জ্যোতির্ময় কর্মকার এবং নির্ণয় ভট্টাচার্য্য


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

বৃহস্পতিবার দিনের শেষে সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসে, 'ঐক্যে'র সঙ্গে পার্টি কংগ্রেস শেষ করার কথা বললেন সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, 'ঐক্যে'র সঙ্গে চলতে পারাটাই পার্টি কংগ্রেসের দ্বিতীয় দিনে ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।


দলের কয়েক হাজার 'সাধারণ কমরেড' সমর্থন জানালেও, সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে বর্তমানে 'সংখ্যালঘু' দলেরই সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। 'সাম্প্রদায়িক বিজেপি'-কে রুখতে সিপিএম কি 'ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক' দলগুলির (পড়ুন, কংগ্রেস) হাত ধরবে না কি কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে কেবল বাম গণতান্ত্রিক দলগুলির সঙ্গেই জোট বেঁধে লড়বে? সাম্প্রতিক অতীতে এই 'মতাদর্শগত' দ্বন্দ্বেই জেরবার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)। ইয়েচুরি প্রথম থেকেই 'বেঙ্গল লাইন' তথা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দলগুলির সঙ্গে একজোট হয়ে লড়ার পক্ষে। তাঁর দাবি, পদ্ম কাঁটা উপড়ে ফেলতে দল যেখানে দুর্বল সেখানকার কমরেড ও পার্টি সমর্থকদেরও ভোট দান সুনিশ্চিত করতে হবে। আর সেই ভোট যদি না বিজেপি বিরোধী বলিষ্ঠ জোটের পক্ষে যায়, তাহলে তা ফলপ্রসু হবে না। উল্লেখ্য, সিপিএম-এর পার্টি কংগ্রেসের প্রথা অনুযায়ী, সাধারণ সম্পাদকের উদ্বোধনী ভাষণ শুরু হয় যথাক্রমে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, জাতীয় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও পার্টির অবস্থান ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে। কিন্তু, এবার উদ্বোধনী ভাষণের সেই রীতি ভেঙে প্রথমেই বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর ডাক দেন তিনি। প্রথমেই এভাবে সরাসরি জাতীয় পরিস্থিতিতে চলে আসার মধ্যে দিয়েই ইয়েচুরির চোখে বিজেপি বিপদ যে কতটা প্রকট তা প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে, 'রক্ষণশীল' প্রকাশ কারাত বরাবরই হাত ছেড়ে বাম সংহতির হয়ে সওয়াল করেছেন। দফায় দফায় আলোচনা করেও এই মতানৈক্যের কোনও সমাধান তো হয়নি, বরং ফাটল চওড়া হয়েছে ক্রমশ। শেষ পর্যন্ত ২২তম পার্টি কংগ্রেসে এসে সেই ফাটল আরও বেড়ে পার্টিকে দু'টুকরো করে দেবে কি না সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।


শৃঙ্খলাপরাণ ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতায় আস্থাশীল সিপিএমের চলতি হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে বিরোধ এতটাই মাথা চাড়া দিয়েছে যে নজির বিহীন ঘটনার তালিকাটি ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে চলেছে। যেমন- পার্টি কংগ্রেসের  প্রথম দিন অর্থাত্ বুধবার ইয়েচুরির উপস্থিতিতেই বেনজিরভাবে খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছেন প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত। জানা যাচ্ছে, ইয়েচুরিকে এই প্রস্তাব পেশ করতে দেওয়া হয়নি। পরে সাংবাদিক বৈঠকে ইয়েচুরি নিজে এই ঘটনাকে বেনজির মানতে নারাজ হলেও এমন ঘটনা সিপিএম-এ সাম্প্রতিককালে হয়েছে বলে মনে করতে পারছেন না রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। এরপর, আবার ইয়েচুরি পৃথকভাবে 'কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যালঘু অংশে'র খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, দলের সাধারণ সম্পাদকের এমন 'সংখ্যালঘু অংশে'র খসড়া প্রস্তাব পেশের উদাহরণও কাস্তে হাতুড়ি তারার ইতিহাসে এই প্রথম। আর এরপর যদি কংগ্রেস না কংগ্রেসকে ছেড়ে শুধুই বাম জোট, এই ইস্যুতে শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটি হয়, তাহলে সেটিও হবে নিকট অতীতে প্রথমবার। এর আগে বিভিন্ন ইস্যুতে পার্টি কংগ্রেসে ভোটাভুটি হলেও, দলের রণকৌশল নির্ধারণে (ট্যাকটিকাল লাইন) কখনও ভোট হয়নি। পাশাপাশি, গোপন ব্যালটেও ভোট হয়নি কখনও। উল্লেখ্য,  এদিন সাংবাদিক বৈঠকে ইয়েচুরি নিজমুখেই জানিয়েছেন, ১৯৭৫ সাল থেকে মোট ১২টি পার্টি কংগ্রেসে তিনি উপস্থিত থেকেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতায় তিনি কখনও পার্টি কংগ্রেসে গোপন ব্যালটে ভোটাভুটি দেখেননি। কিন্তু, এবার যা পরিস্থিতি তাতে গোপন ব্যালটে ভোটাভুটি কার্যত সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছে সিপিএম-এরই একটা বড় অংশ।


কিন্তু, কী এমন হল সিপিএম-এ?


প্রথা অনুযায়ী এবারও চলতি বছরের জানুয়ারিতে সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে পার্টি কংগ্রেসের খসড়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে সেই প্রস্তাবের বিষয়ে সাধারণ পার্টি কমরেডদের মতামত জানার জন্য তা প্রকাশ করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, জানুয়ারিতে কারাত লবির কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে একলা চলোর প্রস্তাবে প্রস্তাবই গৃহীত হয়েছিল কেন্দ্রীয় কমিটিতে। আর এরপর থেকে এ কে গোপালন ভবনে ওই প্রস্তাবের উপর প্রায় ৭ হাজার সংশোধনী জমা দেন 'সাধারণ কমরেড'রা। এইসব সংশোধনীর খাম খুলে দেখা গেছে, অধিকাংশ কমরেডরাই 'বেঙ্গল লাইন' তথা ইয়েচুরির মত অর্থাত্ কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধার পক্ষ সায় দিয়েছেন। আর 'বেঙ্ল লাইন' বা ইয়েচুরির দিকে এত বিপুল সংখ্যক কমরেডদের সমর্থন থাকাতেই 'কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যালঘু' হওয়া সত্ত্বেও ভোটাভুটির পথে হাঁটাটা অনিবার্য হয়ে উঠেছে।


মতাদর্শগত কারণে সিপিএম-এর অন্দরের অবস্থা এখন এতটাই অগ্নিগর্ভ যে মহারাষ্ট্রে পার্টির সম্পাদক পদমর্যাদার নেতা উদয় নারভেলকরের মতো অনেকেই চাইছেন ভোটাভুটি হোক। প্রয়োজনে পার্টি আবারও ভেঙে যাক। নারভেলকর ঘোষিত ইয়েচুরিপন্থী। তিনি মনে করছেন,  মতাদর্শগত মতানৈক্য যে যায়গায় পৌঁছেছে, তাতে দল ভাগ হয়ে গেলেও কোনও সমস্যা নেই। অতীতেও যে বহুবার দল ভেঙেছে সে কথা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় দাঁড়িয়ে, আগামীকাল অর্থাত্ শুক্রবার বিকালেই এই দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত পরিণতি সামনে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সে সময়, ইয়েচুরির কাঙ্খিত 'ঐক্য' থাকবে না কি ইয়েচুরি থাকবেন, তা নিশ্চিত নয়।