গার্গী রায় চৌধুরী


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

"একদিকে নবমীর পুজোর ঢাক বাজছে, বাড়ির সবাই সেখানেই। আমি ফিরছিলাম বাড়ির দিকে, পোষা কুকুরটা দেখলাম কেন জানি ভয়ে দড়ি ছিঁড়ে দেওয়ার জোগাড়। সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম দুসপ্তাহ বয়সের ছোট্ট ছাগলছানার অদ্ভুত আর্তনাদ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুনলাম ঝোপে বড় পাথর ছোঁড়ার মতো শব্দ, দেখলাম ধবধবে সাদা ছাগলটার রক্তমাখা শরীরটা নিয়ে সরে গেল গাঢ় হলুদ-কালো ডোরা কাটা বিশাল শরীরটা"-আজও দিনটার কথা ভেবে রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেয় সনাতন মণ্ডলের (নাম পরিবর্তীত)।


এরকম অভিজ্ঞতা ওনার একার নয়, ওনার মতো সমগ্র সুন্দরবনবাসী। হ্যাঁ সুন্দরবন, বিশ্বের সেরা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সাম্রাজ্য। চিড়িয়াখানায় জলের ওপার থেকে বাঘ আমরা সবাই দেখেছি, তবে এখানে মানুষ বসবাস করে বাঘের এলাকায়, কোনও রকম নিরাপত্তা ছাড়া। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ আর গাছে সাপ- বাংলা প্রবাদটা মনে হয় এক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।


প্রায়, ১০,০০০ বর্গ কিমি অঞ্চল যার মধ্যে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে পদ্মা-গঙ্গার জল সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। নদীর জল গিয়ে মিশছে সাগরের নীল জলে।তারমধ্যেই বাস বহু মানুষের। জঙ্গলকে সঙ্গে নিয়ে, জঙ্গলে নির্ভর করে। ঝাঁ চকচকে শহুরে সভ্যতা থেকে অনেক দুরে এখানেই হয়ত একমাত্র কাঁটাতারও আলাদা করতে পারেনি প্রকৃতিকে।



পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের মানুষগুলোর জীবন ঠিক কি রকম তা হয়ত ঠান্ডা ঘরে বসে অনুমান বা অনুভব করা অসম্ভব। যেখানে আমরা টাই পরে সুগন্ধী মেখে অফিসের পথে রওনা দিই সেখানে ওরা হাতে বওয়া নৌকা নিয়ে পাড়ি দেয় সমুদ্রে মাছের সন্ধানে। আমাদের হাতে থাকে চামড়ার দামী ব্যাগ, ওরা সঙ্গে নেয়  হাতে বোনা বেতের ধামা মধু সংগ্রহের জন্য গভীর জঙ্গলে, কোন নিরাপত্তা ছাড়াই। সেজন্যই এখানকার বাড়ির বউরা তখনই শাঁখা-সিঁদুর ত্যাগ করে দেন যখন তাদের স্বামী জঙ্গলে পাড়ি দেয়। স্বামী ফিরলে সিঁথিতে ওঠে সিঁদুর না হলে সাদা থান। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বনবিবিকে পুজো করে রওনা দেয় জীবিকা নির্বাহে। এক কথায় বলা যায় নিজেদের জীবনকে জঙ্গলে উৎসর্গ করেই বাঁচে তারা। প্রতি পদে জীবন মৃত্যুর লুকোচুরি, বাঁচার কারণ প্রধানত দুটো- 1)মাছ 2)মধু কিন্তু মৃত্যুর কারণ অনেক।
জঙ্গল থেকে যখন তখন বেরিয়ে এসে বাঘ বসতি এলাকায় ঢুকে পড়ে খাদ্যের জন্য, তুলে নিয়ে যায় গবাদী পশু। বাঘের গর্জন শুনেই শুরু হয় দিন, শেষ হয় রাত। এতটা কাছাকাছি থেকে চলে খাদ্য ও খাদকের জীবনযাত্রা। বাঘ যেমন সুন্দরবনবাসীর কাছে ভয়ের কারণ ঠিক তার বিপরীতেই তারা দেবতা হিসাবে পুজো করেন বাঘরূপী দক্ষিণরায় দেবতাকে। তাদের বিশ্বাস বাঘই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে বহু দিক থেকে। বর্তমানে সুন্দরবন টুরিস্টদের কাছে অত্যন্ত রোমাঞ্চকর স্থান। সুন্দরবনই হয়ত একমাত্র এমন স্থান যেখানে দেখা মেলে ২০০ প্রজাতির পাখি, ১০ প্রজাতির কচ্ছপ ও ২৩ প্রজাতির সাপ। এছাড়া চিতল হরিণ, ল্যেপার্ড ক্যাট, মাড স্কিপার, গাঙ্গেও ডলফিন, কুমির, ফিশিং ক্যাট ও ভোঁদড়।


ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার এবং "Way 2 Wild" ট্যুর লিডার ও ফটো মেন্টর ঋদ্ধি মুখার্জী সুন্দরবন সম্পর্কে যা বলেছেন, "সুন্দরবন বলতে গেলে বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ভয়ঙ্কর সুন্দর' কথাটা বলতেই হবে, ওখানকার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশেষ করে জঙ্গলের মায়াজাল বিরল। ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারদের কাছে এটা স্বর্গ ও ট্যুরিস্টদের কাছে প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ।" 


বর্তমানে সুন্দরবন ধীরে ধীরে উন্নত হয়ে উঠছে। যার জন্য বিশাল অংশে দায়ী সুন্দরবন ট্যুরিজমকে ঢেলে সাজানো। বিভিন্ন ট্যুরে গাইড, বোট ভাড়া দেওয়া ইত্যাদি দ্বারা খুলে গেছে জীবিকার আরেক দিক।



শহরে পুজো আসন্ন, কদিন পরেই মা আসবেন মর্তে, বরণ করে নেওয়া হবে তাকে। সুন্দরবনও একইভাবে মেতে উঠবে উত্সবে তবে অনাড়ম্বরভাবে। হয়ত শহরের মতো থাকবে না এত আলো, থিমের ভিড় তবে সেখানেও নিজেদের মতো করে বরণ করা হবে মাকে। একটু অন্যভাবে আনন্দে মেতে উঠবেন তারা। 5-6টা গ্রাম নিয়ে সেখানে একটা পুজো হয়, গ্রামের আঞ্চলিক শিল্প, পালা গানে জমে মঞ্চ। বড় পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখে, মেলায় ঘুরে খাওয়া দাওয়া করে নিজেদের মতো করে কাটান পুজোর দিনগুলো।



নদীতে যেমন ভরা কোটাল মরা কোটাল আসে তেমন দুর্গাপুজোও তাদের জীবনে প্রতি বছর ফিরে আসে ভরা কোটালের জোয়ার নিয়ে। বছরের বাকি দিনগুলো থেকে একটু আলাদা করে বাঁচেন, আনন্দ করেন। দেবী ভাসানের পর আবার শুরু হয় জীবনযুদ্ধ, জঙ্গলে বাঁচার লড়াই। আর মনে মনে বলেন-আবার এসো মা।