পাউরুটি আর ঝোলাগুড় থাকতে চাল-ডাল-আলু নিয়ে কেন এই গেল-গেল!
সৌমিত্র সেন
সৌমিত্র সেন
সকাল হতে-না-হতেই নারদ ঢেঁকি চেপে বিষ্ণুর সমীপে। শ্রীবিষ্ণু তখন যথারীতি অনন্তশয্যায়। তাঁকে কিঞ্চিৎ বিচলিত বোধ হচ্ছে। প্রণামাদি জানিয়ে নারদ বিষ্ণুকে কারণ জিগ্যেস করলেন। বিষ্ণু বললেন, নারদ, তোমাকে অচিরেই একবার মর্ত্যে যেতে হবে। লক্ষ্মী আজ খুব মনোকষ্টের সঙ্গে বললেন, আগের মতো সেখানে লোকজন আর সন্ধেবেলা ভক্তিভরে তাঁকে ডাকে না। তার বদলে তারা নাকি কী একটা বাক্সের সামনে বসে তার ভিতরের চলমান কী সব ছবি দেখে, যা প্রত্যেকদিন হয়।
প্রভু, আমি এখন মর্ত্য থেকেই আসছি। মর্ত্যে সত্যিই লক্ষ্মী চঞ্চলা হয়েছেন। লক্ষ্মীদেবীর উদ্বেগ যথাযথ। তবে, বাক্সভর্তি চলমান যে ছবির কথা আপনি বলছেন, তা নয়। আমি অন্য এক সংবাদ আপনাকে দেব।
কী সংবাদ?
মর্ত্যে নাকি চালের সঙ্গে ডাল-আলু-তেল ইত্যাদির একটা সঙ্কট আসছে। লোকজন ভয়ানক উত্তেজিত। আমি কিছু কিছু শুনে এলাম।
কী শুনলে?
খোঁজ নিয়ে যা জানলাম তা হল, ওখানে সংসদ বলে একটা জায়গায় ওদের নিয়মকানুন ঠিক হয়। সেই সংসদে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন সংক্রান্ত একটি বিল পাশ হয়েছে। যার ফলে আগামিদিনে ধান (চাল), ডাল, আলু, পিঁয়াজ, তৈলবীজ আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকায় থাকছে না।
থাকছে না তো কী হয়েছে?
তার ফলে এই পণ্যগুলির উৎপাদন মজুতদারি রপ্তানি এবং বিক্রি-- কোনও ক্ষেত্রেই আর সেখানকার রাজার কোনও নিয়ন্ত্রণ রইল না। মানে দাঁড়াল, ওখানকার ব্যবসায়ীরা এই তালিকাভুক্ত যে কোনও খাদ্যপণ্য কিনে দেদার মজুত করতে পারবে। বড় বড় সব সংস্থাও এসব অনায়াসে যত খুশি কিনে ফেলবে।
আমার মনে হচ্ছে নারদ, বিষয়টি ভালই হবে। তাতে চাষিদের অন্তত না খেয়ে মরতে হবে না। ওরা তো ওদের উৎপাদিত জিনিসের ন্যায্য দামও পাবে।
না, প্রভু, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ওখানেও এক পক্ষ বলছে, এতে চাষিদের উন্নতি হবে। অন্য পক্ষ জোর দিয়ে বলছে, কিচ্ছু উন্নতি হবে না। চাষিরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকবে। মাঝখান থেকে বড় বড় লগ্নিকারীরা ফুলে-ফেঁপে উঠবে। শুধু তাই নয়, এই নিয়ম লাগু হলে ওখানে যখন-তখন এই সব পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কটও তৈরি হবে। লাগামছাড়া হবে খাদ্যপণ্যের দাম।
বাপরে! তুমি তো অনেক খোঁজ নিয়েছ দেখছি। কিন্তু নারদ, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, ওরা চাল-ডাল-আলু নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছে কেন? ওরা ফল-টল খেতে পারে না, বা সোমরস?
প্রভু, এ তো আপনি সেই মারি আঁতোয়ানেতের মতো কথা বললেন। ওঁর দেশে একবার দুর্ভিক্ষে মানুষ রুটি খেতে পাচ্ছিলেন না। তা শুনে রানি বলেছিলেন, রুটি নেই তো কী হয়েছে, ওরা কেক খাক না! মুশকিল হল, কেকের চেয়ে রুটির দাম কম। কেউ যদি রুটি না কিনতে পারে, তবে সে কেক কিনবে কোথা থেকে! আপনি যা বললেন, তা ভাবনা হিসেবে অতি উৎকৃষ্ট। কিন্তু বাজারে সঙ্কট এলে তো সাধারণ মানুষের হাতে টাকাই থাকবে না, যা দিয়ে ওরা জিনিসপত্র কেনাবেচা করে। আর টাকা না থাকলে ফল কিনবে কী করে? সোমরস প্রভু ওখানে বিচিত্র ধরনের পাওয়া যায় শুনেছি। তবে সেখানেও গরিবের খুব একটা সুবিধা নেই। ভাল জিনিস প্রায়শই ওরা পায় না। নিকৃষ্ট জিনিস খেতে দিয়ে গোল পাকায়।
আচ্ছা। থাক, থাক! ও কথা নয় পরে হবে। কিন্তু এখন কী কর্তব্য?
প্রভু, এ বারে তো বহু যুগ বাদে মর্ত্যে গেলাম। সেখানে দেখি সবই বড় পিলে চমকানিয়া। কিছুই তো ভাল বুঝতে পারছিলাম না। নানান জায়গায় দাঁড়ালাম। বেশ কিছু জটলায় এই বিল নিয়ে মানুষজন যে সব কথা বলছে তা শুনলাম।
কী কী শুনলে বলো!
বলব কী প্রভু, সেখানে একদল লোক চিৎকার করে চলেছে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিল নিয়ে এ ভাবে কাঁদাকাটার কী আছে! দেশে কি সত্যিই চাল-ডাল-আলু-পিঁয়াজ-তেল আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্য? এখন তো ঘরে-ঘরে স্মার্টফোন, পাওয়ারব্যাঙ্ক, পেন ড্রাইভ, রাউটার, ট্যাব, পামটপ, ব্লুটুথ স্পিকার নিয়ে চর্চা। মেয়ে বাবার কাছ থেকে মোবাইল না পেয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলছে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অত ভাববার কী আছে! এখন ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেটের যুগ। তার মোহতেই গোটা ভুবন মেতে। ডাল-আলু-পিঁয়াজ নিয়ে খামোখা ভাবতে যাবে, এত ওঁচা হাড়হাভাতে কেউ আছে নাকি!
বলো কী, নারদ! তোমার অবশ্য অনেক কথাই আমি স্পষ্ট বুঝলুম না। বিশেষ করে ওই পামগাছের মাথা বা নীল দাঁত বিষয়ে যা বললে। তবে, এটুকু বুঝছি, মর্ত্য জায়গাটার অনেক বদল এসেছে।
হ্যাঁ, প্রভু! বদল বলে বদল! ওই জটলাতেই আলোচনা শুনছিলাম, আগে নাকি ছেলেরা 'কৃষিজীবী','মৎস্যজীবী', 'শ্রমজীবী' এসব শব্দের চর্চা করত। আর এখন তারা শুধু 'সিক্সটিন জিবি', 'থার্টিটু জিবি' এসব কপচায়। সব চেয়ে আশ্চর্যের প্রভু, স্মৃতিশক্তি আর তাদের মাথায় থাকে না, তা এখন ওই স্মার্টফোনে ঢুকে পড়েছে। যত স্মৃতি সব সেখানে। স্মৃতির আবার পরিমাণও আছে। মর্ত্যবাসী প্রভু নিছক ডাল-ভাতের জাত আর নেই। এরা অনেক এগিয়ে গিয়েছে।
কী রকম, ভক্তপ্রবর নারদ?
সেখানে 'ইনস্টা' নামের একটা গ্রাম আছে। কারা সব দিনরাত 'এফবি' বলে কী একটা ব্যবহার করে। কথা খুব কম বলে। ওদের লিপি আছে তবুও ওরা চিহ্ন বা ছবি দিয়ে কথা বলে, মনের ভাব প্রকাশ করে। সারাদিন সেখানে 'টুইট', মানে, পাখিদের কিচিরমিচির চলে। তবে আমাদের চেনা কাকলিকূজনের মতো ঠিক নয়। ওখানে মানুষজনের চেহারা আগে রোগা-ভোগা ছিল। এখন প্রভু খেয়েদেয়ে তারা এত মোটা হয় যে, পয়সা খরচ করে আবার মেদ ঝরাতে কোথায় একটা যায়। তা ছাড়া ওরা চাল-ডালই-বা খায় কোথায়! শুনে এলাম, ওটস, ফ্লেক্স, হেল্থড্রিঙ্ক, রোল, বার্গার, পিৎজা নামের কীসব দিনরাত খায়। ফলে ডাল-পিঁয়াজ মিলল কি মিলল না, তাতে ওদের অত মাথা ব্যথা নেই।
তা হলে এ নিয়ে ওখানে এত গোলমাল কেন?
হ্যাঁ, প্রভু। গোলামালের খবরটা খাঁটি। শুনছিলাম এক পক্ষ নাকি কোন এক সুকুমার রায় না কে, তার একটি ছড়া খুঁজে বের করেছে। ছড়ায় আছে, 'লেখা আছে কাগজে/আলু খেলে মগজে/ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না!' আর ওই কবিই নাকি তাঁর কবিতায় মানুষের খাদ্য হিসেবে নানা কিছুর উল্লেখ করে গিয়েছেন।
কী কী খাবার?
ভিজে কাঠ, আমসত্ত্ব ভাজা, মোমবাতি, দেশলাই, পাউরুটি এবং ঝোলাগুড়!
তাই নাকি! বড় অদ্ভুত তো! খুব ইন্টারেস্টিং লোক ছিলেন ওই সুকুমার। তিনি নিশ্চয়ই জানতেন একদিন এইরকম একটি বিল পাশ হবে। কিন্তু ওই গোলমালের ব্যাপারটা?
হ্যাঁ, প্রভু, ওসব নাকি হদ্দ রাজনীতি করা হচ্ছে। সংসদে ওখানকার প্রভু যা করেছে, তা নাকি আদতে ভালই। কিন্তু একদল রাজনৈতিক লোকজন সরল-সাদাসিধে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিষয়টা নিয়ে হল্লা করছে। হে প্রভু, আমারও তো বিষয়টা ভালই মনে হয়। বিষয়টা আসলে আধুনিকতা। এই দেখুন না, স্মার্টফোন বলে যেটার উল্লেখ করলাম, সেটাও তো ওই আধুনিকতারই দান। আজ যদি ওটা আমাদের কাছে থাকত তবে আর ঢেঁকি চেপে এত হন্তদন্ত হয়ে আমাকে এখানে আসতে হত না। আমি স্রেফ একটা ফোন করে সবটা আপনাকে বলে দিতে পারতাম। শুধু একটা নাম্বার থাকত আমাদের।
নাম্বার? শুনেছি সে তো ওই মর্ত্যের কারাগারে যারা বন্দি থাকে তাদের থাকে। আমারও নাম্বার থাকবে! তখন আর আমাদের কোনও কৌলীন্য থাকবে নারদ?
বলেন কি শ্রীবিষ্ণু! নাম্বার শুধু কয়েদিদের নয়, নাম্বার এখন মর্ত্য জুড়ে। ইপিক নাম্বার, আধার নাম্বার, অমুক নাম্বার-তমুক নাম্বার! শুধু নাম্বারের ওপর নির্ভর করেই সেখানে জগৎসংসার সব চলছে প্রভু। সেখানে নাম্বার থাকাটাই কৌলীন্য।
না, নারদ। থাক। থাক। আর শুনতে চাই না। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। তবে একটা কথা আমি বলতে চাই। তুমি বিষয়টা যেভাবে বললে, তাতে যেন মনে হল, ওই অত্যাবশ্যকীয় পণ্য না কীসের আইন করে সেখানকার রাজা এমন কিছুই মন্দ করেনি। কিন্তু আমার মনে হয়, এক শ্রেণির খাঁটি গরিব সেখানে নিশ্চয়ই কোথাও আছে। না হলে প্রতিবাদের এত জোর হত না, যার শব্দ তোমারও কানে এসে পৌঁছত, আর তুমি মর্ত্যে দৌড়তে!
তা হলে প্রভু?
যে কোনও সময়ে আমাদের এখানেও উত্তেজিত ওই সব মানবসন্তান চলে আসতে পারে। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, ওখানকার ভানু ব্যানার্জী নামের একটা রোগা লম্বা লোক যমালয়ে এসে কী সঙ্কটেই না আমাদের ফেলেছিল একবার। আমাদের এখানকার সব নিয়মকানুন একেবারে চৌপাট করে দিয়েছিল। তার চেয়ে বলি কী, তুমি আবার মর্ত্যে যাও। ভাল করে খোঁজ নিয়ে দ্যাখো জনগণ কী চাইছে। সেই মতো আমরা এখান থেকে কী ব্যবস্থা নিতে পারি, তখন ভাবব। ব্রহ্মা এবং শিবের সঙ্গেও মিটিংয়ে বসব। ও হ্যাঁ! এ বার গিয়ে লক্ষ্মীর অভিমানের বিষয়টারও একটু খোঁজ কোরো তো নারদ। সন্ধেবেলাগুলো বাড়ির মেয়ে-বউরা কী করে জেনে এসো! চাল-ডাল নিয়ে ওদেরও মতামতটা জেনে এসো। শুনেছি, ওরা ওখানে এখনও ঘরের কাজকর্মেই বেশি যুক্ত থাকে।
যথা আজ্ঞা প্রভু!
আরও পড়ুন: মজুতের কোনও সীমা রইল না আলু-পেঁয়াজের মতো পণ্য, সংসদে পাস Essential Commodities Bill