মহাকবি কালিদাস: `পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে লিখেছিলে মেঘদূত`
যুগ যুগ ধরে এই আষাঢ়ের প্রথম দিনটি মহাকবি কালিদাসের জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে কোনও এক সময় তাঁর জন্ম বলে মনে করা হয়। ফলত জন্মদিন নিয়ে অনুমান ছাড়া গত্যন্তর নেই।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে ওই 'তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি যে মহত্' কথাটি যেন উল্টে গিয়েছে। বরং স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টিকে নিয়েই বেশি চর্চা, বেশি আবেগ, বেশি উদযাপন। আষাঢ়ের প্রথম দিনটির সূত্রে কালিদাসের 'মেঘদূতম' খণ্ডকাব্য এক অনির্বচনীয় আবেশ তৈরি করে রেখেছে যুগ যুগ ধরেই।
বর্ষার এই কাব্য, বিরহের এই কাব্য বাঙালিকে চিরকালের জন্য কিনে নেয়েছে। এমন কোনও বাঙালি কবি নেই যিনি তাঁর সৃষ্টির কোনও না কোনও পর্বে কালিদাসের মেঘদূতমের কাছে যাননি।
মেঘদূতমের দ্বিতীয় শ্লোকেই এই প্রখ্যাত পঙক্তিটি আছে-- 'আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং'। আর প্রথম শ্লোক? আহা সে-ও বড় মনকেমনিয়া। সেখানে রামগিরি পর্বতে নির্জনবাসের শাস্তিপ্রাপ্ত শাপগ্রস্ত যক্ষের কথা দিয়ে কাহিনিমুখ খুলে যাচ্ছে। কালিদাস লিখছেন--'কশ্চিত্ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ/ শাপেনাস্তংগমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেণ ভর্তুঃ।' শব্দের, ধ্বনির, ছন্দের, সঙ্গীতের এক অলৌকিক মেলবন্ধন, যা প্রথম থেকেই দূর পাহাড়ের নির্জনতার বেদনার মধ্যে নিক্ষেপ করে পাঠক-হৃদয়কে।
যক্ষ দীর্ঘদিন প্রিয়াবিচ্ছিন্ন। বিরহে আনত তাঁর দেহমনপ্রাণ। বর্ষার প্রথম দিনে পর্বতের শীর্ষে মেঘভার দেখে তার মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
এক খণ্ড মেঘকে সে দূত সাব্যস্ত করেছে। সেই মেঘরূপ দূতকেই সে তার প্রিয়ার কাছে পাঠাচ্ছে। কী অসম্ভব মর্মস্পর্শী সেই আতপ্ত হৃদয়ের পোড়ানি, কী অব্যর্থ সেই দিকনির্দেশ, কী বিধুর সেই বার্তা।
আমাদের গ্রামবাংলার সাধারণ প্রকৃতিতে পাহাড়ের সেই উদাত্ত প্রক্ষেপ আর কই? কিন্তু তাতেও এই ভূগোলে এ কাব্যের রস কম পড়ে না। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে এক গভীর নিবিড় সবুজ স্নিগ্ধ গ্রামের মাথায় ঘন কালো মেঘের ভার। এ দৃশ্য মনকে প্রথম থেকেই বিচলিত করে দেয়। কালিদাস যেন আমাদের বাংলার ঘরের কবি প্রতিপন্ন হন।
মেঘকে দেওয়া অপূর্ব দিকনির্দেশে কালিদাস তাকে এক জায়গায় এমনও বলছেন-- যদিও তোমার পথ বক্র হবে তথাপি উজ্জয়িনীর সৌধাবলীর উপরিতলের পরিচয় নিতে বিমুখ হয়ো না। সেখানে পৌরঙ্গনাদের বিদ্যুদ্দামস্ফুরণে চকিত চঞ্চল কটাক্ষযুক্ত নয়ন যদি উপভোগ না করো, তবে তুমি বঞ্চিত হবে।