Uttam Kumar: সুচিত্রা না থাকলে উত্তম হতো না, বলেছিলেন স্বয়ং মহানায়ক
নিজস্ব প্রতিবেদন- বাংলা ছবির চিরকালীন জুটি। জুটি বেঁধে তাঁরা বাঙালিকে উপহার দিয়েছেন ৩০টিরও বেশি ছবি, যার প্রায় সবগুলোই বক্সঅফিসে ‘সুপারহিট’। পঞ্চাশ,ষাট ও সত্তর—এই তিন দশক রুপালি পর্দায় তো ছিলেনই, স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও ডিভিডি-ওয়েবেও উত্তম-সুচিত্রা জুটি জনপ্রিয় পরের প্রজন্মের কাছেও। রোমান্টিকতায় ভরপুর এ জুটি বাঙালিকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে ভালোবাসতে হয়। তাই তাঁদের বাংলা ছবির ফার্স্ট কাপল বললে ভুল হয় না।
উত্তম-সুচিত্রা জুটি রুপোলি পর্দার এমনই এক প্রেমিক-যুগল, যা চিরদিনের। এই জুটির পঞ্চাশের দশকের ছবির একটি রোমান্টিক দৃশ্য দেখলেও আজকের প্রেমিক হৃদয় উথাল পাতাল করে ওঠে। তাঁদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিটি সংলাপ কালোত্তীর্ণ। তাই তাঁরা কিংবদন্তি।
উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রথম হিট ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া হাসির এ ছবিটিতে উত্তম কুমার অথবা সুচিত্রা সেন কেউই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেননি। এমনকি এই ছবিটি যখন রিলিজ হয়, তখন পোস্টারে উত্তম-সুচিত্রার কোনো ছবিও ছিল না। ছবির প্রযোজক ও ডিস্ট্রিবিউটাররা সেই সময়ের বিখ্যাত চরিত্রাভিনেতা তুলসী চক্রবর্ত্তীকে পোস্টারের প্রধান মুখ বানিয়েছিলেন। কিন্তু ছবিটিতে উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক অভিনয় বাংলা সিনেমায় প্রথম নজরে পড়ে দর্শকদের।
এমন একটি রোমান্টিক জুটির জন্যই যেন গালে হাত দিয়ে বসেছিলেন পরিচালক-প্রযোজকেরা। এর পরেই বোঝা গিয়েছিল যে বাংলা ছবির নতুন 'টনিক' এসে গিয়েছে। এর পর পথে হলো দেরী, মরণের পর, শাপমোচন, শিল্পী, সাগরিকা, হারানো সুর, সবার উপরে, সূর্যতোরণ, চাওয়া-পাওয়া, সপ্তপদী, জীবনতৃষ্ণা, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, ইন্দ্রাণী, চন্দ্রনাথ, আলো আমার আলোর মতো অন্তত ৩০টির বেশি ছবিতে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গিয়েছেন এই জুটি। উত্তম-সুচিত্রা বাংলা সিনেমায় রোমান্টিসিজমের ধারাটাই পাল্টে দেন। দশকের পর দশক ধরে হয়ে ওঠেন বাঙালির চিরকালীন এক আইকন।
রোমান্টিক জুটি হিসেবে উত্তম-সুচিত্রা নিজেদের নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। জনপ্রিয়তার এমন একটি স্তরে তাঁরা ছিলেন যে সবকিছুই অনুকরণ করতেন অনুরাগীরা। সুচিত্রার পোশাক অনুকরণ করতেন সেইসময়ের মহিলারা। তাঁর শাড়ি পরা কিংবা চুল বাঁধার স্টাইল ছিল পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালি সমাজে অভিজাত্য ও ফ্যাশন-সচেতনতার প্রতীক ছিল। অনেকেই সুচিত্রার মুখের আঁকা তিল অনুকরণ করতেন। লিপ মেকআপ অনুকরণ করাও সেই সময়ে হয়ে উঠেছিল এক স্টাইল স্টেটমেন্ট।
একইভাবে উত্তম কুমারের হেয়ার স্টাইলের কদর ছিল আরও বেশি। তাঁর শার্টের কলার কেমন ধাঁচের ,তাঁর স্যুটের কাট—সবই অনুকরণ করতেন গুরুর অনুগামীরা। কলকাতায় সেলুনে সেলুনে পাওয়া যেত 'উত্তম ছাঁটে'র বিজ্ঞাপন। এমনকি ঠোঁটের কোণে সিগারেট ধরানো অথবা গভীর চোখে প্রেমিকার দিকে তাকানো পর্যন্ত অভ্যেস করতেন বাঙালি যুবকেরা।
উত্তম কুমার একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সুচিত্রা পাশে না থাকলে আমি কখনোই উত্তম কুমার হতে পারতাম না। এ আমার বিশ্বাস। আজ আমি উত্তম কুমার হয়েছি, কেবল ওর জন্য।’ সারাজীবন সুচিত্রাকে রমা বলে ডাকতেন উত্তম। গোড়ার দিকের প্রকাশিত ছবিতে বরাবর সুচিত্রার নাম উত্তমের আগে রাখা হত। উত্তম কুমারও মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করতেন, সুচিত্রা সেন তাঁর থেকে বড় স্টার।
বাংলা ছবির ইতিহাস অবশ্য একথাও বলে যে সুচিত্রা-উত্তম জুটি ভাঙার পর বাংলা ছবির প্রযোজক-পরিচালকদের মাথায় হাত। সেইসময়েও উত্তম কুমার অন্যান্য নায়িকাদের নিয়ে একের পর এক হিট ছবি দিয়ে গেছেন। অন্যদিকে সুচিত্রা সেন বরং অন্য নায়কদের সঙ্গে ছবি করতে গিয়ে সেই মানের হিট দিতে পারেন নি। অনেক ভালো ছবি তৈরি হয়েছে, কিন্তু ব্যবসায়িক মানে মোটের উপর জুটি চলে নি।
উত্তম-সুুচিত্রা আসলে পরস্পরের পরিপূরক জুটি। উত্তম ছাড়া সুচিত্রা কিংবা সুচিত্রা ছাড়া উত্তমকে দর্শকেরা একেবারেই দেখতে চাইতেন না। বাঙালির জীবনেএ এক অবিচ্ছেদ্য জুটি।