Wriddhiman Saha: ঋদ্ধিকে বিচার দিতে BCCI-এর কমিটি গঠন, `ঘরের ছেলে`কে নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ও নীরব সিএবি
রক্তাক্ত, অপমানিত, লাঞ্ছিত ঋদ্ধিমান সাহা।
সব্যসাচী বাগচী: বিতর্ক থেকে সবসময় দূরে থেকেছেন। নিজের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে বাইশ গজের যুদ্ধে লড়াই করেছেন। তবুও এহেন ঋদ্ধিমান সাহা-কে (Wriddhiman Saha) শেষ পর্যন্ত নোংরা রাজনীতির শিকার হতে হল। ঋদ্ধিকে টিম ইন্ডিয়ার ড্রেসিংরুম থেকে ছেঁটে ফেলার জন্য বিসিসিআই (BCCI) ও টিম ম্যানেজমেন্টের মানসিকতা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। এক 'অভিজ্ঞ সাংবাদিক' তাঁকে 'হুমকি' দিলেও গত কয়েকদিন চুপ থেকেছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। অবশ্য এখন তিন সদস্যের কমিটিও গড়েছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sourav Ganguly) বোর্ড। সেই কমিটি নাকি পাপালিকে সঠিক বিচার দেবে!
এ বার এরসঙ্গে যোগ হল সিএবি-র (CAB) অকর্মণ্যতা। এবং ভোটের কথা মাথায় রেখে বাংলার ক্রিকেট কর্তাদের ভিন্ন মেরুতে চলে যাওয়া। একদিকে রয়েছেন সভাপতি অভিষেক ডালমিয়া। অন্যদিকে দুই যুগ্ম সচিব স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় ও ঘোলা জলে মাছ ধরতে যাওয়া দেবব্রত দাস। শোনা যাচ্ছে শান্ত স্বভাবের ঋদ্ধিকে অপমানিত করার পর পরিস্থিতি সামাল দিতে সিএবি কর্তাদের এখন হিমশিম অবস্থা। আপাতত ঋদ্ধিমান ইস্যুতে মুখে সবাই মুখে কুলুপ এঁটেছে। শুধু সিএবি নয়, ঋদ্ধি ইস্যুতে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের বিতর্ক না হয়, সেতার জন্য সংবাদমাধ্যমের কাজকর্মের ক্ষেত্রে ছয় দফার গাইডলাইন প্রকাশ করেছে বিসিসিআই।
দেশের হয়ে ৪০টি টেস্ট খেলেছেন। বাংলার হয়ে এখনও পর্যন্ত ৫২টি রঞ্জি খেলা হয়ে গিয়েছে। সেই ঋদ্ধির পেশাদারিত্ব ও মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন দেবব্রত দাস! অসময়ে 'ঘরের ছেলে'-র পাশে না দাঁড়িয়ে তাঁকে আক্রমণ করা নিয়ে অবশ্য ময়দানের সঙ্গে যুক্ত থাকা পোড়খাওয়া লোকজন অবাক নন। কারণ বাংলার জার্সি গায়ে চাপিয়ে একাধিক ম্যাচ জেতানোর পরেও ঋদ্ধির অন্য দুই সতীর্থ লক্ষ্মী রতন শুক্লা ও অশোক দিন্দা প্রাপ্য সম্মান পাননি। দুই ম্যাচ উইনারকে অসম্মানিত হয়ে সরে যেতে হয়েছিল। এ বার সেই তালিকায় জুড়ে গেল ঋদ্ধির নাম।
শুক্রবার রাতে সিএবি সভাপতি অভিষেক ডালমিয়া ধরমশালা উড়ে যাওয়ার সময় খুব অল্প কথায় জি ২৪ ঘন্টাকে টেলিফোনে বলেন, "দেবব্রত দাসের মন্তব্য সিএবি সহমত পোষণ করে না। এটা ওঁর ব্যাক্তিগত মতামত।" কিন্তু ঋদ্ধির ক্ষেত্রে কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সিএবি-র একাংশ? শোনা যাচ্ছে রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার ভোটের কথা মাথায় রেখে বেশ কিছু কর্তা নাকি বোর্ড সভাপতিকে রাগাতে চাইছেন না! ঋদ্ধির প্রতি একাধিক অন্যায় হওয়ার পরেও সেটা নিয়ে সরব না হয়ে, রঞ্জি ট্রফি না খেলার জন্য তাঁর মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু করলেন!
টেস্ট দল থেকে চিরতরে বাদ যাওয়ার পর ঋদ্ধি প্রকাশ্যে বোর্ড প্রধান সৌরভ, হেড কোচ রাহুল দ্রাবিড় (Rahul Dravid) ও মুখ্য নির্বাচক চেতন শর্মার (Chetan Sharma) নাম নিয়েছিলেন। একইসঙ্গে এক 'অভিজ্ঞ সাংবাদিক' তাঁকে হুমকি দেওয়ার পরে প্রতিবাদ জানিয়ে কড়া ভাষায় টুইট করেছিলেন ঋদ্ধি। সেই সাংবাদিকের নাম প্রকাশ্যে আনার জন্য পাপালিকে অনেক মহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে। প্রচার করার চেষ্টা চলছিল যে তিনি নাকি বোর্ডের সঙ্গে এখনও চুক্তিবদ্ধ। তাই বিসিসিআই-এর নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার জন্য ঋদ্ধিকে নাকি 'শো কজ' করা হতে পারে। কিন্তু আসল তথ্য হল পাপালির সঙ্গে বোর্ডের চুক্তি তো গত অক্টোবর মাসেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। বোর্ডের চুক্তির বাইরে থাকা ক্রিকেটারকে কি আদৌ 'শো কজ' করা যেতে পারে! আর যদি তাঁকে শেষ পর্যন্ত 'শো কজ' করাই হয়, তাহলে বিরাট কোহলি (Virat Kohli) কীভাবে বিসিসিআই-এর থেকে ক্লিনচিট পেলেন? তিনি তো দক্ষিণ আফ্রিকা উড়ে যাওয়ার আগে বোর্ড প্রধান সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কোহলি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, বোর্ড সভাপতি তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগই করেননি!
যদি চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়কে বোর্ড এত গুরুত্ব দিয়েই থাকে তাহলে তো দ্রাবিড়কেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। কারণ, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের শেষে ঋদ্ধির আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে ফুলস্টপ দেওয়ার পর, সেই বিষয়ে তিনিও সাংবাদিক সম্মেলনে খোলামেলা কথা বলেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তৃতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচের শেষে ঋদ্ধি ইস্যুতে রাহুলকে প্রশ্ন করা হলে তিনিও পাপালির সঙ্গে তাঁর আলোচনা ব্যাপারটা স্বীকার করে নেন। এবং বিস্তারিত ভাবে নিজের মতামত দিয়েছিলেন। দ্রাবিড়ও তো বোর্ডের চুক্তিবদ্ধ। তাহলে তিনি কেন দলের অন্দরের কথা প্রকাশ্যে আনলেন? সেটা নিয়েও ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়েছে।
যাবতীয় ঘটনার সুত্রপাত ঋদ্ধির চলতি মরশুমে রঞ্জি না খেলা নিয়ে। সিএবি-র রক্তদান দিবসে সস্ত্রীক ইডেনে এসেছিলেন তিনি। সে দিন সিএবি সভাপতির সঙ্গে অনেকটা সময় আলোচনা করেন ঋদ্ধি। বিশ্বস্ত সুত্রের খবর, ভারতীয় দলে যে তাঁকে আর রাখা হবে না সেটা অভিষেক ডালমিয়াকে জানিয়ে এসেছিলেন পাপালি। একইসঙ্গে রঞ্জি না খেলার দুটি কারণও সিএবি প্রধানকে জানিয়েছিলেন এই উইকেটকিপার। রঞ্জি না খেলার পিছনে পারিবারিক সমস্যা ছাড়াও, টেস্ট দলে জায়গা না পাওয়ার জন্য বাংলা দলে জুনিয়র ক্রিকেটারকে সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলেন পাপালি।
কিন্তু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কা সিরিজের দলে তাঁর নাম থাকার পরে জি ২৪ ঘণ্টার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ঋদ্ধি। কাঁধে ব্যথা নিয়ে কানপুর টেস্টে লড়াকু ৬১ রান করার পর বোর্ড প্রধান সৌরভ লড়াইয়ের তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি বলেছিলেন,'যতদিন আমি আছি চিন্তা করতে হবে না'। দুজনের আলাপচারিতা সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষ হতেই দ্রাবিড় যে তাঁকে অবসর নিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সেটাও প্রকাশ্যে বলে দেন ঋদ্ধি। নির্বাচন প্রধান চেতন শর্মাও টেলিফোনে ঋদ্ধিকে জানিয়েছিলেন তাঁকে আর টেস্ট দলে নেওয়া হবে না। সেটাও প্রকাশ করেন ঋদ্ধি।
ঋদ্ধির এমন বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারের পরেই সিএবি একাংশের কর্তারা সভাপতি অভিষেক ডালমিয়ার বিপরীত রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছেন। সিএবি সচিব স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি ইডেনে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিলেন, "দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় প্রকাশ করে ঠিক করেনি। সব কিছুরই একটা নিয়ম থাকে।" একইসঙ্গে ঋদ্ধির রঞ্জি ট্রফি না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েও মুখ খুলেছিলেন তিনি। যোগ করছিলেন, "আমার মনে হয় ওর রঞ্জি ট্রফি খেলা উচিত ছিল।" এমনকি ঋদ্ধির ইস্যু নিয়ে সিএবি যে বোর্ডকে কোনও অনুরোধ করবে না, সেটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যুগ্ম সচিব। সে দিন স্নেহাশিস আরও দাবি করে বলেছিলেন, "ওকে যখন প্রথম জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রঞ্জি খেলবে কি না, হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। পরে বাংলার প্রধান নির্বাচক শুভময় দাসকে ফোনে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল ঋদ্ধির সঙ্গে। তখন ঋদ্ধি জানায় ব্যক্তিগত কারণে ও খেলবে না। রঞ্জি খেলে দুটো সেঞ্চুরি করলে কে বলতে পারে ঋদ্ধিকে টেস্ট দলে ফেরানো হত না!"
অথচ সুত্র মারফত জানা গিয়েছে দল নির্বাচনের বেশ কয়েকদিন আগেই সিএবি সভাপতিকে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ঋদ্ধি। এমনকি পাপালির ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি,অভিষেক ডালমিয়া ছাড়াও দলের কোচ অরুণলাল, নির্বাচক প্রধান শুভময় দাসও তাঁর রঞ্জি না খেলার বিষয়টি জানতেন। আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন। ঋদ্ধিমানের বিষয়টি সিএবি-র একাধিক ব্যক্তি যখন জানতেন তাহলে কেন সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হল না সচিব স্নেহাশিসকে? নাকি সব জেনেও সিএবি সচিব অন্য কোনও কারণে ঋদ্ধির ভুলগুলো প্রকাশ্য তুলে ধরেছেন?
আর এ সবের মধ্যে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন সিএবি-র আর এক যুগ্ম সচিব দেবব্রত দাস। তিনি আবার নাকি ঘনিষ্ঠমহলে দাবি করেছেন, বাংলার হয়ে খেলার ব্যাপারে ঋদ্ধিমানের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে নাকি ঋদ্ধিমান বাংলার হয়ে খেলতে চান না। এই মন্তব্য প্রকাশ্যে আসার পরই ঋদ্ধির স্ত্রী দেবারতি সিএবি কর্তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন তিনি।
একটা সময় তিনি বিতর্ক থেকে শতহস্ত দূরে থাকতেন। দেশ, রাজ্যদল এমনকি ক্লাবের হয়েও সমান মানসিকতা নিয়ে উজাড় করে দিয়েছিলেন। হার-জিত খেলার অঙ্গ। ক্রিকেট এক বলের খেলা। কিন্তু কখনও নিজের জন্য খেলেননি। ওয়ার্ক এথিক্স বজায় রেখে বরাবর দলকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। সেই পাপালিকে এখন অপমানিত হতে হচ্ছে! তাঁর উপর ব্যক্তিগত আক্রমণ চলছেই। ক্ষতবিক্ষত তিনি।
যদিও ঋদ্ধি এই ইস্যু নিয়ে আর মুখ খুলতে রাজি নন। কিন্তু ইস্যুটা যেন থামতেই চাইছে না।
আরও পড়ুন: Wriddhimam Saha Exclusive: বিতর্কিত টুইট সিরিজ থেকে IPL-এ নতুন অঙ্গীকার, অকপট ঋদ্ধিমান
আরও পড়ুন: Wriddhiman Saha: বোর্ডের চুক্তির অঙ্ক দেখিয়ে ঋদ্ধিকে সমস্যায় ফেলার নতুন ছক শুরু হল!