#উৎসব: জালে উঠে এলেন কষ্টিপাথরের `রাজবল্লভী`, চুরি করতে পারল না ডাকাতদল
নদিয়া জেলার করিমপুর-২ ব্লকের থানারপাড়া থানার অধীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ দোগাছি গ্রাম। এই গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে গোটা অঞ্চল সমস্ত ধর্মের মানুষ একসঙ্গে পুজো, মেলা, নামাজ পারস্পরিক মেলবন্ধনে ধর্মের সার্থকতা সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ মেলবন্ধনের সাক্ষ্য রয়েছে অতীত ও বর্তমানের অসংখ্য বয়ে চলা ঘটনা পরম্পরায়। করিমপুর থেকে ১০ কিমি দূরে দোগাছি গ্রামের চারশো বছর অতিক্রান্ত মহিমান্বিত শ্রী রাজবল্লভী মন্দির রয়েছে কষ্টি পাথরের দুর্গামূর্তি।
সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি রাজবল্লভী নামে এক জেলের জালে দোগাছির বিল থেকে ওঠে পাথরের তৈরি এক দশভুজা মূর্তি। ওঠে এক বিষ্ণুমূর্তিও। ওই মূর্তি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নও পান ওই জেলে। সেই সময় অবিভক্ত বাংলার এই অঞ্চলের জমিদারিত্ব নাটোরের রানি ভবানীর অধীনে। তিনি খবর পেয়ে দোগাছি গ্রামে পোড়ামাটির কারুকার্য করা সুন্দর দোচালা এক মন্দির তৈরি করে মূর্তি দুটি প্রতিষ্ঠা করে দেন। নিত্য সেবার জন্য দেবোত্তর সম্পত্তি নির্ধারিত হয় রানির দায়িত্বেই। রাজবল্লভ নামে জেলে দুর্গামূর্তিটি বিল থেকে উদ্ধার করেন বলে এখানে দুর্গা মায়ের নাম হয়-- 'রাজবল্লভী'।
বাংলা ১৩০৪ সনে ভূমিকম্পে প্রথম মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যায়। মূল মন্দির ধ্বংস হওয়ার পরে পুরনো মন্দিরের ভিত্তিভূমির উপর আর একটি মন্দির তৈরি করা হয়। সেটিও ভেঙে যায় বন্যার সময়। তৃতীয়বার একটি পঞ্চরত্ন মন্দির তৈরি হয়। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত তিনফুট লম্বা ও দেড় ফুট দশভুজা মূর্তিটি দুষ্প্রাপ্য কালো কষ্টিপাথরের। দশ হাতে অস্ত্র। মাথায় মুকুট, বিভিন্ন অঙ্গ অলঙ্কারে সজ্জিত। মহিষাসুর, সিংহ ও মহিষ রয়েছে। দু'পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী। এই মূর্তিগুলির নীচে গণেশ ও কার্তিক। সিংহটি ঘোড়ার মতো। পাশেই রয়েছে পদ্মের উপর দণ্ডায়মাণ ত্রিবিক্রম বিষ্ণুমূর্তি।
১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর এক ঝড়বৃষ্টির রাতে দুর্গামূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। মূর্তি উদ্ধারে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এলাকাবাসী তৎপর হয়ে ওঠেন। সেই সময় বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। তাই বাংলাদেশে মূর্তিটি যাতে পাচার না হয়ে যায় তার জন্য দিল্লির মন্ত্রীমহলে ও রাষ্ট্রপতিকে জানানো হয়েছিল।
বেশ কয়েকদিন পরে গ্রামের প্রান্তে এক বাঁশঝাড় থেকে মূর্তিটি উদ্ধার হয়। লোকমুখে শোনা যায়, ডাকাতের দল মূর্তিটি চুরি করেও কোনও এক কারণে সেটি নিয়ে যেতে পারে না, ফেলে পালিয়ে যায়।
প্রায় ২০০ বছর আগে এক সদানন্দ সাধু এই মন্দির আঙিনায় এক পবিত্র কুয়ো খনন করেন। এখনও জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ তুচ্ছ করে এই কুয়োর পবিত্র জল ভক্তিভরে গ্রহণ করেন সকলে। বংশানুক্রমিকভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ মন্দিরের দায়িত্ব নেয়। এই পুজো তান্ত্রিক মতে হয়। নিত্যসেবা ছাড়াও শারদীয়ায় বাৎসরিক পুজো হয়। শ্রীপঞ্চমীতে মেলা বসে। বৈশাখ মাসের প্রতি মঙ্গলবারে বিশেষ পুজো হয়। শেষ মঙ্গলবারে মেলা বসে। চৈত্রে গাজনের মেলা হয়। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, রাজবল্লভী দুর্গা মা খুবই জাগ্রত।