সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

শেক্সপিয়র বলেছিলেন, নামে কিবা আসে-যায়। অশ্বিনী চৌবে যা বললেন, তাতে মনে হওয়া অন্যায় নয় যে, তিনি স্ট্র্যাটফোর্ড-আপ-অন-আভন-এর ওই ভয়াবহ প্রখ্যাত লোকটির ভয়ানক বিখ্যাত কথাটিকে সটান উড়িয়ে দিয়েই যেন বলতে চাইছেন, হ্যাঁ, মশাই, নামেই আসে যায়!


প্রমাণ?


হ্যাঁ, এই তো হাতের কাছেই। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে সম্প্রতি 'নরেন্দ্র' শব্দটির অক্ষরবিন্যাস ও ধ্বনিমন্দ্রের অপূর্ব সাদৃশ্যের পাত্রে নরেন্দ্ররূপ স্বামী বিবেকানন্দ এবং নরেন্দ্ররূপ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এক সঙ্গে আঁটিয়ে ফেলেছেন! সন্দেহ নেই, এ অশ্বিনীর অভূতপূর্ব সৃষ্টিশীলতারই নজির! অবশ্য এত পার্থিব বিষয়ে নিজেকে বেশিক্ষণ আটকেও রাখেননি তিনি। পঞ্চভূত ছেড়ে সরাসরি আত্মায় মনোনিবেশ করেছেন দ্রুত। তিনি বলেছেন, "... আমাদের গর্ব, নরেন্দ্র দত্ত নরেন্দ্র মোদীর আত্মায় প্রবেশ করেছেন। ভারত একুশ শতকের অগ্রণী দেশ হয়ে ওঠার চৌকাঠে।" তাই নাকি? এমন হয়? ওঁরা বলবেন, হয়, হয়, খুব হয়; হয় না যেটা সেটাও হয়! এ ঘটনা অবশ্য ১৩ সেপ্টেম্বরের। ওই দিন বিহারের জন্য একগুচ্ছ কেন্দ্রীয়  প্রকল্পের উদ্বোধনী ভিডিয়ো-প্রোগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে অশ্বিনী এই মহাবচনটি উচ্চারণ করেছিলেন। 


শুক্রবারও প্রায় সেই পথই অনুসরণ করলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই। আগের দিনের মতো বিহারের জন্যই আরও একগুচ্ছ প্রকল্প ঘোষণার অনুষ্ঠানই সেদিন চলছিল। সেখানে মোদীভক্তিগদগদ নিত্যানন্দের দাবি, এক নরেন্দ্র (পড়ুন স্বামীজি) একুশ শতকের ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আর অন্য নরেন্দ্র (পড়ুন মোদিজি) তা পূরণ করছেন! আহা, কবি কালিদাস লাগেন কোথায়! উপমা নিত্যানন্দস্য!


মোদী-রাজের মন্ত্রীসভার সদস্যরা যে তাঁদের রাজাকে ঘিরে মাঝেমাঝেই স্তুতির এরকম মণিমুক্তো ছড়ান, তার কারণটা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। কেননা, ছোট বেলায় চান করতে গিয়ে কুমিরছানা ধরে আনা বা সন্ন্যাসী হতে গিয়ে রাজনীতিবিদ হয়ে যাওয়ার নানা গল্প তিনিই বিভিন্ন পরিসরে বারেবারে বলে থাকেন। তাতে একটা আবহ তৈরি হয়। কিন্তু সেই আবহের আবহাওয়া নিয়ে মোদীজি মোটেই চিন্তিত নন।


কিন্তু সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। সে বিষয়ে তাঁর পূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। নিজের জীবন নিয়ে নিজের মতো করে নানা কথা তিনি বলতেই পারেন। একশোবার বলুন, যদি না সেখানে অন্য প্রসঙ্গও সুচারুভাবে গেঁথে নেওয়ার অনুকূল আবহাওয়া তৈরি করার একটা নিভৃত বাসনা নীরবে কাজ করে চলে! আশঙ্কাটা সেখানেই।


'নরেন্দ্র' নামশব্দটিকে ঘিরে এই যা চলল, সেটাও হয়তো আপাতভাবে খুব ভয়ঙ্কর কিছু নয়। যতটা ভয়ঙ্কর স্বামী বিবেকানন্দকে এখানে নির্দ্বিধায় টেনে আনা। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সেলটি দীর্ঘদিন ধরেই খুব নিরুচ্চার ভাবে কিন্তু বেশ কৌশলপ্রবণতায় স্বামীজির নাম এবং ভাবমূর্তিটিকে তাদের একেবারেই নিজস্ব হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডায় অবলীলায় যুক্ত করে ফেলে কোথাও গিয়ে যেন এটাই প্রমাণ করতে চাইছে, স্বামীজির ভাবধারাতেই এই বিজেপি চলছে অথবা স্বামীজি যা বলে বা করে গিয়েছেন, তা, প্রকারান্তরে হালের বিজেপির হিন্দুত্ববাদী কাজকর্মেরই উনিশ শতকীয় ভার্সান! আপত্তিটা সেখানেই।


ক্যাটেগরিকালি দেখলে বিবেকানন্দ হিন্দু সন্ন্যাসীই এবং তিনি হিন্দু জাগরণের কথা যে কোথাও বলেননি তা-ও নয়। কিন্তু তাঁর যে হিন্দুত্ববাদ আর বিজেপির যে হিন্দুত্ববাদ, তা সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দুই বস্তু। স্বামীজির কাজকর্ম-লেখালেখি-ভাবনাচিন্তাকে যদি তর্কের খাতিরে হিন্দুত্ববাদী বলে শেষ পর্যন্ত অ্যাখ্যা দিতেই হয়, তবে বলতেই হয়, এই হিন্দুত্ববাদ অনেক মহৎ, অনেক গভীর, অনেক ব্যাপক এবং আগাগোড়া একটা ইনক্লুসিভ ব্যাপার। যেখানে সকলের ঠাঁই আছে। উল্টোদিকে, বিজেপির হিন্দুত্ববাদ কি অনেকটা সঙ্কীর্ণ, অগভীর এবং এক্সক্লুসিভ ব্যাপার নয়! যেখানে চয়েস কাজ করে, যেখানে আদপেই সকলের ঠাঁই নেই! অথচ, এই দুই ভিন্নধর্মী ভাবধারাকে বারবার একসঙ্গে গেঁথে ফেলার অপচেষ্টার ফলে উত্তর প্রজন্মের কাছে নির্ঘাৎ ভুল বার্তা যাচ্ছে।


অথচ, বিজেপি এটা খুব তন্নিষ্ঠ ভাবে চেষ্টা করে চলেছে। বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়েও তারা এটা করেছে এবং অনেকাংশে সফল হয়েছে। বিবেকানন্দকে নিয়েও সেটা সফল ভাবে করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাজটা কঠিনই। একশো বছরেরও বেশি আগে শ্রীনগরে ডাল লেকে এক মুসলমান মাঝির মেয়েকে কুমারী রূপে পুজো করে বিবেকানন্দ যে মহান ও উদার মানসিকতার প্রকাশ দেখিয়েছিলেন, সেই উদারতা থেকে এখনও বহু বহু যোজন দূরেই বসবাস করছে বিজেপি বা তাদের ভাব-সঙ্ঘ।


অথচ, কী জটিল আত্মবিশ্বাসে অশ্বিনী বা নিত্যানন্দেরা অনায়াসে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেই স্বামীজিকে দেখছেন! অহো কী দুঃসহ স্পর্ধা! জয় হোক তাঁদের অটল প্রভুভক্তির! তবে তাঁরা বোধ হয় বুঝতে পারছেন না, প্রধানমন্ত্রীর দেহে বা আত্মায় স্বামীজির এই সাযুজ্য-দর্শন প্রচার করে তাঁরা আসলে প্রকৃত হিন্দুত্ববাদেরই ক্ষতি করছেন। যা যুগ যুগ ধরে বহু স্তরে প্রসারিত হয়ে বয়ে চলেছে, তার গতি রোধ করে তাকে এক অন্ধ বোবা খাতে বইয়ে দিতে চাইছেন। আর সেজন্য বিবেকানন্দকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন।


অবশ্য দেখতে গেলে মোদী ও স্বামীজিকে ঘিরে খুব একটা ভুলও হয়তো বলেননি তাঁরা। ভক্তেরা বলে থাকেন, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ স্বামীজির এই দেশকালচক্র থেকে মুক্তি লাভ করে অখণ্ড ব্রহ্মলোকে লীন হওয়ারই কথা। অথচ, স্বয়ং স্বামীজি বলেছিলেন, যতক্ষণ এ দেশের একটি আত্মাও মুক্তি না পেয়ে কষ্ট পাবে ততক্ষণ তিনি জন্ম নেবেন এবং সেই মুক্তিকামীকে সাহায্য করবেন। ফলে, স্বামীজির আত্মা যদি মোদীজির মধ্যে এখন ঢুকেও পড়ে, বিষয়টায় কোনও আপত্তি করা যায় না! মুক্তিকামী নরেন্দ্রজিকে তিনি প্রভূত সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, কোন অবস্থা থেকে মুক্তি চাইছে এই-নরেন্দ্রের মন?