Saraswati Puja: শুধু বাংলা নয়, দেবী সরস্বতীর পুজো হয় বিশ্বজুড়ে...

Thu, 30 Jan 2025-1:13 pm,
Saraswati Devi

জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: 'ওঁ জয়জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে, বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে...' -ভক্তি ভরে হাতে ফুল নিয়ে শ্বেত শাড়ি পরিহিতা দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিতে দিতে এক মনে তাকিয়ে থাকি মা সরস্বতীর দিকে, জানেন কি তাঁর পুজো শুধু ভারতে নয়, হয় সারা এশিয়া জুড়ে। হুগলী জেলার একটি জায়গায় সারা বছর পুজো পান মা, সেটা কোথায় জানেন! দেবীর তান্ত্রিক সরস্বতীর রূপ কি সেটিও থাকবে আজকের আলোচনায়। 

Saraswati statue of Harappan civilization

দেবী সরস্বতীকে যে হরপ্পা সভ্যতার সময়ও পুজো করা হত তা প্রমাণ করেন ডি ডি কোসাম্বি। তিনি আদিমতম দেবী হিসাবে পরিচিত। ঋগ্বেদে তা প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্তত পাঁচ হাজার বছর ধরে পুজিত হচ্ছেন মা সরস্বতী দেবী। আদিযুগে সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী বা কন্যা কিছুই ছিলেন না, কারণ হরপ্পা যুগে, বৈদিক যুগে, বৌদ্ধ যুগে, এমনকি গঙ্গারিডাই থেকে মৌর্য যুগে কোথাও ব্রহ্মা বলে কোনও দেবতাই ছিলেন না। সরস্বতী এই প্রত্যেক যুগেই পূজ্য ছিলেন। 

South Mukambika Temple North Paravur

কেরালার উত্তর পারাভুরে অবস্থিত দক্ষিণা মুকাম্বিকা মন্দির হল একটি সরস্বতী মন্দির; যেখানে গণপতি, মহাবিষ্ণু, কার্তিকেয়, যক্ষী, হনুমান এবং বীরভদ্রনের মতো উপ-দেবতা রয়েছে। গর্ভগৃহ, একটি পদ্ম পুল দ্বারা বেষ্টিত, যক্ষীকে উৎসর্গ করা একটি মন্দির রয়েছে। 

রাজহংসের উপর অবস্থান করেন সবুজবর্ণা দেবী মাতঙ্গী, তিনি আর কেউ নন স্বয়ং দেবী সরস্বতীর তান্ত্রিক রূপ। হাতে বীণা, খড়্গ, পাশ বা নরকপালহস্তা দেবী মন্ত্রিণী কখনো চতুর্ভুজা, কখনো ষড়ভুজা, কখনোবা অষ্টভুজা। মাতঙ্গ ভৈরব পত্নী দেবী মাতঙ্গীই পরমেশ্বরী ত্রিপুরা সুন্দরীর দেবী। আবার তিনি রক্তাম্বরাও। দেবী জ্ঞান দায়িনী শান্তরূপা। তার পূজা হয় অক্ষয়তৃতীয়ায়। মাতঙ্গী দেবীর সঙ্গে দেখা যায় টিয়া পাখিকে। 

এবার আসা যাক হুগলীর বাঁশবেড়িয়া নামক স্থানে হংসেশ্বরী কালীমন্দির পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত কালী মন্দির, এটি নীল সরস্বতী মন্দির নামেও পরিচিত। এখানে দেবী পুজো পান নিত্যদিন তবে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে দেবী পুজিতা হন নীল সরস্বতী রূপেই। এই মন্দির রাজা নৃসিংহদেব ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বিধবা পত্নী রাণী শঙ্করী এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এই মন্দিরে আছে তেরোটি রত্ন ও মিনার প্রতিটি প্রস্ফুটিত পদ্মের ন্যায় নির্মিত। মন্দিরের গর্ভগৃহের উচ্চতা প্রায় ৭০ ফুট। গোলাকার বেদীর ওপর পাথরে নির্মিত শায়িত শিব মূর্তির নাভি থেকে উদ্গত প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর দেবী হংসেশ্বরীর মূর্তি নির্মিত হয়েছে। দেবীমূর্তি নীলবর্ণা, ত্রিনয়নী, চতুর্ভূজা, খড়্গধারিণী ও নরমুণ্ডধারিণী। এই মন্দিরের একদম পাশেই টেরাকোটা নির্মিত অনন্ত বাসুদেবের মন্দির। দুটি মন্দিরই মাতা হংসেশ্বরী দেবীর মন্দিরের সঙ্গে সঙ্গেই নিত্য পূজাপাঠ হয়। ভক্তজন প্রতিদিন মাতাকে ভোগ নিবেদন করতে পারেন এই মন্দিরে।এখানে একটা কথা না বললেই নয় দেবী তারাই হলেন নীল সরস্বতী।

থাইল্যান্ডে সরস্বতীর বাহন হাঁসের বদলে ময়ূর। এর পাশাপাশি আরও এক বিচিত্রের দর্শন মেলে থাইল্যান্ডে। তা হল, দেবীর গলায় মালার বদলে থাকে অ্যামুলেট। কথ্যভাষায় এটাকে ওই লাকি লকেটও বলা চলে। 

কম্বোডিয়ার মতো ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের ছবিও অনেকটাই একইরকম। ইন্দোনেশিয়াতেও দেবীর বাহন রাজহংস। তবে থাইল্যান্ডে সরস্বতীর বাহন হাঁসের বদলে ময়ূর। 

চিন, জাপান কিংবা তিব্বতে দেবী সরস্বতী হংসহীনা কিন্তু কম্বোডিয়ায় গেলে দেখা যায় তাঁর বাহন রাজহংস। চিন ও জাপানে সরস্বতীর সঙ্গে দেখা যায় ড্রাগনকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ড্রাগন মূলত নাগ বা সর্প। যেমনটা দেখতে অভ্যস্ত আমরা সকলেই প্রায় অভস্ত। 

মায়ানমারের বর্মায় তাঁর নাম 'থুরাথাডি'। বিদ্যার দেবী হিসাবেই আরাধনা হয় থুরাথাডির। তবে মায়ানমারের পুরাণে তিনি রয়েছেন গ্রান্থাগারিক হিসাবে। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথির সংরক্ষক এবং চর্চার দেবী হলেন থুরাথাডি। তাঁর হাতে বীণার বদলে থাকে বই। ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও, চিন বা জাপানে সরস্বতী বন্দনা শুরু হওয়ার অনেক পরে মায়ানমারে পাড়ি দিয়েছিলেন দেবী। 

জাপানে 'বিয়ানসাইতিয়ান' হয়ে ওঠেন 'বেনজাইতেন'। আমাদের দেশের সরস্বতীর মতো আজও মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে জাপানের বিভিন্ন স্কুল এবং বৌদ্ধ মিশনারিতে তাঁর আরাধনা হয় নিয়ম করেই। সংস্কৃতি এবং ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী তাঁর রূপেও এসেছে বদলের ছাপ। শাড়ির বদলে তাঁকে সেখানে দেখা যায় ভারি পশমের পোশাক পরিহিতা। তিনি সেখানে হাতে বীণার বদলে নিয়েছেন ম্যান্ডোলিনজাতীয় চারটি তার বিশিষ্ট জাপানি বাদ্যযন্ত্র, বিওয়া। ষষ্ঠ শতাব্দীর জাপানি পুঁথিতে পাওয়া যায় দেবী বেনজাইতেনের কথা। বেনজাইতেন শুধু সঙ্গীত কিংবা বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী নন, তিনি একাধারে শান্তি এবং জলপ্রবাহের দেবীও। গোটা জাপানজুড়ে বিভিন্ন জলাশয়ের ধারে পূজিতা হন তিনি। সর্প এবং ড্রাগনযোগও রয়েছে তাঁর সঙ্গে। স্কন্দপুরাণে দেবী সরস্বতী পাতালনিবাসী। ব্রহ্মার অনুরোধেই দেবী পাতাললোক থেকে উঠে এসেছিলেন মর্তে। জাপানিদের বিশ্বাস, প্রার্থনা করলে প্রণয়ের যোগও করিয়ে দেন বেনজাইতেন। কাজেই বহু মানুষই মনের গোপন ইচ্ছে নিয়ে দ্বারস্থ হন দেবীর কাছে। দেবীর মন্দিরের আশেপাশে সুতো বেঁধে ঝুলিয়ে আসেন ছোট্ট চিরকুট। সে-চিরকুটের ভেতরে লেখা থাকে প্রণয়-প্রার্থনা। 

ভারতের প্রতিবেশী দেশ চিনেও পুজিতা হন মা 'বিয়ানসাইতিয়ান' রূপে। চতুর্ভূজা দেবী দুই হাতে বীণাবাদনরতা, অন্য দু'হাতে রয়েছে পদ্ম এবং পুস্তক। তাই কোথাও কোথাও আবার দক্ষিণ হস্তে পুস্তকের বদলে দেখা যায় হাতপাখাও। বৌদ্ধতন্ত্র অনুসারে তিনি হলেন 'প্রজ্ঞাপারমিতা'। 'সুবর্ণপ্রভাসুত্র'- বৌদ্ধগ্রন্থটিতে রয়েছে দেবী 'বিয়ানসাইতিয়ান'-এর আরাধনার পদ্ধতি। চৈনিক পৌরাণিক কাহিনিতে অনুসারে জানা যায়, সমগ্র চিন সাম্রাজের দায়িত্বে ছিলেন প্রতাপশালী চার চৈনিক সম্রাট। কীভাবে সঠিক নিয়মে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় সেই শিক্ষাই দিতেন তাঁদের বিয়ানসাইতিয়ান। দেবী সরস্বতী বাকদেবী হলেও, তিনিই সেখানে দণ্ডনীতির স্রষ্টা। 

তিব্বতে মার পরিচয় তিনি 'ইয়েং চেন মা'। তিব্বত যে বহুযুগ আগে থেকেই বৌদ্ধধর্মের অন্যতম পীঠ, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বজ্রযান তন্ত্র শাস্ত্রানুসারে সেখানেও তিনি শ্বেতবস্ত্রা। মহাযানতন্ত্রে দেবী সরস্বতীর রয়েছে তিনটি ভিন্ন রূপ- কোথাও তিনি দ্বিভূজা, কোথাওবা তিনি চতুর্ভূজা, আবার কোথাও তিনি ষড়ভূজা।

হিন্দু ধর্ম শুধু আমাদের দেশে সীমাবদ্ধ থাকলেও বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে আছে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে। বৌদ্ধ ধর্মে পুজিত হন মা। দেবী শুধু ভারতে নন, তিনি পুজিত হন চিন, মায়ানমার, তিব্বত, জাপান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এমনকি ইন্দোনেশিয়াতেও। তবে স্থান পার্থক্যে তাঁর পরিচয় ভিন্ন সকল জায়গায়।

ZEENEWS TRENDING STORIES

By continuing to use the site, you agree to the use of cookies. You can find out more by Tapping this link