পার্থ প্রতিম চন্দ্র


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আর পাঁচটা প্যান্ডেলের থেকে এটা কেমন যেন একদম আলাদা। আলো নেই, চিত্‍কারগুলোও কেমন যেন আবছা শোনা যাচ্ছে। এটা এই প্যান্ডেলের থিম হবে বোধহয়। এখন তো সব কিছু নিয়েই থিম হয়। 


দীপু বুঝতে পারল এটা বেশ একটা অভিনব প্যান্ডেল। অন্তত বছর ১৫ সে চুটিয়ে ঠাকুর দেখেছে, কই এমন প্যান্ডেল তো চোখে পড়েনি, বা কানে আসেনি। প্যান্ডেলটা শুধু গা ছমছমে অন্ধকারই নয়, বেশ ফাঁকা, কেমন যেন একটা শোকের আবহ। 


তবে এটাও ঠিক এখনও মূল প্যান্ডেলটা বেশ খানিকটা দূরে। হয়তো ওইখানটা আলো থাকবে, ভিড় হবে। এই অন্ধকার রাস্তাটা ভারী অদ্ভূত। কেমন যেন পুরনো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।


জীবনের অনেক ঠিক-ভুল-আবেগ সব যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে এই অন্ধকারে। কেমন যেন সব শেষ, সব শেষ ফিলিংসটাও হচ্ছে। আরে তাই তো, অন্তরা কোথায় গেল?এত বড় ভুলের জন্য জিভ কাটল দীপু। অন্তরাকে খুঁজতেই তো এই প্যান্ডেলে এসেছে। মেট্রোয় চড়ে পাতাল থেকে সবে যখন মর্ত্যে প্রবেশ করেছিল দীপু, তখনই অন্তরা বলেছিল, শোনো দারুণ এখানটা দারুণ ভিড়। আমি চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। দীপু বলেছিল, না, না চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকাটা তোমার পক্ষে সেফ নয়। তুমি বরং কোনও পুজো প্যান্ডেলে ঢুকে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকো। আর শোনো আমি না আসা পর্যন্ত বেরিয়ো না। শেষের কথাগুলো বলার আগেই একটা ধাক্কায় ফোনটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তারপর আর অন্তরাকে ফোন করে পাচ্ছে না দীপু। একটা জটলা ভাঙা ভিড় ঠেলে দীপু এই প্যান্ডেলটায় এসেছে। এখানেই বোধহয় অন্তরা আছে। 


দীপু আবার অন্ধকারে কেমন যেন হারিয়ে গেল। অন্তরাকে আসলে তো হারিয়ে ফেলতেই চায়। পুজো পেরোলেই ডিসেম্বরে ওদের বিয়ে। দীপু হ্যাঁ করেছে বটে। তবে হ্যাঁ-টা এখন যদি না হয় তবে ভালই হত। কারণ দীপুর জীবনে উদয় হয়েছে নতুন এক নারীর। ফেসবুকে পরিচয়। রোজ রাতে স্কাইপে ও ওই নতুন নারীকে নিজের মত করে দেখে, উল্টেপাল্টে, লোলুপ চোখে। আর ভাবে এমন একজন জীবনে থাকলে তাঁর শরীরে হাজার হাজার ওয়াটের আলো জ্বলবে। তবে দীপু এটাও জানে অন্তরা ওকে খুব ভালবাসে। ভাল যে ও বাসে না, তা নয়, কিন্তু ওর ফোনটার মত সম্পর্কগুলোও পুরনো হয়ে গেল ওর ফেলে পালাতে ইচ্ছা করে। 


দীপু এবার প্যান্ডেলের এমন একটা জায়গা এল যেখানে দাঁড়িয়ে ওর হঠাত্‍ অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। একদিন ও অফিস থেকে বাইকে চড়ে বাড়ি ফেরার পথে মারাত্মক একটা দুর্ঘটনার মুখে পড়ল। ওর বাড়িতে নিজের বলতে কেউ নেই। বন্ধুবান্ধবও নেই বললেই চলে। এমন একটা সময় সেই রাতে দুর্ঘটনাটাও হওয়ার পর একা রাস্তায় পড়েছিল দীপু। ওর সারা গায়ে রক্তমাখা। হাতটা ছড়ে গিয়েছে। যন্ত্রনায় উঠতে পারছে না। রাত হয়ে যাওয়ায় কেউ আসছে না যে ওকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে দেবে। এদিকে নিজের লোকও সেই অর্থে কেউ নেই, যে ছুটে চলে আসবে। দীপু বুঝতে পেরেছিল, যেভাবে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে তাতে ওর প্রাণ সংশয় আছে। 


দীপু ফোনটা কোনরকমে বের করে একটা মিস কল দিতে পেরেছিল। তারপর ওর জ্ঞান হারায়। যখন জ্ঞান ফেরে তখন জেনেছিল, সেদিন রাতে মিস কলটা ও অন্তরাকেই করেছিল। তারপর সেই মিস কলটা দেখে বিপদের আঁচ করে টেলিফোন কোম্পানিতে কাজ করা ওর এক বন্ধুকে ফোন করে টাওয়ার ট্রেস করে দীপুর কাছে এসে, হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। দীপু পরে একদিন অন্তরাকে প্রশ্ন করেছিল, কী করে বুঝেছিল আমি বিপদে পড়েছিলাম। অন্তরা বলেছিল, সে তুমি বুঝবে না। তোমার বিপদ হলে আমি ঠিক বুঝতে পারি। দীপু অবশ্য ভেবে পায় না, সে রাতে কেন সে অন্তরাকেই ফোনটা করতে গিয়েছিল। সেই ঘটনার পর থেকে অন্তরাকে নিজের জীবনের অঙ্গ বানিয়ে ফেলে দীপু।


দীপুর কেন যেন মনে হচ্ছে ও এখন একটা বড় বিপদে পড়েছে। ওর যখন বছর দু বয়স, তখন ওর মা মারা গিয়েছিল। বাবা মারা যায় ও যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। তারপর ওর মামা ওকে কলকাতার এক মেসে ভর্তি করে চলে যায়। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় মামাও মারা যায়। ব্যস, ওর জীবনে আর কোনও আত্মীয়স্বজন থাকল না। গোটা পৃথিবীতে ও একা। বন্ধু-বান্ধব থাকলেও সব ওরা কাচের গেলাসের জগতের ভিতরের জগতেই বন্দি থাকল। 


এই যে দীপুর এখন মনে হচ্ছে ও একটা বড় বিপদে পড়েছে, তাহলে এখন কী করবে! তবে বিপদটা যে ঠিক কী সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এখন প্যান্ডেলের ভিতর হঠাত্‍ আওয়াজটা কেমন যেন জোরে হয়ে গেল। অনেকগুলো লোক কেমন যেন হতাশার সুরে জোরে কথা বলছে। কতগুলো লোক পুলিসের মত গলায় বলছে, সরে যান, সরে যান। এখানে একদম ভিড় করবেন না। কিন্তু এদের কাউকেই দীপু দেখতে পারছে না, শুধু বুঝতে পারছে একটা মহাবিপদে সে পড়েছে। মিনিট দশেক এই প্যান্ডেলের ভিতর থাকার পরেও ওর চোখে আঁধার কাটছে না। এদিকে প্যান্ডেলের মূল প্রাঙ্গনেও সে এসে গেছে। কিন্তু কী অদ্ভূত এদের ঠাকুরগুলোও সব ঘুটঘুটে অন্ধকারে আছে। দীপু কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না। ফোনটা নিয়ে অন্তরাকে মিস করে দিল। আর পারছে না... দীপু চোখটা বন্ধ করে দিল। 


অন্তরার দু চোখ জলে ভরে গেছে। দীপু চোখ বন্ধ করে আছে..মদ খেয়ে দীপু ঠাকুর দেখতে এসেছিল। মেট্রো থেকে নেমে রাস্তা পেরোতে যাওয়ার সময় একটা টাটা সুমো ওকে পিষে দেয়। রাস্তার ক জন লোক দীপুর রক্তমাখা দেহটা ফুটপাথে নিয়ে আসে। অন্তত মিনিট দশক দীপুর শরীরটা ছটফট করছিল। তারপর সব শেষ। 


অন্তরা বুঝতে পারল এরপর সব কাজ ওকেই করতে হবে। পুলিসের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে গেল...অভ্যাসবশত এই বিপদের সময়েও ও ওর ফোনটা চেক করল। দেখলে ওয়ান মিসড কল--ফ্রম দীপু...