Vishmadev Chattopadhyay: এই শ্রাবণেই নিভে গিয়েছিল রাগসঙ্গীতের অম্লান এই শিখা
এক পূর্ণিমার রাতে বালিগঞ্জে অনুষ্ঠান সেরে বাড়ি ফিরছেন। সঙ্গে অন্য আরও কয়েকজন। হঠাত্ই মত বদলে ডায়মন্ড হারবার পাড়ি। ডায়মন্ড হারবারে যখন পৌঁছলেন তখন রাত গভীর। অনেক ডাকাডাকির পরে একটি দোকান থেকে একটি ছোট ছেলে বেরিয়ে এসেছিল। তার চেষ্টায় একটি শতরঞ্চিও মিলেছিল। সেটা পেতেই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে শুরু হয়েছিল গানের আসর। সে রাতে ভীষ্মদেব গেয়েছিলেন যোগিয়া। ১৯৭৭ সালে আজকের দিনে এই ৮ অগস্ট তাঁর মৃত্যু।
এই আশ্চর্য ভীষ্মদেব বাংলা তথা হিন্দুস্তানি রাগসঙ্গীত জগতে এক বিস্ময়। দুর্বারগতি তানবিস্তার আর অপ্রত্যাশিত চমকে সমৃদ্ধ ছিল তাঁর গায়কি। সরগম ছিল অনন্য। খেয়াল-ঠুমরিতে ছিল স্বকীয়তা। বাংলা রাগপ্রধান গানেও নতুন এক ধারা এনেছিলেন।
১৯০৯ সালে হুগলির পান্ডুয়ায় ভীষ্মদেবের জন্ম। তাঁর বাবা আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়, মা প্রভাবতী দেবী। মাত্র এক বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। ছোট থেকেই জাগতিক বিষয়ে ভীষ্মদেবের তেমন আকর্ষণ ছিল না। প্রথমে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। পরে ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী সময়ে পড়াশোনা বিদ্যাসাগর কলেজে।
ভীষ্মদেবের মায়ের গানবাজনার প্রতি আকর্ষণ ছিল। মায়ের থেকেই গান তাঁর মধ্যে আসে। শোনা যায়, ছোট্ট ভীষ্মদেব রেকর্ডে জোহরা বাঈ ও গওহরজানের গান শুনে সেই গান অবিকল গাইতে পারতেন।
১৯২০ সালে মাত্র এগারো বছর বয়সে ভীষ্মদেব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে এক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর গান শুনে পুষ্পস্তবক দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীও তাঁর গান শুনে আশীর্বাদ করেন। ১৯২৩ সাল নাগাদ বদল খান সাহেবের কাছে ভীষ্মদেবের গান শেখা শুরু।
কাজি নজরুল ইসলাম ভীষ্মদেবের একজন গুণমুগ্ধ ছিলেন। নজরুলের ইচ্ছেতেই ১৯৩৩ সালে তিনি মেগাফোন কোম্পানির সঙ্গীত পরিচালক ও প্রশিক্ষকের পদে যোগ দেন। সেই বছরেই মেগাফোন কোম্পানি থেকে তাঁর গাওয়া দু’টি খেয়াল প্রকাশিত হয়। ১৯৩৬ সালে মেগাফোন কোম্পানির কর্ণধার জে এন ঘোষ এবং কবি অজয় ভট্টাচার্যের অনুরোধে ভীষ্মদেব বাংলা গান রেকর্ড করতে রাজি হয়েছিলেন। প্রথম গান দু'টি ছিল 'ফুলের দিন হল যে অবসান' এবং 'শেষের গানটি ছিল তোমার লাগি'। ভীষ্মদেবের গাওয়া অন্যতম কালজয়ী বাংলা গান 'যদি মনে পড়ে সে দিনের কথা'।
ভীষ্মদেবের ব্যস্ত কর্মজীবনেই এসেছিল বাঁকবদল। কোনও ভাবে অস্থিরতা গ্রাস করে ছিল তাঁকে। মানসিক শান্তির সন্ধানেই তিনি পন্ডিচেরি চলে গেলেন। ১৯৪০ সালে ভীষ্মদেব পন্ডিচেরি যান। এর পর দীর্ঘ সাত বছর তাঁর সঙ্গে পরিবারের কারও যোগাযোগ ছিল না।
সাত বছর পরে ১৯৪৮ সালে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে তিনি পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় ফিরে আসেন। পন্ডিচেরি থেকে তাঁর ফিরে আসার খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন বেগম আখতার। বলেছিলেন, 'আরে ওয়া, সুর ওয়াপস আ গ্যয়া'!
তাঁর শিষ্যদের মধ্যে শ্যামানন্দ সিংহ, শচীন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীনদেব বর্মণ, সুরেশ চক্রবর্তী, প্রকাশকালী ঘোষাল, ভবানী দাস, হিমাংশু রায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, যূথিকা রায়, বেগম আখতার, কাননদেবী ও ছায়াদেবী উল্লেখযোগ্য।
সঙ্গীতাচার্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বি টি রোডে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কণ্ঠসঙ্গীত বিভাগে তৈরি হয়েছে সংগ্রহশালা।
সেখানে কিংবদন্তী শিল্পীর তানপুরা, হারমোনিয়াম, গানের সিডি-রেকর্ড, বিভিন্ন মেডেল, পদক, ব্যবহৃত জিনিসপত্র রয়েছে। রয়েছে তাঁর উপর লিখিত বইপত্র, সুরোরোপিত ছবির ক্যাটালগও।