Diamond Derby 1997: ডায়মন্ড ডার্বির ২৫, বাইচুংয়ের হ্যাটট্রিক নিয়ে আবেগি প্রথম গোলদাতা নাজিমুল
হারের জন্য অনেকে অমল দত্তকে দায়ী করেন। কারণ ডার্বি যুদ্ধে আবহ আরও গরম করে দেওয়ার জন্য বাইচুং-কে `চুং চুং`। ওমেলোকে `ওমলেট` বলে কটাক্ষ করেছিলেন সবুজ-মেরুনের প্রাক্তন কোচ।
সব্যসাচী বাগচী
বাঙালির কাছে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি (Natwest Trophy) জয়ের ২০ বছর পূর্ণ হওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই তাৎপর্য বহন করে ডায়মন্ড ডার্বির (Diamond Derby 1997) ২৫ বছর। ইতিহাস এ ভাবেই বারবার ফিরে আসে। ইতিহাস গড়া দুটি মানুষ আজ আমাদের মধ্যে নেই। 'ডায়মন্ড ছক'-এর (Diamond Derby) আবিষ্কারক ও মোহনবাগানের (Mohun Bagan) প্রাক্তন কোচ অমল দত্ত (Amal Dutta) ২০১৬ সালে চলে গিয়েছেন। তাঁর স্ট্রাটেজিকে ছারকার করে ডার্বি জয়ী কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও (PK Banerjee) আমাদের মধ্যে নেই। প্রবাদপ্রতিম 'পিকে' চিরবিদায় নিয়েছিলেন ২০২০ সালে। তবুও বঙ্গ ফুটবলপ্রেমীদের মনে এখন বেঁচে আছে ১৯৯৭ সালের সেই ১৩ জুলাই। স্কোরলাইন ইস্টবেঙ্গলের (East Bengal) অনুকুলে ৪-১ হলেও, ম্যাচটা কিন্তু দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর সমর্থকদের কাছে আজও অমর।
অনেক ডার্বিরই সাক্ষী থেকেছে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। আইএসএল-এর (ISL) হাত ধরে হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। ২৫ বছর আগে এমন বিশেষ দিনে ফেডারেশন কাপের (Federation Cup 1997) সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের (EB vs MB) মর্যাদার ডার্বি নিয়ে উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজারে দর্শকে ঠাসা ছিল স্টেডিয়ামে গ্যালারি। কলকাতা ডার্বির ১০১ বছরের ইতিহাসে ম্যাচটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। স্রেফ ফুটবল উন্মাদনার জন্য। প্রত্যেকটি টিয়ারে তখন ৪০ হাজার লোক তখন বসত। মোট টিকিট ছাপা হত এক লাখ ১৮ হাজার। এর মধ্যে বিক্রয় যোগ্য টিকিট ছিল ৮৮,০০০। ২০ হাজার টিকিট ভাগ করে দেওয়া হতো প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সদস্যদের জন্য। ১০ হাজার টিকিট রাখা থাকত তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী ও তাঁর অনুগামীদের কাছে। কিন্তু সে বার অমল দত্তের 'ডায়মন্ড সিস্টেম' মানুষের মনে এতটাই রেখাপাত করেছিল যে টিকিট মাত্র দু'দিনে বিক্রি হয়ে যায়। ফলে ম্যাচের আগের দিন বাড়তি ১২ হাজার টিকিট ছাপাতে বাধ্য হয়েছিল প্রশাসন।
কেমন ছিল সেই ম্যাচের আবহ? লাল-হলুদের জার্সি গায়ে চাপিয়ে ম্যাচের প্রথম গোল করেছিলেন নাজিমুল হক (Najimul Haque)। ২৫ বছর কেটে গেলেও তাঁর কাছে সেই মুহূর্তগুলো এখনও জীবন্ত। এহেন প্রাক্তন ফুটবলার জি ২৪ ঘণ্টাকে বলেন, "২৫ বছর আগের ঘটনা হলেও আমার মনে হয়, এই তো চোখের সামনে সবটা দেখতে পারছি। এখন সেই ম্যাচ, গ্যালারি উপচে যাওয়া যুবভারতীর কথা ভাবলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। ম্যাচের আগে অমল দা আমাদের দল নিয়ে অনেক বিদ্রুপ করেছিলেন। সেই কথাগুলো আমাদের কানে তুলে তাতিয়েছিলেন প্রদীপ দা। মনে মনে শপথ নিয়েছিলাম মোহনবাগানকে হারাবই।"
২৫ মিনিটে ম্যাচের প্রথম গোল এসেছিল নাজিমুলের পা থেকেই। তাও আবার সাইডভলিতে করেছিলেন গোল। কী ভাবে করলেন প্রথম গোল? নাজিমুল যোগ করলেন, "ডায়মন্ড ডার্বি খেলতে নামার আগে অনেকবার অনুশীলনে সাইডভলিতে গোল করেছি। তবে ম্যাচে করতে পারিনি। ওই দিন আমরা প্রথম দিকটায় বেশ চাপে ছিলাম। স্কোরবোর্ড দেখলে সেটা বোঝা সম্ভব নয় ঠিকই, তবে প্রথম দিকে ভাল আক্রমণ করতে থাকে মোহনবাগান। বেশ কয়েকটা কর্নার আদায় করেছিল। তাই আমার গোল ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"
নাজিমুলের স্মৃতিতে এতটুকু মরচে ধরেনি। সে দিন যুবভারতীর গ্যালারির ছিল লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন রঙে কানায় কানায় ভরা । 'ডায়মন্ড সিস্টেম'এর স্রষ্ঠা অমল দত্ত আজ না থাকলেও, এই বিশেষ দিনটিতে প্রত্যেক ফুটবল পাগলের মনে তিনি অমলিন। ৩-২-৩-২ ফর্মেশনে একের পর এক সাফল্য পাচ্ছিলেন মোহনবাগানের কিংবদন্তি কোচ। বড় ম্যাচে নামার আগেই চার্চিল ব্রাদার্সকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল মোহনবাগান। স্বভাবতই ফেভারিট হিসেবে নেমেছিল সবুজ-মেরুন।
ডায়মন্ড পদ্ধতিতে অমল দত্তের মোহনবাগান আগ্রাসী মেজাজের ফুটবল খেলত। কী ভাবে সেই ছককে ভেঙেছিলেন প্রবাদপ্রতিম 'পিকে'? নাজিমুল ফের জানালেন, "আমরা সেই সময় কাউন্টার অ্যাটাক নীতিতে ফুটবল খেলতাম। সেই ছক নিয়েই দ্রুত গোল তুলে নিতে চেয়েছিলাম। আমাদের দলে একমাত্র স্ট্রাইকার ছিল বাইচুং ভুটিয়া (Bhaichung Bhutia)। তাই মোহনবাগানের আক্রমণ ঠেকিয়ে দ্রুত উঠে আসতে হত আমাদের। আর আমরা সেটাই করেছিলাম।"
সেই ডার্বির অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন 'পাহাড়ি বিছে'। সেই বছর তিনি জেসিটি থেকে ইস্টবেঙ্গল ফিরেছিলেন। ২৫ মিনিটে নাজিমুলের গোলে এগিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। বিরতিতে স্কোর ১-০ ছিল। এরপর শুরু হল দ্বিতীয়ার্ধ। এই অর্ধ শুধু বাইচুংয়ের নামেই লেখা ছিল। দুরন্ত মেজাজে হ্যাটট্রিকে আমল দত্তের 'ডায়মন্ড সিস্টেম' ধ্বংস করে দেন বাইচুং। ফলাফল ছিল লাল-হলুদের পক্ষে। ৪-১।
অবশ্য হারের জন্য অনেকে অমল দত্তকে দায়ী করেন। কারণ ডার্বি যুদ্ধে আবহ আরও গরম করে দেওয়ার জন্য বাইচুং-কে 'চুং চুং'। ওমেলোকে 'ওমলেট' বলে কটাক্ষ করেছিলেন সবুজ-মেরুনের প্রাক্তন কোচ। তবে সেই ডার্বি হারলেও, প্রখর ফুটবল মস্তিষ্ক অমল দত্ত কিন্তু তাঁর 'ডায়মন্ড সিস্টেম' ছেড়ে বেরিয়ে আসেননি। সেই ডার্বি হারের ঠিক ১৭ দিনের মাথায় ২ অগাস্ট কলকাতা লিগের ডার্বিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল সবুজ-মেরুন। গোলদাতা ছিলেন দীপেন্দু বিশ্বাস। স্বভাবতই নিখাদ ফুটবলপ্রেমীরা ফুটবল অনুরাগী অমল দত্তকে বাহবাই দিয়েছিলেন।
২৫ বছর কেটে গিয়েছে। অনেকটা বদলে গিয়েছে ভারতীয় ফুটবল। আইএসএল-এর হাত ধরে ঝাঁ চকচকে ব্যাপার এসেছে। মোহনবাগান এখন এটিকে মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গলের নামের পাশে জুড়তে চলেছে ইমামি। তবে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার সম্বলিত যুবভারতীর সেই আবগের ধারেকাছেও এই আধুনিকতা আসবে না। কারণ 'ডায়মন্ড ডার্বি' দুই শব্দের সঙ্গে 'হীরে' যুক্ত আছে। আর হীরে যে সবচেয়ে দামি রত্ন সেটা তো সবাই জানে।
আরও পড়ুন: On This Day in 2002: গর্বের ২০ বছর, ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জয়ের সদস্যরা কে কী করছেন? ছবিতে দেখুন
আরও পড়ুন: Exclusive| Arun Lal : কেন বাংলার কোচের পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন অরুণ লাল? জানতে পড়ুন