাঁদের স্বেচ্ছাসেবক সংখ্যা বা প্রয়োজনীয় অর্থ অপ্রতুল। বহু পরিযায়ী শ্রমিক সংকটে আছেন, যাঁদের কাছে এখনও পৌঁছতে পারেননি ধীমানবাবু ও তাঁর বন্ধুরা। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জিতিয়ে দিতে এখনও লড়াই চালাচ্ছেন এই জনা কুড়ি প্রবাসী বাঙালি।