নীরেন্দ্রনাথের মৃত্যু মহীরুহ পতনের বিহ্বলতা লেখক-শিল্পী মহলে

Tue, 25 Dec 2018-3:57 pm,

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়- কী বলব বুঝতে পারছি না, নীরেনদার চলে যাওয়া মানে আমার উপর থেকে বটগাছের ছায়া সরে গেল।বড় ভাইয়ের মতো দেখতাম। তিনিও আমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই ভালোবাসতেন। অনেকদিনের সম্পর্ক। আত্মীয়র মতোই হয়ে গিয়েছিলেন। তবে বয়স হয়েছিল, সেটাও তো অস্বীকার করা যাবে না। প্রকৃতির নিয়মেই সবাইকে চলে যেতে হয়। তেব এই চলে যাওয়াতে থাকা ও না থাকার মধ্যে একটা বড় পার্থক্য তৈরি হয়। বড় শুন্যতার সৃষ্টি হয়। মস্ত বড় কবি ছিলেন। আমরা অনেক কবিরাই ছন্দ, শব্দ শিখেছি। অভিভাবকের মতোই ছিলেন আমাদের কাছে।পুরস্কার অনেক পেয়েছেন, তবে সেটা বড় কথা নয়, বড়কথা তিনি হৃদয়ের খুব কাছাকাছি ছিলেন। এই ক্ষতিটা কীভাবে সামলাবো জানি না। এমনও হয়েছে ঘরে গিয়ে বন্ধ করে দিয়ে বলতে একটা গল্প লেখ তারপর মুক্তি পাবে, তুই তো কারি করতেন। এই রকম সম্পর্ক ছিল। নীরেনদার চলে যাওয়া আত্মীয় বিয়োগের মতোই।

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়- একটা টেবিলের যদি একটা পায়া ভেঙে গেলে টেবিলটা যেমন কাত হয়ে যায়, আমার অবস্থাটাও তেমনই হল। নীরেনদাই আমাকে ছোটদের লেখক হিসাবে তৈরি করেছিলেন। তিনি আমার কাছে চিরদিনের অভিভাবক। তিনিই আমাকে জোর করে লেখাতেন। আমি ভালো লিখলে ওনার চোখ আনন্দে চিকচিক করত। নীরেনদার চলে যাওয়া মানে আমার মনে হচ্ছে আমি আমার পরিবারেরই একজনকে হারালাম। তিনি সমস্ত লেখকদের থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভালো লেখা বের করে নিতেন। তিনি বলতেন, ঘুরে ঘুরে বেড়ালে কি আর লেখা হয়, কাগজ কলম নিয়ে বসতে হয়। নীরেনদার বাড়িতে লেখার জায়গায় খন আলো লাগনো হল। তিনি আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখালেন। তাঁর সেই আনন্দ যেন ছেলেমানুষের মতোই। তাঁর পারিবারিক অনুষ্ঠানেও আমাকে ডাকতেন। আমি অসুস্থ হলে ওষুধ বলে দিতেন। আমাকে অলিভ ওয়েল খেতে বলতেন। বলতেন অলিভ ওয়েল খেলে নাকি দুরারোগ্য ব্যাধি সেরে যাবে। তিনি শুধু কবি নন, মানুষ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও অনেক বড়। আমি তাঁকে অনেক প্রণাম জানাই। পরে আবার জন্মালে যেন নীরেনদার সঙ্গেই জানাই।

শ্রীজাত-  আমি তাঁর অনুগামী পাঠক একজন। সত্যি কথা বলতে কী নীরেনদার লেখা পড়েই আমার লেখালিখি করতে আসা। আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার এক বন্ধু আমায় একটি কবিতার বই দিয়েছিল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে। সেই বইই আমার প্রথম পাঠক্রমের বাইকে কোনও কবিতার বই পড়া। সেই বই পড়ে অবাক হয়েছি। তারপর কিনে তাঁর বহু কবিতার বই পড়েছি। আজ নীরেনদার চলে যাওয়ার খবরে পুরনো স্মৃতিগুলিই ফিরে ফিরে আসছে। কবিতার প্রতি আকর্ষণ, প্রেম আমার মধ্যে তার বীজ বপন করেছিল তাঁর বই। আমি যখন আনন্দ পুরস্কার পাই, তখন তিনি সংশাপত্র লিখে দিয়েছিলেন। সকলের সামনে পড়ে শুনিয়েছিলেন। আমার বিয়েতে এসে তাঁর একটা লেখা বই আমায় দিয়েছিলেন।

 

শঙ্কর- এখন এরকম লোক আর কজন আছে বলুন। উনি আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ছিলেন এটা আমাদের কাছে বড় প্রাপ্তি। তিনি শুধু কবিই নন, মস্ত বড় সম্পাদক ছিল। তিনি এমন দিনে চলে গেলেন। বড়দিনে কলকাতার যীশু ছিলেন। আর তিনি যীশুর জন্মদিনেই তিনি চলে গেলেন। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

জয় গোস্বামী- বাংলা কবিতার জগতে প্রধান কবির জীবনাবসান ঘটল, অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি যে কবিতা লিখেছেন, তা আমাদের কাছে চিরকাল থাকবে। ৯০ বছর পার করার পরও তিনি কবিতা লিখে গেছেন। মাত্র কয়েকদিন আগেই তাঁর কবিতার ষষ্ঠ সমগ্র বেরিয়েছে। তিনি তরুণ কবিদের উৎসাহ দিতেন, ফোন করে বলতেন। তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে ভাবতেন। তিনি আর আমি দুজনে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি ১০ বছরেরও বেশি। তাঁর কাছ থেকে যথেষ্ঠ উৎসাহ পেয়েছি। এইরকম মানুষ আজকের দিতে সত্যিই খুঁজে পাওয়া কঠিন।  তিনি আমার কবিতা পড়ে ফোন করে উৎসাহ দিতেন। এটা আমার জীবনে একটা বড় প্রাপ্তি। 

 

বুদ্ধদেব গুহ- নীরেনদা আমাকে দিয়ে অনেক লেখা লিখিয়ে নিয়েছেন। তিনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন। তিনি জঙ্গল ভালোবাসতেন। আমার সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরতে গিয়েছিলেন। তিনি শুধু কবি হিসাবেই নয়, সম্পাদক হিসাবেও অসাধারণ ছিলেন। প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। বয়স কোনওদিন তাঁকে স্পর্শ করেতে পারেননি। গতবছর বইমেলায় দেখা হয়েছিল, তখন আমার পাশে বসে, আমার পায়ে হাত বোলাতে বোলাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন 'কী রে কেমন আছিস'। নীরেনদার চলে যাওয়াটা আমার কাছে বড় ক্ষতি। আমাকে ভালোবেসে 'হনুমান' বলে ডাকতেন।

নবনীতা দেবসেন- নীরেনদা আমার বাবার মতো ছিল। আমার বাবা-মায়ের মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমি তখন কিশোরী। আমার প্রথম লেখা যখন 'দেশ' পত্রিকায় বের হল, তখন নীরেনদার সই করা চিঠি এসেছিল। আমার অনেক দুঃখের মুহূর্তে আমার পাশে থেকেছেন। আমাকে বলেছেন 'সত্যেরে লও সহজে'। ওনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। গত দুমাস আর আমার সঙ্গে ওনার সঙ্গে দেখা হয়নি। ওনাকে দেখতে পেলাম না। কিছুদিন আগেও লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছেন। এই বয়সেও এত সুন্দর লিখতেন। আমার খুব কাছের একজন চলে গেলেন।

মন্দাক্রান্ত সেন- অপূরণীয় ক্ষতি। অভিবাবক চলে গেলেন। তিনি দেহ ছেড়ে চলে গেলেও তিনি চিরকাল থেকে যাবেন। তাঁর চলে যাওয়া মানি না, থেকে যাওয়াটাই সত্যি। আমি ছোট থেকেই তাঁর লেখা পড়েই বড় হয়েছি। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল আমার ভীষণ পছন্দের একটা লেখা। তাঁর সঙ্গে যখন আলাপ হল আমি অনেক স্নেহ পেয়েছি।

সুবোধ সরকার- ''আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হচ্ছে আমি দ্বিতীয়বার আমার বাবাকে হারালাম। বিষ্ণুপুর থেকে যখন কলকাতায় এসেছিলাম তখন আমার কোনও আশ্রয় ছিল না কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। এত বড় একজন মনের মানুষ, এত বড় কবি, একটা বিরাট যুগ শেষ হয়ে গেল। প্রায় ৭০ বছর ধরে বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা কবিতাকে তিনি চাবুকের মতো প্রতিবাদের জন্য ব্যবহার করেছেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'কলকাতার যীশু', আমরা তাঁকে কলকাতার যীশু বলেই ডাকতাম, সেই কলকাতার যীশু চলে গেলেন ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে। এটা একটা অদ্ভুত সমাপাতন। ''

ZEENEWS TRENDING STORIES

By continuing to use the site, you agree to the use of cookies. You can find out more by Tapping this link