সৌভিক মুখার্জি 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সেদিন কফি হাউসের টেবিলে হঠাত্ হাজির অশোকবাবু। হাতে পাঁপড়ভাজার মতন একটা কাগজ। চেয়ারটা টেনে ধপাস করে বসেই আমাকে বললেন, "পড়ে দেখুন, দেখে বুঝুন..."। মুদ্রা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অশোকবাবুর হাতে মুদ্রার বদলে কাগজ? ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কৌতূহল জাগল। পুরনো কলকাতা সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ নিয়ে কাজের সুবাদে আমাকে নাড়াচাড়া করতেই হয়। তবে সেগুলো প্রায় সবই সরকারি আদেশনামা। সে যাই হোক... আমি কাগজটা পড়া শুরু করলাম।


১৮৮২ সালে লেখা একটি চিঠি। খাগের কলমে ভিক্টোরিয়ান যুগের হাতের লেখায় (ক্যালিয়োগ্রাফি) এই চিঠিটা কোনও এক জনৈকা ইভ লিখেছেন তাঁর কোনও এক প্রিয়তম 'A'-কে। ইভের চিঠির পাঠোদ্ধার করতে সময় লাগল না। সুন্দর ইংরেজীতে প্রাণজ্জ্বল বক্তব্য। পুরোটা আবার পড়লাম....


My own darling A,
I cant go to church tomorrow as Godme wont let me to go because it is not Sunday. You can be at Gree Baboos Lane at 10 O'clock tomorrow and I will come. I will be as careful as I can. I conclude with love and kisses.
Believe...
Love yours affectily
Eva
In haste


পড়া শেষে চোখ তুলে তাকাতেই দেখি, মিটিমিটি চোখে অশীতপর অশোকবাবুর মুখে অদ্ভুত একটা হাসি! বললাম, এ নিয়ে এত আগ্রহ? এই ধরনের কাগজ তো খুঁজলে আরও হয়তো পাওয়া যেতে পারে। অট্টহাস্যে অশোকবাবু বললেন, তা পেতে পারেন, কিন্তু কোনও চিঠি যখন এতটা গোপনীয়তার মোড়কে মোড়া! কেন জানি না সেই সময়ের কলকাতার কোনও রহস্যের সন্ধান দিচ্ছে। মহিলারা অবশ্য আজীবন রহস্যময়। জানলাম, হাতে পাওয়া এই চিঠিটি পাওয়া গিয়েছে হাইকোর্টে সেই সময়কার এক ডিভোর্স সংক্রান্ত ফাইলে। কোর্টে এই চিঠিটি প্রমাণ হিসেবে জমা দেওয়া হয়েছিল। হয়তো এটাই ইভের অসততার প্রমাণ।


যদিও এ ধরনের অসততায় আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না। তবুও কফি হাউসের টেবিল, গুণগুণ আওয়াজ, সিনেমার মত ফেড আউট হয়ে যাওয়া মানুষের সম্পর্ক আর সেই সম্পর্কের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক কলকাতা আমাকে অস্থির করে তোলে। জানতে ইচ্ছা করে কে এই গডমে, ইভের হাজব্যান্ড? ইভ কী গডমে কে ভালবাসতেন না? জানি না। এর উত্তর শুধু ইভই জানেন। প্রেমিককে গোপনে গ্রি বাবু লেনে (gree baboos lane) আসতে বলার মধ্যে.... And I will come...কথাটার মধ্যে কেমন জানো অবাধ্য অবৈধ প্রেমের ছটফটানি। সেইসঙ্গে বড্ড আপন, একান্ত যে প্রেম তার প্রতি ডেডিকেশনও ধরা পড়ে ওই চিঠিতে।


আমি তখন সেই গ্রি বাবু লেন খুঁজছি। খুঁজছি সেই স্পেসটাকে যেখানে নির্জনে নিরালায় প্রেমিক-প্রেমিকা সময় কাটিয়েছিল। খুঁজেই চলেছি...অলি-গলি, তস্যগলি... আচ্ছা, গ্রি বাবু মানে কি গিরীশবাবু? পূর্বে মানিকতলা স্ট্রিট থেকে আরম্ভ হয়ে দক্ষিণে এগিয়ে তিনটে শাখায় বিভক্ত হয়েছে ঘোষ লেন। একটি শাখা চালতাবাগানের লেনে এসে পড়ে। আর একটি যুগল কিশোর দাস লেন। তৃতীয়টি আর্মহাস্ট্র স্ট্রিটে গিয়ে পড়ে। পৌরসভা ২৭ অগাস্ট ১৮৯০ এই ঘোষ লেন নামটি করেন। এর আগে রাস্তার নাম ছিল শুঁড়িখানা লেন। এই গিরীশচন্দ্র ঘোষের নামে এই লেন ছাড়া পরবর্তীকালে নাট্যকার গিরীশ ঘোষের নামে গিরীশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ হয়। কিন্তু চিঠি যা বলছে, গিরীশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ সে রাস্তা নয়।  


এমন ভাবতে ভাবতেই অশোকবাবু বললেন, "দেখুন মশাই আগের মাসে আমার জন্মদিন ছিল। বয়স হল ৮৩। এ বয়সে এসে এইটুকু বুঝতে পারি, যে মেয়ে তার প্রেমিককে রাত ১০টার সময় আসতে বলেন এবং চিঠি শেষ করেন "love and kisses" দিয়ে, সে প্রেম শুকনো চালভাজা ছিল না। চানাচুর ছিল বোধহয়। আসলে মানুষের এই অবাধ্য অবৈধ প্রেম চেতন বা অবেচতনে থেকে যায়। আজও আছে, সেদিনও ছিল। কিন্তু তার সামাজিক দলিল এভাবে হাতে পাওয়া যায় না।"


কথা বলতে বলতেই এরকমই এক ঘটনার কথা মনে পড়ল। ওয়ারেন্ট হেস্টিংস(ডিসেম্বর ১৭৩২–অগাস্ট ১৮১৮)-এর পদমর্যাদায় ঠিক নীচেই সেইসময় ছিলেন স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস। এই ফিলিফ ফ্রানিন্স একদিন কালো পোশাকে ৮ ডিসেম্বর, ১৭৭৮ রাতে ধরা পড়লেন মিসেস গ্র্যান্ডের বাড়িতে। অভিসারে। সাংবাদিকতার 'ঠাকুরদা' হিকি ভারতবর্ষে প্রথম সংবাদপত্র ছাপানোর আগে কয়েকদিন ওকালতি করেছিলেন। তাঁরই এক লেখার মধ্যে আছে, ফিলিপ ফ্রান্সিস চন্দননগর থেকে আগত মিসেস গ্র্যান্ডের বাড়ির জানলায় একদিন বাঁশের মই লাগান। কিন্তু তিনিজমাদারদের হাতে ধরা পড়েন। নিজের পরিচয় দেওয়ার পর, বিষয়টা বেশ শাঁসালো দেখে জমাদাররা আরওই তাঁকে ছাড়তে অসম্মত হন। ৫ মার্চ, ১৮৭৯ এই অভিসার পর্ব আদালতে সত্য প্রমাণিত হয়। ৫০ হাজার সিক্কা জরিমানা হয় ফিলিপ ফ্রান্সিসের।


এখানে অবশ্য মিসেস গ্র্যান্ডের কথাও একটু না বললে 'অন্যায়' হয়। ভচন্দননগরের এক ফরাসি ভদ্রলোকের মেয়ে ক্যাথরিন বিয়ের পর মিসেস গ্র্যান্ড হন। একমাথা সোনালি চুল, নীল টানাটানা চোখে মিসেস গ্র্যান্ড ছিলেন কলকাতার হার্টথ্রব। ফিলিপসের সঙ্গে এই ঘটনাটি ঘটার পরেও আরও বছর দুয়েক ছিলেন কলকাতায়। ১৭৮০ সালে তিনি কলকাতা ছেড়ে ইউরোপে ফিরে যান। জাহাজে ডাকসাইটে এই সুন্দরীর নাকি সঙ্গী ছিলেন ওয়াটারপ্রুফের আবিষ্কর্তা ম্যাকিনটসের পুত্র উইলিয়াম। শোনা যায় ফিলিপ ফ্রান্সিস পরের মাসে বিলেতে গিয়ে পৌঁছালেও, তাঁকে বিশেষ পাত্তা দেননি মিসেস গ্র্যান্ড। থাকতে শুরু করেন ফরাসি সাম্রাজ্যের অধিকর্তা নেপোলিয়ানের অন্যতম সহচর তথা স্বরাষ্ট্রসচিব মাঁসিও তাঁলেরাঁদ-এর সঙ্গে। পরে স্বয়ং নেপোলিয়ান তাঁলেরাঁদকে আদেশ করেন মিসেস গ্র্যান্ডকে বিয়ে করতে।


ফিলিপ ফ্রান্সিস বা গ্র্যান্ড, তাঁদের কী হয়েছিল জানি না। জানতে পারি না ইভের সেই অবাধ্য অবৈধ প্রেমেরই বা কী হয়েছিল। এসবই হচ্ছে অসমাজিক কাহিনীর গলিপথের গল্প। কলকাতারই মানুষ ছিলেন এঁরা। যেমন আমরা সবাই। ইতিহাস সব খবর রাখে না। কিন্তু চেপে রাখা আকাঙ্খাগুলো এভাবেই কখনও কখনও উঠে আসে ।