#Netaji125: হৃদয়ে রক্তাক্ত ক্ষতের বীভৎসতা নিয়েই মহা-কালের দিকে মৃত্যুহীন এক যাত্রা তাঁর
সুভাষের হৃদয়ও তো ছিল শ্মশানের মতোই নিস্পৃহ, নির্মোহ, পিছুটানহীন, আত্মনিবেদিত!
সৌমিত্র সেন
সময়টা ১৯১২-১৩ সাল। স্বামী বিবেকানন্দ রাজ-সমারোহে প্রবেশ করলেন কটকের র্যাভেনশ স্কুলে পাঠরত এক কিশোরের হৃদয়ে। প্রবেশ করলেন এবং লহমায় জয় করে নিলেন তার জীবন-যৌবন-হৃদয়-মন সব। এরপর সারা জীবন ছেলেটির আর এই সন্ন্যাসীর হাত থেকে ছাড় মিলল না!
সন্ন্যাসীর হাত থেকে না বলে কালের হাত থেকেও বলা চলে। 'কাল' মানে, একটা বৃহৎ সময়খণ্ড; যে-সময়খণ্ডের আধারে ক্রমশ জারিত-জাগরিত হতে থাকবে এই কিশোরটির মন, অনাগত দিনে যে নিজেই দীপ্ত যৌবনের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠবে, ছাড়িয়ে যাবে দেশ-কালের সীমা-পরিসীমা। যে-কাল আবার শুধু সময়খণ্ডই নয়; যা এক অর্থে মৃত্যুও, ধ্বংসও! মৃত্যুহীন এক মৃত্যুর অমৃতত্বে বিজারিত ছেলেটির পরবর্তী জীবন, সন্ন্যাসের রঙেই, অর্থাৎ, ত্যাগের রঙেই রঞ্জিত, মথিত, স্পন্দিত।
ছেলেটি, অতএব, সকলেই বুঝছেন, আর কেউ নয়, এক ও অদ্বিতীয় সুভাষচন্দ্র; পরবর্তী কালের অমর বীর দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আজ, এই ২৩ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিন। এবারের ২৩ জানুয়ারি আরও বিশেষ কেননা, এটি নেতাজির ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী।
কিন্তু, সব চেয়ে বড় কথা 'বীর' 'দেশপ্রেমিক' 'স্বাধীনতা' 'সংগ্রামী' 'নেতাজি' ইত্যাদি তকমা তাঁর কাছে যেন ছোট হয়ে পড়ল, এসব যেন তাঁর বিশ্ববন্দিত পরিচয় হয়েও কোথাও গিয়ে শেষমেশ তাঁর বাইরের তকমা হয়েই দাঁড়িয়ে থাকল; আর তিনি এক অটল অধীর অনন্য যাপনে ক্রমশ নিভৃতি থেকে নিভৃতিতে সঞ্চরমাণ এক কাল-সাধক তথা মৃত্যুসাধক হয়ে পড়লেন।
ছেলেটি একদা নিজেও তো আর কিছু নয়, সন্ন্যাসীই হতে চেয়েছিল। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের সঙ্গে তার কিশোরবেলার এই যোগের আরম্ভের অবশ্য একটা সলতে-পাকানো-পর্বও ছিল। সুভাষের বাবা জানকীনাথের পরিচয় ছিল কটকের বিশিষ্ট মানুষ বাবু হরিবল্লভ বসুর সঙ্গে। যে-হরিবল্লভ ছিলেন একান্ত রামকৃষ্ণ-পরিকর কলকাতার বাগবাজারস্থিত বলরাম বসুর তুতো ভাই। ফলত, বোঝাই যায় পরিচয়ের গভীরতা ও ব্যাপ্তি। আর তা এখানেই থেমে যায় না। রামকৃষ্ণের মানসপুত্র তথা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট স্বয়ং স্বামী ব্রহ্মানন্দ ওরফে রাখাল মহারাজেরও স্নেহের পাত্র ছিলেন সুভাষপিতা জানকীনাথ। নিজের হৃদয়-মনের উথাল-পাথাল-পর্বে, তারুণ্য়ের উদয়াচলে মুখ করে অপেক্ষমাণ প্রদীপ্ত সুভাষ ঘটনাচক্রে যে-ব্রহ্মানন্দের কাছেই তার পরবর্তী জীবনের দিশা পেয়ে যান; সন্ন্যাসগ্রহণ তার আর হয় না, কিন্তু প্রকারান্তরে সন্ন্যাসগ্রহণই হয়, কেননা, সে তো আদতে অজান্তে মৃত্যুকেই গ্রহণ করে ফেলে এবং পড়ে যায় এক মহা-কালের অনন্ত সুগভীর মুখব্যাদানের আলোকিত অন্ধকারে। ওই বিবেকানন্দের মতোই এর হাত থেকেও তার আর নিস্তার রইল না!
'প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন বন্দী' কে নয়? কিন্তু সেই পরিস্থিতি থেকেই তো যথার্থ মরমির চোখে পড়ে যায় বিশ্বের আকাশে বহমান 'লাবণ্যের মৃত্যুহীন স্রোত'ও। সেই কিশোরটির চোখেও ঠিকরেছিল সেই আলো। তাই তার অন্তরাত্মা যেন সারা জীবন ধরেই বলে উঠছিল-- 'স্বর্গলোভ নাহি মোর, নাহি মোর পুণ্যের সঞ্চয়/লাঞ্ছিত বাসনা দিয়া অর্ঘ্য তব রচি আমি আজ:/শ্বাশত সংগ্রামে মোর আহত বক্ষের যত রক্তাক্ত ক্ষতের বীভৎসতা,'; 'এই রক্তাক্ত ক্ষতের বীভৎসতা'ই তিনি নিভৃতে বয়ে বেড়ালেন সারা জীবন, সারা মরণ, হয়তো সেভাবে কারও চোখে পড়ল না। তাঁর অমর বীর পরিচয়েই ঢাকা রইল আর সব কিছু বেদন-সংবেদন।
পরে স্বামীজির বিখ্যাত কবিতা 'নাচুক তাহাতে শ্যামা' থেকে তো উদ্ধৃতিও দিয়েছে আকণ্ঠ বিবেকানন্দ-মগ্ন এই ছেলেটি। ১৯২৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পাবনা জেলা যুব সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে সুভাষচন্দ্র এক দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। সেখানে বিশ্বে পরিচিত প্রচলিত নানা 'ইজম' নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। তবে যে কোনও 'ইজম'-য়ে অবগাহন করার আগে চরিত্রগঠনের কথা বলেন তিনি। একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারলে তবেই অংশ নেওয়া যায় জীবনের সমাপ্তিহীন যুদ্ধে। সুভাষ আবৃত্তি করে ওঠেন-- 'জাগো বীর, ঘুচায়ে স্বপন, শিয়রে শমন, ভয় কি তোমার সাজে?/ দুঃখভার, এ ভব-ঈশ্বর, মন্দির তাহার প্রেতভূমি চিতামাঝে॥/ পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার, সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তোমা।/ চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা॥'
এ কবিতা সুভাষের বরাবরই প্রিয়; এ তার সারা জীবন ধরে বহুপঠিত, বহুচর্চিত,বহু অনুভূত আবেগের স্পন্দনে রণিত-ক্বনিত কাব্য, দর্শনও। কেননা, সন্ন্যাস থেকে ফিরে-আসা সুভাষের হৃদয়ও তো ছিল শ্মশানের মতোই নিস্পৃহ, নির্মোহ; সেখানে তো শ্যামা-রূপী মৃত্যুরই চিরন্তন লীলাবিলাস!
('প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন বন্দী' এবং 'স্বর্গলোভ নাহি মোর .... রক্তাক্ত ক্ষতের বীভৎসতা' ইত্যাদি বুদ্ধদেব বসুর 'বন্দীর বন্দনা' কবিতা থেকে নেওয়া)
আরও পড়ুন: নেতাজি জন্মবার্ষিকীকে জাতীয় ছুটি ঘোষণার দাবিতে আরও একবার সরব মমতা!